১২ মে ‘প্রথম আলোয়’ দেশের অর্থনীতি বিষয়ক কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছ, যা পড়ে প্রতিটি সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিকের মন খারাপ হয়ে যাবে। সাধারণ জনগণ গণমাধ্যমেই সব খবরাখবর জানতে পারে এবং বিশ্বাস রাখতে চায়। কোন তথ্য সত্য আর কোন তথ্য অসত্য-তা যাচাই করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই।
Advertisement
এসব সংবাদের সত্যাসত্য জানার অধিকার জনগণের আছে। তাই আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, দেশের অর্থনীতিতে এসব অশনিসংকেত কী কারণে হচ্ছে, গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে কি না- তার প্রকৃত চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবারের ‘প্রথম আলোর’ প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনাম করেছে ‘টাকা আরো দুর্বল হচ্ছে’। মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটা ভালো আছে, তারই ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে গত বছর এবং চলতি অর্থবছরের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির এক চিত্রে দেখানো হয়েছে, আমদানি ব্যয় লাগামহীনের ক্ষেত্রে গত অর্থবছর ছিল ১৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, এবার প্রবৃদ্ধি ৪৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
বাণিজ্য ঘাটতি গতবার ছিল ১,২৩৬ কোটি ডলার, এবার বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২,২৩০ কোটি ডলার। প্রবাসী আয় কমতেই আছে। গত অর্থবছর ছিল ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ আর এবার কমে হয়েছে (-)১৬ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি আয়ে এবার রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি হয়েছে, ১,৪০৭ কোটি ডলার, যা গত বছর ছিল ৫৫ কোটি ডলার। এই তথ্য অবশ্যই উদ্বেগের।
Advertisement
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রথম আলো বলেছে,‘আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের জোগান দিতে গিয়ে মাত্র পাঁচ মাসের আমদানি বিল পরিশোধের রিজার্ভ আছে। পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকলে বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠবে’। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, ‘রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি। এজন্য ডলারের দাম বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সারাদেশে’।
ফলে রিজার্ভে টান পড়ছে, ডলারের দর বৃদ্ধি পাচ্ছে, টাকার মূল্যমান কমছে। এর জেরে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে বাজারে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রথম আলোর খবরে বলা হচ্ছে, বাস্তবতার নিরিখে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তন্মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর স্থগিতসহ কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন বন্ধ করেছে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে লাগাম টেনেছে। এই খবর তো দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।
প্রথম পাতায় আরেকটি খবরের শিরোনাম হলো ‘আন্তর্জাতিক লেনদেন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিপদ বাড়ছে’। এই খবরের মূল বক্তব্য হলো, দেশের অর্থনীতিতে যে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে তার ফলে চলতি আয়ের ভারসাম্যে যে ঘাটতি, তা দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেন নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকেও এখন ভাবতে হচ্ছে। এই তথ্যও উৎকণ্ঠ জাগায়।
এই পত্রিকার প্রথম পাতার আরেকটি শিরোনাম হলো, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ডিএফসি তহবিলের সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ’।ডিএফসি হলো যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। খবরে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার USAID- এর উপ-প্রশাসক ইসোবেল কোলম্যান শ্রম অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, জিএসপি স্থগিত থাকায় ডিএফসির অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
Advertisement
প্রসঙ্গত কোনো দেশে ডিএফসির অর্থায়নের ক্ষেত্রে সে দেশের পরিবেশ, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের উচ্চমান নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না, তা তারা বিবেচনায় নেয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসওর উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকা বলেছে, ‘বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নের জন্য আদর্শ উৎস হতে পারে ডিএফসি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়টি হচ্ছে, জিএসপি ফিরে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত ডিএফসির অর্থায়নের জন্য বিবেচিত হবে না বাংলাদেশ’। এই খবরটিও উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো।
ওই তারিখের প্রথম আলোর ৩ এর পাতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি কেনা নিয়ে ‘৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতির’ আরেকটি বিশেষ প্রতিবেদন রয়েছে। টিআইবির এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরিশালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়ির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে ৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
পত্রিকান্তরে টিআইবি বলেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সুশাসনের ঘাটতি প্রকট। প্রয়োজন না থাকলেও প্রভাবশালী মহলকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। টিআইবি আরও বলেছে, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দাতাদের কাছে বাংলাদেশ জিম্মি হয়ে গেছে। অথচ নবায়ণযোগ্য জ্বালানির প্রসারে সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না’। এখানেও বিষয়টি উদ্বেগের।
প্রথম আলোয় দেশের অর্থনীতি বিষয়ক শুধু ‘একটি দিনের’ প্রকাশিত সংবাদ আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক সুজিত রায় তার ‘সংবাদ সাংবাদিক সাংবাদিকতা’ বইয়ে বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদ মাধ্যমগুলোই প্রকৃত বিচারকের মানদণ্ড হাতে তুলে নেয়। সবরকম সামাজিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অন্যায় ও অবিচারের প্রতি দৃষ্টিপাত এবং তার মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলে শাসনযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এক অমোঘ অস্ত্র এই সংবাদ মাধ্যম।
বাক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায়, সাংবিধানিক নিয়মনীতি সমন্বিত মৌলিক বিষয়গুলো সঠিকভাবে রূপায়িত করার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা এই সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রধান কাজ। পাশাপাশি সমাজের যা কিছু ভালো, সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে সেগুলোকেও তুলে ধরা সাংবাদিকতার অন্যতম শর্ত’। বোদ্ধাজনরা বলেন, সাংবাদিকতা সমাজের দর্পণ। কিন্তু আদর্শ এবং নীতিবর্জিত সাংবাদিকতা কখনই সমাজের দর্পণ হতে পারে না। তবে সমাজ যদি নীতিবহির্ভূতভাবে চলে, তার ছাপ তো সাংবাদিকতা নামক দর্পণে পড়তে বাধ্য।
পবিত্র সংবিধান আমাদের চিন্তার, বিবেকের এবং বলার স্বাধীনতা দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতারও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে সংবিধানে। কিন্তু স্বাধীনতার নামে যারা বিভ্রান্তিকর এবং হলুদ সাংবাদিকতা করার মাধ্যমে সমাজে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা,অস্থিরতা ছড়াচ্ছে-সেটা কখনও কাম্য নয়, বিবেচ্য নয়। অন্ধকার জগতের কাজ দিয়ে নয়, আমরা আলোর জগতের মানুষের কর্মযজ্ঞ দ্বারা আলোকিত সমাজ দেখতে চাই।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার (অব.) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।golamss636@gmail.com
এইচআর/ফারুক/এমএস