রোহিনী নামের একজন ছেলে দুজন মেয়ে– ইতি রানী এবং মমতা রানীকে এক আসরে বিয়ে করার যে ঘটনাটি ঘটিয়েছিল তা আসলেই আইনগতভাবে ঠিক এবং সমাজের চোখে প্রশংসিত ছিল। কারণ বাংলাদেশের হিন্দু আইনে পুরুষদের একসঙ্গে অনেকগুলো বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই। যদিও আমাদের অনেকের চোখে এটা নোংরা ও নিষ্ঠুর কাজ।
Advertisement
একমাস না যেতেই সেই দুই মেয়ের একজন মমতা রানী নাকি ‘ডিভোর্স’ দিয়েছে, যা আইনগত নয়। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে একটি বহু প্রশংসিত আইনসম্মত নোংরা কাজ দৃশ্যত; বেআইনি পন্থায় অবসান হয়েছে। কিন্তু অবসান কি হয়েছে? মেয়ে দুটির জীবনের তিক্ততা ও কষ্ট শেষপর্যন্ত তাদের কোথায় নিয়ে যাবে আমরা কেউ এখনই বলতে পারি না। আমরা জানি না এই ছেলেটার প্রেম খেলার শিকার দুই মেয়ের কোনো একজন প্রতিকারের জন্য ফৌজদারি আইনের আশ্রয় নিতে যাবে কি না।
আমরা জানি না ছেলেটি গ্রেফতার হবে কি না। আমরা জানি না ক্ষতিগ্রস্ত এই মেয়েটি এধরনের বেআইনি বিচ্ছেদের মাধ্যমে আদৌ কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কি না। অথচ মেয়েটির সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত জীবন, আবেগ অনুভূতি এবং ভবিষ্যৎ সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সন্দেহ নেই।
নোংরামিটা পুরুষতান্ত্রিক (বা লিঙ্গ নিপীড়নতান্ত্রিক) নোংরামি পন্থায় জনসমক্ষে এনেছে মিডিয়া। এরকম অনৈতিক কর্মকে তারা অনৈতিকভাবে ‘প্রেম’ আখ্যা দিয়ে জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছিল। এরপর জনগণ তাদের ত্রিভূজ প্রেমের জয়গান গাওয়া শুরু করে। প্রশংসা আর অভিনন্দনের বন্যায় ফেসবুক ভাসিয়ে দেওয়ার সাথে অনেকেই আফসোস প্রকাশ করে, ‘আহারে আমি একটাই পাই না ও একসঙ্গে দুইটা’ – এই ভাষায়।
Advertisement
তখনকার সংবাদ অনুযায়ী রোহিনী প্রথমে ইতি রানীর সঙ্গে প্রেম করে তাকে গোপনে বিয়ে করেছিল। এরপরই সে নাকি মমতার প্রেমে মজে। খালি প্রেম, আর প্রেম! প্রেমের খেলায় রোহিনী গত ১২ এপ্রিল মমতার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাকে আটকে রেখে বিয়ে দেয় মমতার পরিবারের লোকজন।
মিডিয়ায় নতুন খবরে বলা হয়, ‘ডিভোর্স হয়েছে।’ কীভাবে হলো? বাংলাদেশে বিদ্যমান হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের কোনো সুযোগ নেই। একজন মেয়ে যদি একবার কোনো পুরুষকে বিয়ে করে– সেই পুরুষ যদি দুর্বৃত্ত, লুচ্চা, অত্যাচারী হয় এবং এমনকি চোর-ডাকাত বা দস্যুও হয়– তার সঙ্গে মতের অমিল হলেও নারীকে সারাজীবন ওই পুরুষের সেবা করে যেতে হবে।
এমনকি বিয়ের পর যদি প্রমাণিত হয় ওই পুরুষটি সম্পূর্ণরূপে যৌনসামর্থ্যহীন– ছেলেটি যদি মদ্যপ, হেরোইন খোর কিংবা পাগল হয়; সে যদি বাসায় না থেকে ফুটপাতে পড়ে থাকে– তবুও ওই পুরুষকেই ধ্যানজ্ঞান করে বাকি জীবন কাটাতে হবে নারীকে। কারণ এই বিবাহ অবিভাজ্য– অর্থাৎ বিভক্ত হওয়া অসম্ভব– এটা ধর্মের বিবাহ। যদিও ধর্মের নির্দেশ এরকম নয়।
পরাশর সংহিতায় ভগবান বলেছেন,‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্যো বিধিয়তে।’
Advertisement
এর অর্থ হলো, স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে (অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যায়) ক্লিব (পুরুষত্বহীন) হয় অথবা পতিত (ধর্ম বা সমাজ থেকে বিচ্যুত) হয় –এই পাঁচ প্রকার বিপদ উপস্থিত হয় তবে নারীর জন্য অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধেয়। গরুড় পুরাণের প্রথম খণ্ডের ১০৭ নম্বর অধ্যায়ের ২৮ নম্বর শ্লোকেও হুবহু একই কথা বলা হয়েছে।
এরকম বিধান বৈদিক অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থেও আছে। ইংরেজরা হিন্দু আইন বানানোর সময় এই ধর্মীয় বিধান লংঘন করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মের বিধানকে উপেক্ষা করে তৎকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক প্রথা এবং রঙ্গশালায় নটী ও ঘরে রক্ষিতাপালক সামন্তপ্রভুদের এবং তাদের সহযোগী পণ্ডিত শ্রেণির সমর্থনে অবিভাজ্য বিয়ের বিধান যুক্ত করে হিন্দু আইন বানিয়েছিল।
ওয়ারেন হেস্টিংয়ের আমলে ১৭৭২ সালে ইংরেজরা হিন্দু আইন প্রবর্তন শুরু করলেও সেখানে বিচ্ছেদের কোনো আইনই ছিল না। তবে ইংরেজরা ভারত থেকে বিদায় নেওয়ার অল্পকিছু দিন আগে ১৯৪৬ সালে ‘The Hindu Married Women's Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946’ শিরোনামে একটি আইন প্রণয়ন করে। সেই আইনটি বাংলাদেশে এখনো চলছে। ভারতে নতুন আইন হয়েছে এবং বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
ব্রিটিশের সেই আইন অনুযায়ী কোনো হিন্দু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক খুব খারাপ হলে এবং তাদের একসঙ্গে বসবাস করা অসম্ভব বলে আদালতের সামনে প্রতীয়মান হলে নারীকে আলাদা বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে আলাদা বাস করলেও স্ত্রীকে খোরপোষ দিতে স্বামী বাধ্য। মাসে মাসে কত দিতে হবে আদালত সেটা নির্ধারণ করে দেয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এভাবে সেপারেশন হলেও তারা কি স্বামী-স্ত্রী বজায় থাকবে? নাকি আদালতের আদেশের পর স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের অবসান হবে? না, তাতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না। বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না; বিবাহ অটুট থাকে। শুধুই নারীর একাকী বসবাসের বিধান! ওই স্বামীর স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েই মেয়েটিকে সারাজীবন বাঁচতে হবে। শুধু তাই নয়, তাকে সতী-সাধ্বী হয়ে সারাজীবন চলতে হবে। সেই পরীক্ষায় ফেল করা চলবে না। কোনো কৌশলে কলঙ্ক আরোপ করা গেলে ভরণ-পোষণ বন্ধ। এই ভরণ-পোষণ দেওয়ার দায় থেকে বাঁচার জন্য তার কথিত পতিধন তাকে অসতী প্রমাণ করার জন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নেবে না– তার নিশ্চয়তা কেউ অবশ্য দিতে পারে না। এক্ষেত্রে মেয়ের অন্যত্র বিয়ে করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
তবে স্বামীকে সৎ বা সাধুপুরুষ হয়ে চলতে হবে– এমন কোনো বিধান নেই। ছেলে ইচ্ছে করলে আরও বিয়ে করতে পারে, বাসায় ভাড়াটে নটী, উপপত্নী বা রক্ষিতা রাখতে পারে, চাইলে যৌনপল্লীতে যাতায়াত করতে পারে – কোনো বাধা নেই। সতী হয়ে বাঁচতে হবে নারীকে।
এখন প্রশ্ন হলো, আইন না থাকা সত্ত্বেও আলোচ্য ঘটনায় ডিভোর্স হলো কীভাবে? আসলে আইনকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারগুলোতে এধরনের গোপন বিবাহ বিচ্ছেদ অহরহ হচ্ছে। বাস্তবতার নিরীখে এবং জীবনের প্রয়োজনে হচ্ছে। সমঝোতার মাধ্যমে বেআইনি পন্থায় একটা রফা হচ্ছে। মানুষের বিবাহ বিচ্ছেদ নেওয়ার অধিকার আছে। হিন্দু আইন সেই অধিকারকে অস্বীকার করলেও সমাজে ‘বিচ্ছেদ আইনে’র চাহিদা আছে – এ ঘটনাগুলোই তার প্রমাণ।
আলোচ্য ঘটনায় অনেকগুলো বৈপরিত্য আছে। প্রথমত এটা কোনো আইনগত ডিভোর্স নয়; সুযোগ নেই। স্বতন্ত্র বসবাসের সুযোগ থাকলেও তা আদালতের মাধ্যমে হতে হয়। এক্ষেত্রে এটা সেরকম সেপারেশনও নয়। তাহলে বিষয়টি কেমন দাঁড়ালো? যদি আদালতের মাধ্যমে তারা আনুষ্ঠানিক সেপারেশন নিতে চায় তাহলে এই মেয়েটিকে সারাজীবন সতীত্বের প্রমাণ দিয়ে স্বামী থেকে দূরে আলাদা বাস করতে হবে। সে কখনই দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। নতুন করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে সেটা বেআইনি হবে। বিয়ে করতে হলে অপরিষ্কার পথেই করতে হবে।
এই সমাজে মেয়েটির ভালো কোনো জায়গায় পাত্রস্থ হওয়াও কঠিন আছে। আইনের চোখে এবং সমাজের চোখে সে হবে দ্বিচারিণী। নারী-নিপীড়নতান্ত্রিক সমাজে কয়জন আছে যারা দরদ দিয়ে ভাববে, এই মেয়েটি একজন মানুষ? রক্তে মাংসে গড়া দোষেগুণে মেশানো একজন মানব সন্তান।
মেয়েটির পরিণতি আরেক দিক থেকে চিন্তা করুন। তার কোনো আর্থিক সুরক্ষা নেই। কারণ হিন্দু আইন অনুযায়ী নারী হয়ে জন্মানোর কারণে সে বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। স্বামীর কাছ থেকেও কিছুই পাবে না।
এ ধরনের ঘটনায় মেয়েরা সবাই প্রতিকারহীন ভিকটিম। বিবাহ বিচ্ছেদের প্রশ্নে আইনগত শূন্যতার বাস্তবতায় ভিকটিমরা অনেক সময় উকিলের পরামর্শে আইনের আরেক ধরনের অপলাপ ঘটায়। সেটা হরো সরাসরি যেহেতু কোনো প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ নেই, সুতরাং ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের মামলা অথবা যৌতুকের মামলা দিয়ে ফাঁদে ফেলানো। এছাড়া তাদের কাছে কোনো আইনি উপায় নেই। এসবই আইনহীন অসুস্থ রাষ্ট্র ও অসুস্থ সমাজের লক্ষণ।
লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।ghatack@gmail.com
এইচআর/ফারুক/এএসএম