মতামত

পি কে হালদারের গডফাদারদেরও ধরা হোক

শনিবার বিকেলে হঠাৎ করেই নিউজরুমে তোলপাড়- বাংলাদেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার করে হাওয়া হয়ে যাওয়া পি কে হালদার কলকাতায় গ্রেপ্তার। দ্রুত খবরটি নিশ্চিত করা, কলকাতার সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ, পি কে হালদারের অতীত কুকীর্তির বয়ান তৈরির মাধ্যমে প্রাথমিক ঝড় সামাল দেয়ার পর এটিএন নিউজের অন্যতম চিফ রিপোর্টার আরাফাত সিদ্দিকী সোহাগের সাথে গল্প হচ্ছিল।

Advertisement

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগ রয়েছে। আরাফাতের আফসোস, একজন মানুষের কয় টাকা লাগে? ১০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে একজন মানুষ এক জীবনে কী করতে পারে? বিস্ময়টা আমারও। আসলেই এক জীবনে একজন মানুষের কয় টাকা লাগে! আমি আরাফাতকে বললাম, মানুষ সবসময় প্রয়োজনে টাকা উপার্জন করে না। বিল গেটসের যে লাইফস্টাইল, তাতে তার সম্পদের কোটি ভাগ কম হলেও চলে যেতো। কিন্তু তবু তিনি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেন এবং মানবকল্যাণে বিলিয়ে দেন।

দিনের পর দিন একই টি-শার্ট পরে কাটিয়ে দেয়া মার্ক জুকারবার্গ বা একটি বাড়ি বানানোর সময় করে উঠতে না পারা ইলন মাস্কেরও অত টাকার দরকার নেই। তবু মানুষ অর্থ উপার্জন করে। বাংলাদেশে বসুন্ধরা, যমুনার মত বড় বড় গ্রুপগুলোর হাজার কোটি টাকা আছে, আরো অর্থ আসছে। তবুও তারা থেমে যায় না। তারা ব্যবসা চালিয়ে যায়, ব্যবসা করলে টাকা আসবেই।

তাদের ব্যবসায় হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়, দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয়, প্রবৃদ্ধি বাড়ে। কিন্তু পি কে হালদারদের বা ডেসটিনির রফিকুল আমিনের মত চোরেরা হাজার কোটি টাকা দিয়ে কী করে? রফিকুল আমিন অনেকদিন ধরেই কারাগারে। সম্প্রতি তার ১২ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। পি কে হালদার পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন দেশে কয়েকবছর পালিয়ে থেকে কলকাতায় আস্তানা গেড়েছিলেন।

Advertisement

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেছিলেন পি কে হালদার। সবচেয়ে বেশি করেছিলেন ভারতে। সেখানে পিকে হালদার এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বিপুল সম্পত্তি করেছিলেন এবং নাম পাল্টে ভারতের নাগরিকত্বও নিয়েছিলেন। কিন্তু যে বাড়ি থেকে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটি ১০ হাজার কোটি টাকার মালিকের মত নয়।

আরাফাতের প্রশ্নটি আমার মনেও বারবার আসছে, এক জীবনে মানুষের কয় টাকা লাগে। আর টাকা যদি উপভোগই করা না যায়, যদি চোরের মত পালিয়েই থাকতে হয়; তাহলে সেই টাকা চুরি করে লাভ কী? শেষ পর্যন্ত আমরা দুজন আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, টাকাটা সবসময় মানুষ প্রয়োজনে চুরি করে না, এটা মানুষের স্বভাব। টাকা উপার্জন আসলে নেশার মত। তবে অর্থ উপার্জন আর চুরি এক নয়।

আপনি মেধা দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে, ব্যবসা করে হাজার কোটি টাকা উপার্জন করতে পারেন, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সবাই যদি শুধু নিজের প্রয়োজনেরটুকু উপার্জন করে বসে থাকতো, তাহলে বিশ্বের অগ্রগতি হতো না, অর্থনীতি অচল হয়ে যেতো। আপনি বৈধ উপায়ে হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেন, তাতে লাখো লোক উপকৃত হবে। কিন্তু পি কে হালদারের মত লোকেরা যখন লাখো লোকের টাকা মেরে দিয়ে পালিয়ে যায়, তখন ধস নামে অর্থনীতিতে।

পি কে হালদারের প্রতিভা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। তিনি বুয়েটে পড়াশোনা করেছেন, পরে আবার ব্যবসা প্রশাসনও পড়েছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পি কে হালদারের মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করতেন। একজন শিক্ষকের এমন মেধাবী সন্তান কীভাবে এমন জালিয়াত হলো, সেটা একটা বিস্ময় এবং গবেষণার বিষয় হতে পারে। আর পি কে হালদার একা নন, তিনি তার গোটা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে জালিয়াতির জাল বিছিয়েছেন।

Advertisement

একের পর ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছেন এবং ধ্বংস করেছেন। জালিয়াতি এবং পাচারের ব্যাপারে পি কে হালদার যুগ যুগ ধরে উদাহরণ হয়ে থাকবেন। আমার খালি আফসোস, পি কে হালদার যদি তার মেধা এবং বুদ্ধি ভালো কাজে লাগাতেন দেশের ব্যাংকিং খাত কতই না উপকৃত হতে পারতো।

মূলত বাংলাদেশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ভারত সরকার পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে এবং তাকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রাথমিকভাবে অনানুষ্ঠানিক সূত্রে জেনেছিলাম, ভারত সরকার পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করবে না এবং সীমান্ত এলাকা দিয়ে পুশব্যাক করবে, যাতে বাংলাদেশ তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা চলমান রাখতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে এবং পি কে হালদার গং ভারতে এত বেশি আইন ভঙ্গ করেছে, ভারত সরকারের পক্ষে বিষয়টি গোপন রাখা সম্ভব ছিল না।

পি কে হালদার এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কীভাবে ভারতের পাসপোর্ট, আধার কার্ড, রেশন কার্ড পেলো; এটা নিশ্চয়ই ভারতের লোকজনও জানতে চাইবে। তাদের নিরাপত্তার জন্যও এটা হুমকি। তবে পি কে হালদারের শাস্তি এবং তার গডফাদারদের নাম জানার জন্য তাকে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনাটাও জরুরি।

পুশব্যাক করে ফেরত পাঠানোটা যত সহজ ছিল, ভারতের আইনী প্রক্রিয়া শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত পাঠানো ততটা সহজ হবে না। তবে আশা করি বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করে যত দ্রুত সম্ভব পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবে। কারণ শুধু পি কে হালদারকে ধরলেই হবে না, তার গডফাদার এবং সহযোগীদেরও চিহ্নিত করতে হবে এবং ধরতে হবে।

পি কে হালদার তো আর একা একদিনে ১০ হাজার কোটি টাকা চুরি করেননি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এস কে সুর এবং শাহ আলমের নাম এসেছে। কিন্তু আমার ধারণা আরো কোনো গডফাদার তার ছিল, যার প্রশ্রয়ে এবং সহযোগিতায় পি কে হালদার বছরের পর বছর জালিয়াতি চালিয়ে যেতে পেরেছে। সময় এসেছে, সকল গডফাদারদের মুখোশ উন্মোচনের।

কলকাতায় পি কে হালদারের গ্রেপ্তারে একটা বিষয় পরিস্কাষ্কার হয়েছে, টাকা মেরে দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন, চুরি করলে ধরা পড়তেই হবে। পি কে হালদারের পরিণতিতে যদি অন্য চোরেরা সতর্ক হয়, তবেই আপাতত মঙ্গল।১৫ মে, ২০২২

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জিকেএস