মতামত

বুদ্ধপূর্ণিমা: অটুট থাকুক ধর্মীয় সম্প্রীতি

আজ ১৫ মে। বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব তথা গৌতম বুদ্ধের জন্মোৎসব শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। আজকের দিনটি দেশের বুদ্ধধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এদিনে বুদ্ধধর্মের প্রবর্তক মহামানব গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে (নেপালে) জন্মগ্রহণ করেন, বুদ্ধত্ব লাভ (বুদ্ধগয়া) এবং মহাপরিনির্বাণ (কুশিনগরে) লাভ করেন। তাই ত্রিস্মৃতিবিজড়িত দিনটি বুদ্ধদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

সমস্ত বাধা ও অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে এমনি এক বৈশাখী পূর্ণিমার তিথিতে বুদ্ধ আলোক উদ্ভাসিত হয়ে ‘বুদ্ধত্ব’ লাভ করেন। আর তখন পরম উচ্ছ্বাসে, পরম আনন্দে ব্যক্ত করেছিলেন এই উদান গাথা-“জন্ম জন্মান্তর পথে ফিরিয়াছি, পাইনি সন্ধান,/সে কোথা গোপনে আছে, এ গৃহ যে করেছে নির্মাণ।/পুনঃপুনঃ দুঃখ পেয়ে দেখা তব পেয়েছি এবার,/হে গৃহকারক! গৃহ না পারিবে রচিবারে আর;/ভেঙ্গেছে তোমার স্তম্ভ, চুরমার গৃহ ভিত্তিচয়, সংস্কার বিগতচিত্ত, তৃষ্ণা আজি পাইয়াছে ক্ষয়।”

ব্রিটিশ লাইব্রেরি ব্লগের মতে, “প্রতিটি পূর্ণিমার দিন বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি শুভ দিন, তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল মে মাসের পূর্ণিমার দিন, কারণ এই দিনে গৌতম বুদ্ধের জীবনের তিনটি প্রধান ঘটনা ঘটেছিল। দিন. প্রথমত, বুদ্ধ-হওয়া, যুবরাজ সিদ্ধত্থ মে মাসে পূর্ণিমার দিনে লুম্বিনী গ্রোভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, ছয় বছর কষ্টের পর, তিনি বোধিবৃক্ষের ছায়ায় জ্ঞানলাভ করেন এবং মে মাসের পূর্ণিমা তিথিতেও বোধগয়াতে গোতম বুদ্ধ হন। তৃতীয়ত, ৪৫ বছর সত্য শিক্ষা দেওয়ার পর, যখন তিনি আশি বছর বয়সে, কুশিনারায়, তিনি মে মাসের পূর্ণিমা দিনে, সমস্ত কামনার অবসান ঘটিয়ে নিব্বাণে চলে যান।”

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে। যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এটাই ধর্মের শিক্ষা।

Advertisement

মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাইতো তিনি লিখেছেন, গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।’ তিনি লিখেছিলেন ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের সাথে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের দৃষ্টান্তই আমরা লক্ষ্য করে আসছি। আমরা আশা করব এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী সবার মাঝে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন থাকবে অটুট-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

কে কোন ধর্মের অনুসারী তা মূল বিষয় নয়, বিষয় হল আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক জাতি। আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে আরেক জন একমত নাও হতে পারে, তাই বলে কি তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ রাখার নির্দেশ কোন ধর্ম দেয়?

চামড়ার রং, ধন-সম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদির দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না। মর্যাদা ও সম্মানের সঠিক মাপকাঠি হলো ব্যক্তির উচ্চমানের নৈতিক গুণাবলী এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি তার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা। বিশ্বমানব একটি পরিবার বিশেষ। জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলী দ্বারা একে অপরের উপকার সাধিত হতে পারে।

Advertisement

ত্রিপিটকে উল্লেখ আছে, জগৎ অনাচার, পাপাচারে নিমজ্জিত হলে জগতের কল্যাণে এবং মানুষকে জীবনের সঠিক পথ দেখাতে জীবের দুঃখমোচনে সম্যক সম্বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। ভারতবর্ষে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জাত-পাতের চরম বৈষম্য, ধর্মের নামে প্রাণযজ্ঞ আর হিংসায় মানুষ যখন মেতে উঠল, মানুষকে আলোর পথ দেখাতে বুদ্ধ ধরায় এসেছিলেন। তিনি মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর সাধনা ও সুখ কামনা ছিল সব প্রাণির জন্য।

বুদ্ধ নীতিশাস্ত্রের মূলভিত্তি হলো পঞ্চশীল। বুদ্ধগৃহীদের জন্য শীল পালনে গুরুত্বারোপ করেন। পঞ্চশীলে বলা হয়েছে, প্রাণি হত্যা থেকে বিরত, চৌর্যবৃত্তি না করা, মিথ্যা কথা থেকে বিরত, অবৈধ কামাচার হতে বিরত থাকা এবং কোনো ধরনের নেশাদ্রব্য সেবন না করা। যেকোনো ধর্মের মানুষের নৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য এ কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হয়।

একে অপরের সাথে প্রেমময় ও ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছেন বুদ্ধ। বুদ্ধের মতে, ‘যুদ্ধে শত সহস্রজনকে জয় করার চেয়ে আত্মজয়ই শ্রেষ্ঠ জয়।’ স্বীয় চিত্তকে দমন করতে না পারলে আত্মজয় সহজ কাজ নয়। এটাই বুদ্ধের শিক্ষা। মানুষ হতে হলে আত্মকেন্দ্রিকতার খোলস থেকে বেরিয়ে সবার মঙ্গল এবং হিতের কথা ভাবতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে হৃদয় দিয়ে। তার এই ভালোবাসার বৈশিষ্ট্য মানব জাতিকে নৈরাজ্য থেকে থেকে রক্ষা করতে পারে| মূলত প্রতিটি ধর্মই শান্তি ও ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। কেউ যখন তার নিজ ধর্মের অনুসরণ ও শিক্ষা পরিত্যাগ করে তখনই তার দ্বারা অপকর্ম সংঘটিত হতে থাকে।

আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের সাথে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের দৃষ্টান্তই আমরা লক্ষ করে আসছি। আমরা আশা করব এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না।

ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী সবার মাঝে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন থাকবে অটুট-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বুদ্ধ ধর্মাবলম্বী সকলের প্রতি রইল বুদ্ধপূর্ণিমার শুভেচ্ছা।

এইচআর/এমএস