বিশেষ প্রতিবেদন

অগ্নিকাণ্ডে বছরে ক্ষতি ২২১ কোটি টাকা, প্রয়োজন তদারকি ও সচেতনতা

অগ্নিকাণ্ডে বছরে ক্ষতি ২২১ কোটি টাকা, প্রয়োজন তদারকি ও সচেতনতা

চোখের সামনে ‘আব্বু’ বলে ডাক দিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে গেলো আমার আদরের ছোট ছেলে বৈশাখ। পারিনি বাঁচাতে তাকে লেলিহান আগুন থেকে। কী যে বুক ভরা কষ্ট আর স্মৃতিমাখা বেদনা নিয়ে আজও আছি, তা বলে বোঝানো যাবে না।

Advertisement

২০১০ সালে রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সাত বছর বয়সী শিশুসন্তান বৈশাখকে হারানোর দুঃসহ শোকস্মৃতি এভাবেই ব্যক্ত করছিলেন হতভাগা বাবা মো. মামুন মিয়া। নিমতলী ট্র্যাজেডিতে সরকারি হিসাবেই ১১৭ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। আহতের সংখ্যা ছিল দুইশোর কাছাকাছি।

২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় অনেককে। এখানেই শেষ নয়, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভুলতায় সেজান জুস কারখানায় এবং একই বছরের শেষ দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চে মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হতাহতদের পরিবারগুলো আজও যেন দুঃস্বপ্নের ভেতর থেকে শিউরে ওঠেন।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে বছরজুড়ে ছোট-বড় গড়ে ২০ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব অগ্নিকাণ্ডে বছরে গড় মৃত্যু দেড় শতাধিক। গড় ক্ষয়ক্ষতি কয়েকশো কোটি টাকা। এসব অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ, রান্নার চুলা ব্যবহারে অসতর্কতা, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ বা রাসায়নিক গুদাম। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের দুর্ঘটনার হার কমাতে অগ্নিকাণ্ড রোধের বিষয়ে সবার কঠোর নজরদারি, জনসচেতনতা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

Advertisement

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজার ৮৯৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে গড়ে ক্ষয়ক্ষতি ২২১ কোটি ৬০ লাখ ২ হাজার ৫৬৬ টাকা। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) ছোট-বড় ১০ হাজার ৯৯৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২১ কোটি ৯৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫০ টাকা।

কড়াইল বস্তি পুড়ে যাওয়ার পরে-ফাইল ছবি

বিগত বছরগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২১ সালে ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ডে ২১৮ কোটি ৩১ লাখ ৯৭ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ২০২০ সালে ২১ হাজার ৭৩টি অগ্নিকাণ্ডে ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ৪৪ টাকা, ২০১৯ সালে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডে ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ ২৮ হাজার ৭৪৪, ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডে ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৫ এবং ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৫৭ কোটি ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮৬ টাকা। তবে বছরজুড়ে এসব অগ্নিকাণ্ডের অর্ধেকের বেশি ঘটনায়ই কোনো অপারেশনে যেতে হয়নি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সদস্যদের।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, এসব অগ্নিকাণ্ডে প্রতি বছর গড়ে দুই শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়। আহত হন কয়েক হাজার মানুষ। পরিবার-পরিজন হারিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। আহত ব্যক্তিদের অনেকের জীবনযাপন হয়ে ওঠে মানবেতর। গত বছরের ডিসেম্বরে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ৩৮ জনের প্রাণ ঝরে। একই পরিবারের মারা যান ছয়জন এবং আহত হন বেশ কয়েকজন। ভুক্তভোগী এ পরিবারটির আহত সদস্যদের কেউ কেউ হাতের পুঁজি ফুরোনোয় চিকিৎসার খরচ জোগাতে এখন হাত বাড়াচ্ছেন এলাকাবাসীর কাছে।

Advertisement

অগ্নিকাণ্ডে লন্ডভন্ড এ পরিবারটির এক সদস্য মোহাম্মদ মুন্না শেখ জাগো নিউজকে বলেন, আমার ভাই, তার সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনসহ ছয়জন মারা গেলেন। বর্তমানে খুবই করুণ অবস্থা আমাদের। যত দ্রুত সম্ভব ভাবির পায়ের অপারেশন করানো দরকার। অন্যথায় তার পা হয়তো কোনোদিনই ভালো হবে না, অচল হয়ে যেতে পারে। গ্রামের মসজিদে ঘোষণা দিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার পরই সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হলেও এখনো তেমন কিছুই পাইনি আমরা।

জ্বলেও আগুন জ্বলে, প্রাণ যায় মানুষের-ফাইল ছবি

বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শুধু বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিই হয় না, অকালে ঝরে অগণিত প্রাণ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২২ সালের প্রথম চার মাসেই (জানুয়ারি-এপ্রিল) দেশে অগ্নিকাণ্ডে ৬৫৩ জনের মৃত্যু এবং আহত হন ৬ হাজার ২৭ জন, ২০২১ সালে মারা গেছেন ২১৯ জন এবং আহত ৫৭০, ২০২০ সালে মৃত্যু ১৫৪ এবং আহত ৩৮৬, ২০১৯ সালে মৃত্যু ১৮৫ এবং আহত ৫৮৬, ২০১৮ সালে মৃত্যু ১৩০ এবং আহত ৬৭৭ এবং ২০১৭ সালে ৪৫ জনের মৃত্যু এবং আহত হন ২৮৪ জন।

দেশে ৮০ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বৈদ্যুতিক গোলযোগের (নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনা) কারণে। বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ধরন ও তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিস বলছে, বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক গোলযোগ। অর্থাৎ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সহজেই শর্টসার্কিট হয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। আবাসিক ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও এখন আগুন লাগার প্রধান কারণ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার। এছাড়া আগুন লাগার আরেকটি বড় কারণ বিড়ি-সিগারেট ও রান্নার চুলা।

গত পাঁচ বছরের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে অগ্নিকাণ্ডের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। বছরে গড়ে ৩৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটে শর্টসার্কিটের কারণে। এরপরই রয়েছে রান্নার চুলা। বছরে গড়ে ১৯ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের কারণ চুলার জ্বলন্ত টুকরো অংশ। ২০২১ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগে ৩৬ দশমিক ৮২ শতাংশ, রান্নার চুলা থেকে ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২০ সালেও সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে বৈদ্যুতিক গোলযোগ, রান্নার চুলা ও বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকেই। আগের দু’বছর অর্থাৎ ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগে ৩৯ শতাংশ, রান্নার চুলা থেকে ১৮ এবং বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ১৫ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১৭ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগে ৩৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ, রান্নার চুলা থেকে ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটে।

চুড়িহাট্টার আগুনে যাদের অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে-ফাইল ছবি

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) না মানা, আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে বিস্ফোরক কেমিক্যাল ব্যবসা পরিচালনা, এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও সঠিক তদারকি না করা, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে ব্যর্থতা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ড ঘটেই চলছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি না করা এবং আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে বিস্ফোরক কেমিক্যাল ব্যবসা পরিচালনার কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা কমছে না। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে অগ্নিনির্বাপক ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমাদের যে ফায়ার ব্রিগেড তাদের কাছ থেকেও একটা ছাড়পত্র নিতে হয়। ছাড়পত্র দেওয়ার আগে বিল্ডিংটি নির্মাণে সঠিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে কি না, সেটি খুব ভালোভাবে সরেজমিনে দেখা দরকার। আবার কোনো স্থান আবাসিক ভবনের জন্য অনুমোদন নিয়ে সেটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাণিজ্যিক লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনকেও সরেজমিনে পরিদর্শন করা উচিত। সিটি করপোরেশনকে তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। নয়তো অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনার লাগাম টানা যাবে না।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে একবার কোনো কিছু ঘটার পর আর তদারকি করা হয় না। ফলে বারবার দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। দেশে যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে সেখানে কেমিক্যাল মজুত বা ব্যবসার জন্য আলাদা ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। সরকার চাইলে এ উদ্যোগ নিতে পারে।

লঞ্চ দুর্ঘটনা বা হাট-বাজারে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে ড. হাদিউজ্জামান বলেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে যে লঞ্চগুলো তৈরি করা হয় সেগুলোতে নৌযানের আর্কিটেকচারাল একটা গঠন থাকার কথা থাকলেও তা থাকে না। ফলে ইঞ্জিনের পাশে রান্নাঘর কিংবা তেল অথবা বিস্ফোরকদ্রব্য রাখা হয়। এতে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। এজন্য প্রয়োজন কঠোর নজরদারি। বাজার কিংবা উৎপাদনশীল কোনো জায়গায় আগুন লাগার কারণ বিষয়ে শ্রমিকদের সচেতন করা খুবই জরুরি। এমনকি তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দরকার। কারণ, ওইসব জায়গায় বেশিরভাগ সময়ই অগ্নিকাণ্ড ঘটে অসতর্কতার কারণে। বিদ্যুৎ লাইন কিংবা সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ থেকে অনেক সময় আগুন লাগে। আগুন লাগলে তাৎক্ষণিকভাবে কী করণীয়, এ বিষয়ে শ্রমিকদের সচেতন করা উচিত।

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে জনসচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমাদের কাজ সবচেয়ে বেশি থাকে। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে নতুন ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার ব্যবস্থাপনা দেখে আমরা ছাড়পত্র দিই। এরপর বিভিন্ন সময় তদারকি করি, এমনকি মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হয়। আমাদের ইন্সপেক্টররা নিয়মিতই এসব বিষয় তদারকি করেন।

তিনি বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর আমরা প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করি। বিভিন্ন জায়গায় মহড়া দিই। তবে এসব মহড়া প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট বলবো না। এ তৎপরতা আরও বাড়াতে পারলে ভালো। যদিও মহড়ার বাইরেরও আমাদের আরও অনেক কাজ থাকে। এক্ষেত্রে জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। নিয়মিত মহড়া দিতে অতিরিক্ত জনবল দরকার।

আরএসএম/এমকেআর/এসএইচএস/জেআইএম