মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে ক্রিকেট বিশ্বের ব্যস্ততম ভেন্যু বললে ভুল হবে না। অথচ ক'দিন আগেই বিসিবির গ্রাউন্ডস কমিটির প্রধান মাহবুব আনাম বলছিলেন, আদর্শ পরিস্থিতিতে মিরপুরে বছরে ৬০ দিন খেলা উচিত। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিস্থিতি আদর্শ নয়, সে কারণেই হয়তো এ বছরের প্রথম চার মাসের মধ্যেই মিরপুরে ৩৫ দিন খেলা হয়ে গেছে। দেশের হোম অব ক্রিকেটের অশেষ ব্যস্ততার ছবিটা এমনই।
Advertisement
মিরপুর স্টেডিয়ামের ব্যস্ততার এই আলোচনা অনেকদিনের। কিন্তু একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে, শুধু মিরপুরই নয়, ব্যস্ততার কমতি নেই দেশের বেশিরভাগ স্টেডিয়ামেরই।
আন্তর্জাতিক খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মিরপুরের কথা হয়তো শোনা যায় বেশি। কিন্তু সারা বছর খেলার ব্যস্ততার কথা ধরলে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামও মিরপুরকে ছাড়িয়ে যাবে।
দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না হলেও স্থানীয় খেলাধুলার ব্যস্ত সূচিতে বছরের প্রায় পুরোটা সময় চাপে জর্জরিত থাকে দেশের প্রথম টেস্ট জয়ের ঐতিহাসিক এ ভেন্যুটি। বিভাগীয় শহরটিতে ভালো মাঠের অভাবে ‘সর্ব কাজের কাজী’ হয়ে গেছে এই এমএ আজিজ স্টেডিয়াম।
Advertisement
ক্রিকেট, ফুটবলের পাশাপাশি হকি, হ্যান্ডবল, কাবাডি, অ্যাথলেটিক্সসহ চট্টগ্রামের সব খেলার আশ্রয়স্থল যেন এই একটি মাঠ। গত শনিবারই যেমন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে যখন প্রথম টেস্টের আগে শেষ দিনের অনুশীলন করছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, তখন এমএ আজিজে চলছিল বিভাগীয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান।
এরপর রোববার থেকে শুরু হয়ে গেছে তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট। চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট- নিয়মিত চারটি ক্রিকেট লিগ চলে এই মাঠে। পাশাপাশি ক্লাব লিগের খেলাও হয় এই মাঠে।
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম ব্যস্ত থাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও বিসিবির বিভিন্ন প্রোগ্রামে। তাও অনেক বলে-কয়ে স্থানীয় ক্রিকেটের জন্য সর্বোচ্চ ১৮-২০ দিন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম ব্যবহারের সুযোগ পায় স্থানীয় আয়োজকরা।
ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলের ব্যস্ততাই বেশি এমএ আজিজে। চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ফুটবল, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগের পাশাপাশি শেখ কামাল ফুটবল টুর্নামেন্ট, আন্তঃজেলা মেয়র কাপ, উপজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের সব খেলার ঠাই নিজের বুকেই দেয় এই মাঠ।
Advertisement
শুধু কি ক্রিকেট আর ফুটবল? হকি, কাবাডি, ভলিবল, হ্যান্ডবল, অ্যাথলেটিক্সেরও নানান ইভেন্ট হয়ে থাকে এই মাঠে। এত সব খেলাকে এক সঙ্গে জায়গা দেওয়ার, চ্যালেঞ্জ হয় জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিন শামিম যেমন বলছিলেন, ‘অনেক সময় এমন হয়ে যায় যে সকালে কাবাডি খেলা হচ্ছে, বিকেলে আবার ফুটবল চালাতে হচ্ছে। হকি আর ফুটবলের জন্য দুই পাশে আলাদা জায়গা করে একই দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে খেলা চালাতে হয়।’
গতবছর দিনে ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি, বিকেলে ফুটবল আর রাতে ফ্লাডলাইটের নিচে হয়েছে হকির ম্যাচ। এভাবে একইদিনে ভিন্ন ভিন্ন খেলার চাহিদা থাকায় সব দিক ঠিক রেখে সূচি বানানোটাও বড় চ্যালেঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার জন্য। যা নিয়ে হতাশা রয়েছে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যেও।
আর একই মাঠে ভিন্ন ভিন্ন সব খেলার কারণে আউটফিল্ডের অবস্থা যাচ্ছেতাই। জায়গায়-জায়গায় ঘাস উঠে গিয়ে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা দেখা দেয় এ মাঠে। যা নিয়মিতই খেলোয়াড়দের নানা ইনজুরির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এখানেই শেষ নয়। খেলাধুলা ছাড়াও এমএ আজিজ প্রাঙ্গন প্রায় সারাবছর ব্যস্ত থাকে কর মেলা, উন্নয়ন মেলা, বিজয় মেলাসহ নানান মেলার আয়োজনে। স্টেডিয়ামের মূল মাঠের ঠিক বাইরেই রয়েছে জেলা ক্রীড়া সংস্থার আউটার স্টেডিয়াম। সেই মাঠটি যেন সারাবছরই বরাদ্ধ থাকে এসব মেলা নিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠানও নাকি হয়েছে আউটার স্টেডিয়ামে।
অথচ সেই আউটার স্টেডিয়ামটিতে একসঙ্গে অনুশীলন করে কমপক্ষে ২০০টি ক্লাব। ছোট্ট একটি আউটার স্টেডিয়ামে ২০০ ক্লাবের একসঙ্গে অনুশীলনে স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয় সময়স্বল্পতা। সেটি যদি পুরোপুরি পাওয়া যেতো, তাতেও হয়তো নিজেদের স্কিল বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে পারতেন উঠতি খেলোয়াড়রা।
কিন্তু সারাবছর ধরে এই-সেই মেলার কারণে সেটিও নিয়মিত সম্ভব হয় না। কারণ একেকটি মেলার পর ইট-বালির পাশাপাশি খুঁড়ে রাখা গর্তের কারণে অন্তত দেড়-দুই মাস স্বাভাবিক অনুশীলন করা যায় না মাঠটিতে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিরাজউদ্দীন মো. আলমগীরের কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশার ছাপ, ‘এখানের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের জন্য যথেষ্ট জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়া যাচ্ছে না। মানসম্মত লিগও আয়োজন করা যাচ্ছে না। যত বেশি লিগ এখানে চলছে, তাতে যে পরিমাণ ভালো খেলোয়াড় উঠে আসার কথা, তা কিন্তু হচ্ছে না। কারণ কোনো টুর্নামেন্টের জন্য অনুশীলনের যথাযথ সময় বা সুযোগ আসলে পাচ্ছে না ক্লাবগুলো।’
এমনিতেই শহরে মাঠের সংকট, তার ওপর এসব মেলার আয়োজন যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়েই আসে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার ওপর। দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদ। কিন্তু উর্ধ্বতন মহল থেকে এসব মেলার অনুমতি থাকায় তাদের পক্ষে আসে না কোনো সিদ্ধান্ত।
খেলার মাঠে শুধু খেলা চালানোর সেই পুরোনো দাবিই নতুন করে জানিয়ে আলমগীর বলছিলেন, ‘বাংলাদেশের খেলাধুলার অন্যতম অন্তরায় খেলার মাঠে এই অন্যান্য আয়োজন। এসবের কারণে আমাদের ক্রীড়াঙ্গন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধুমাত্র যথেষ্ট মাঠের অভাবে জাতীয় পর্যায়েও এখন মানসম্মত খেলোয়াড় পাওয়া যায় না।’
স্থানীয় ক্রীড়াপ্রেমী সাজ্জাদ আহমেদ নিয়মিতই খেলা দেখেন এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে বসে। প্রায় সব খেলারই খবর রাখেন তিনি। কিন্তু একই মাঠে এতোকিছুর আয়োজন তার মনেও জন্ম দিয়েছে বিতৃষ্ণার, ‘চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন শেষই বলা যায়। একই মাঠে এতো খেলা! অন্য কোনো মাঠে খেলা সরিয়ে নিয়ে এমএ আজিজের ওপর চাপ কমানো এখন সময়ের দাবি।’
অবশ্য এমএ আজিজের ওপর চাপ কমানোর জন্য মাঠ বাড়ানোর পরিকল্পনা যে করা হয়নি, তা নয়। বিসিবি সিনিয়র পরিচালক ও সহ-সভাপতি আ জ ম নাসিরের তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে মাঠের জন্য বেশ কয়েকটি জমিও দেখা হয়েছে। কিন্তু বাজেটস্বল্পতায় সে বিষয়ক আলোচনাও থেমে আছে তেমন কোনো অগ্রগতি ছাড়াই। শিগগিরই কাটবে জটিলতা, স্বস্তি মিলবে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের- এমনটাই প্রত্যাশা জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার।
শেষ করা যাক, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মুখে মুখে প্রচলিত একটি কথা দিয়ে। যার আড়ালে যতটা না আছে রসিকতা তার চেয়ে বেশি আছে অনুযোগমাখা ভয়াল এক ভবিষ্যদ্বাণী, ‘হয়তো এই মাঠের অভিশাপেই অধঃপতন ঘটবে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনের।’
কে জানে, এত দিনে নিজের আত্মকথায় এমএ আজিজ স্টেডিয়াম বিশাল একটা অধ্যায় হয়তো লিখেছে কেবল সেই ‘অভিশাপ’দিয়েই।
এসএএস/আইএইচএস