কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—
Advertisement
মানবমনের সহজাত প্রবৃত্তি (ইনস্টিংক্ট) হচ্ছে জীবনপ্রবৃত্তি (ইরোস) ও মরণপ্রবৃত্তি বা ডেথ ড্রাইভ (থেনাটোস)। ফ্রয়েডের মতে, ইরোস ইনস্টিংক্ট-এর আড়ালে আছে দেহভোগ কিংবা দেহ তৃপ্তির গোপন তাড়না বা গোপন ড্রাইভ, মানুষের সব ধরনের আচরণের শেকড় গেড়ে আছে ইরোসের মূলে, যৌনতৃপ্তিই সেই শেকড়ের স্ট্রং নিড বা দুর্বিনীত চাহিদা। কিন্তু বিতর্ক আছে। মানুষ এমন অনেক আচরণ করে যার সঙ্গে দেহতৃপ্তির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ফ্রয়েড যুক্তি দেখিয়ে বলেন, দুই ধরনের বিধিনিষেধের কারণে দেহতৃপ্তির আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ বিলম্বিত হয়, অথবা ভিন্ন ঢঙে বা পরিবর্তিত অন্য পথে লালিত গোপন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে।বিধিনিষেধের একটা হচ্ছে বাস্তবতা―‘রিয়ালিটি’। অন্যটা হচ্ছে নৈতিকতা―‘মোরালিটি’।আত্মধ্বংসী প্রবৃত্তির সঙ্গে যৌনপ্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, সংঘাত বাধে। এ কারণে ধ্বংসাত্মক তাড়নার প্রকাশ ঘটে অন্যের প্রতি সহিংস আচরণ বা অ্যাগ্রেশনের মধ্য দিয়ে।ফ্রয়েডের মতামত পরবর্তী সময়ে সবাই একশ ভাগ মেনে নেয়নি। বিতর্ক হয়েছে। হেনরি মুরে এবং আব্রাহাম মাসলো মনে করেন, সব মোটিভ শারীরবৃত্তীয়, চাহিদানির্ভর না। কিছু কিছু মোটিভ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় অর্জিত হয়। মাসলো মানুষের চাহিদাকে সাতটি প্রধান গ্রুপে ভাগ করেছেন, ধাপে ধাপে চাহিদাগুলোক সাজিয়েছেন। সর্বনিম্ন ধাপ হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় নিড এবং সবার ওপরে আছে পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তির চাহিদা।
এই উপন্যাসে আলোচিত মূল ও সমান্তরাল ধারার একটা চরিত্র মুনা। রিয়াকে উদ্ধারের জন্য গাড়িতে যাচ্ছে রেজা মামার পাশে বসে। এখানে রেজাকে দেখেছে সে পুরুষ হিসেবে। দেখেছে বলে শ্রদ্ধার বাইরেও অন্য অনুভূতি কাজ করেছে। এই অনুভূতির ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি সে। ‘মামা-বোধ’ হচ্ছে সামাজিক বাস্তবতা, নৈতিকশক্তি। এই শক্তি ভিন্ন মাত্রার চাহিদা অবচেতনেই প্রতিহত করেছে। মুনার মন ইরোসের বিপুল ইচ্ছার গতিকে নিজের অজান্তেই নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের আলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। উপন্যাসে মনে হয়েছিল মামার সঙ্গে অনৈতিক কিছু একটা ঘটবে। ঘটেনি। মামার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উত্তরোত্তর প্রকাশ পেয়েছে।কিন্তু এই অনৈতিক ও অবাস্তব সম্পর্ক বিরল না। ঘটছে সমাজে। যূথীর সঙ্গে তার মামার সম্পর্কটা নৈতিকতার দেওয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করে গেছে। তাই যূথী মামার প্ররোচনায় মামাকে দেখেছে একজন পুরুষ হিসেবে, মামা যূথীকে দেখেছে যৌবনবতী নারী হিসেবে। মামা তার নৈতিকতার শেকল ছিঁড়ে দিনের পর দিনে ভোগ করেছে যূথীকে। যূথীকে দিয়েছে বডিপ্লেজার―যৌনসুখ। এই প্লেজার যূথীর ব্রেইনে প্রোগ্রামড হয়ে গেছে, আসন গেড়ে বসেছে। যূথীর মাঝে ক্রেজ তৈরি হয়ে গেছে। দেহসুখের আশায় তার সময় পার হয়। আচরণে ঘূর্ণি তৈরি হয়। এই ঘূর্ণি বিনাশ করে ধর্মীয় অনুভূতি, নৈতিকতা। তারা এই নৈতিকতার ধার ধারে না। তাদের বাস্তবতা দেহভোগ, দেহসুখ―যৌনতা। ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা এ ক্ষেত্রে এক শত ভাগ সঠিক।মুনা ও রেজার মধ্যেও এমন সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। গড়ে ওঠেনি। কারণ রেজা নৈতিকশক্তিতে অনেক বেশি শক্তিমান। বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি তার অনেক বেশি প্রখর। তাই মুনা প্ররোচিত হয়নি। প্ররোচিত না হওয়ার কারণে মুনা বেঁচে গেছে। তবে মুনার ওই ধরনের মুগ্ধতা যে কোনো সম্পর্কের যে কোনো পুরুষ বুঝে যেতে পারে। বুঝে গেলে সে মেয়েদের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত করতে পারে, ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে।এটা কল্পনা না, কেবল সাহিত্যের ভাষা না। এই ভাষার গহিনে আছে বিজ্ঞান। পাঠক এই বিজ্ঞানচিত্র দেখতে পেলে শিক্ষণতত্ত্বের মূল অনুষঙ্গের বিষয়ে ধারণা লাভ করতে পারবে। উপন্যাসটা পাঠের মাধ্যমে এই অর্জিত শিক্ষা ভবিষ্যতে যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশে কাজে লাগাতে পারবে। এটাই হচ্ছে এই উপন্যাসের মোরাল।
রেজা চরিত্রের আরেকটা বড় ইস্যু আবর্তিত হয়েছে রিয়াকে ঘিরে। রিয়াকে উদ্ধারে সাহায্য করেছে রেজা। ভাগ্নির ফ্রেন্ড হিসেবে রিয়াকেও ভাগ্নিতুল্য মনে করেছে। রেজা মামাকে ঘিরে রিয়ার অতলে তৈরি হয়েছে মুগ্ধতা। শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসা। ক্রমান্বয়ে সেই ভালোবাসা জটিলতর হয়েছে। কমপ্লেক্স আবেগের জট তৈরি হয়েছে রিয়ার মনে। রিয়া এই মিশ্র আবেগের চাপে বিভ্রান্ত হয়েছে। আসলে নিজেকে পরিচ্ছন্নভাবে বুঝতে পারেনি রিয়া। রিয়া চরিত্রের এই বিভ্রমের আড়ালে আছে রেজার পৌরুষদীপ্ত আচরণ। এই আচরণের বিবর্তনের মধ্যে ছিল নৈতিকতাবোধ। বাস্তবতাবোধ।রেজার মধ্যে যদি কাতরতা থাকত, নারীঘেঁষা মনোভাব থাকত, যদি রিয়ার দেহের প্রতি লোভ দেখাত, তাহলে পুরুষ-চরিত্র বুঝে উঠতে পারত সে। পারেনি। কারণ রেজা তেমন কিছুই দেখায়নি। শুদ্ধ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। হাত বাড়িয়ে গেছে রিয়াদের বাসায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিশেছে রিয়ার সঙ্গে। রিয়ার মধ্যে ভালো লাগা তৈরি হলেও ভালো লাগার গতি-প্রকৃতি সে বুঝতে পারেনি। তবুও রিয়ার কোনো ক্ষতি হয়নি। রিয়া প্ররোচিত হয়নি। রিয়া মিসগাইডেড হয়নি। বরং রিয়ার আকর্ষণ রেজার প্রতি হয়েছে বেগবান।রেজার জীবনের কষ্টকর অধ্যায় শুনেছে রিয়া। চুপকথার বাসর রাতেই রেজাকে ছেড়ে যাওয়ার কাহিনি শুনেছে। জীবনের বেদনাদায়ক অধ্যায়টাকে অতি অসাধারণ সেন্টিমেন্ট নিয়ে মোকাবিলা করেছে রেজা। ফলে রেজার প্রতি রিয়ার ভালোবাসা আরও বেশি শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ মর্যাদা পেয়েছে। এই শ্রদ্ধাবোধই উপন্যাসের বড় একটা বিষয়। এখানে দেখা যায় শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয় রিয়া। কদমবুচি করে। বিপুল বিস্ময়ে রেজার জন্য অসাধারণ মমত্ববোধে ডুবে যায়। রেজার ছায়ায় রিয়া মূলত একধরনের নিরাপত্তা বোধ করে, নির্ভরতার ভিত দৃঢ় হয় রেজাকে ঘিরে।রেজার জন্য অ্যাশট্রে গিফট পাঠায় রিয়া। সিগারেট ছাড়ার ব্যবস্থাপত্র হিসেবে কাগজে লিখে দেয়, থ্যাংকস ফর নো স্মোকিং। রেজা ধূমপান ছেড়ে দেয়।রেজা সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার এতবড় শক্তি কোথায় পেল? রিয়ার আবেদনের মধ্যে কাজ করেছিল কী শক্তি?এই শক্তির কথা খোলাসা হয়নি উপন্যাসে। একটা আলো-আঁধারি ছায়া ঘুরেফিরে এসেছে বিভিন্ন ইস্যুতে।এটা কি কেবলই শ্রদ্ধা ছিল, কেবলই ভালোবাসা, শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, নাকি অন্য ধরনের ভালোবাসা? রহস্যপূর্ণ দ্যোতনায় ঢেকে ছিল এই অনুভূতি।
Advertisement
আলো-আঁধারের পর্দা ফুঁড়ে বারবার রিয়ার মনে প্রশ্ন এসেছে। বারবার বিভ্রমের ছায়ায় ঢেকে গেছে রিয়া। যেবুর সঙ্গে রেজার গড়ে ওঠা গোপন সম্পর্ক তাই এড়িয়ে যায়নি রিয়ার চোখ। যেবু ও রেজার গোপন বিয়ে, গোপনে জাপানে চলে যাওয়ার আগেই সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক সুতো বেয়ে তার মনে খবর হয়ে গিয়েছিল সব। কিছু একটা ঘটছে জানান দিয়ে যায় মন।তাই গুলশানের রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময় রিয়ার মনে চট করে প্রশ্ন ঢুকে যায়, ওনারা দুজন কি একসঙ্গে এলেন? মুনার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময়ে একই ধরনের প্রশ্ন আসে মনে। পুনমের জরুরি খবর জানানোর জন্য ফোন করে রিয়া। যেবু আপার ফোন বন্ধ। রেজা মামার ফোন বন্ধ। একই সঙ্গে দুই ফোনের বন্ধ থাকার বিষয়টাও তাকে নাড়া দেয়। মনে কিছু একটা জানান দেয়। কুসুমকলি থেকে যেবু আপা ও রেজা মামার বিয়ের খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই আলোছায়া তাকে অবচেতন থেকেই অস্থিরতায় চেপে রাখে। কেন এই অস্থিরতা রিয়ার মনে কাজ করে ? অব্যাখ্যায়িত থেকে যায় ইস্যুটা। এটাই উপন্যাসের সমাপ্তিতেও একটা অসমাপ্ত মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতা। ওই শূন্যতায় পূর্ণ হয়নি উপন্যাস মায়াবতী। পূর্ণ হয়নি মায়াবতীর রিয়ার মন। এই শূন্যতা আরোপিত না। জীবনের বহমান স্রোতে ঘটে গেছে এমনটা। এই স্রোতের বাইরে যেতে পারেনি রিয়া। বাইরে গেছে রেজা, যেবু। বাইরে যাওয়ার কারণে উভয়ের জীবনে পূর্ণতার পথ তৈরি হয়। যেবুর জীবনের অপূর্ণতা, না পাওয়ার বেদনা, রেজার সান্নিধ্যে ভরে ওঠে, মিটে যায়। দুজনের বয়সের ব্যবধান মোটামুটিভাবে মানানসই, বেমানান হয়নি। রিয়ার তৈরি পথ ধরেই তারা ঘনিষ্ঠ হয়েছে, গোপনে গোপনে কাছাকাছি চলে এসেছে। এই ঘনিষ্ঠতা রিয়া অবচেতনে চেয়েছে। চাওয়ার পরও ঘনিষ্ঠতা অনুমান করে নিজের মনে শূন্যতা টের পেয়েছে। দ্বন্দ্ব থেকে গেছে। এই দ্বন্দ্বই রিয়াকে অস্থির করেছে। প্রশান্তি দেয়নি।
রিয়া রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কোনো ক্ষতি ছাড়া উদ্ধার হয়েছে তার। উদ্ধার হলেও ঘটনা তার পিছু ছাড়েনি। উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত বিষয়টা ধেয়ে বেড়িয়েছে তাকে। যূথীর কথা থেকে বোঝা যায়, ধর্ষিত হয়েছে এমন কথাই চাউর হয়ে গেছে, আলোচিত হয়েছে। যূথীর দৃষ্টিতে একজন ধর্ষিতার সঙ্গে নিজের গোপন কথা আলাপ করা যায়। আলাপ করেছে সে। ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ধারণা সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল রিয়াকে, রিয়া মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। কুসুমকলির মায়ের কথায় বোঝা যায়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিটা তার দিকে বিষাক্ত তীর উঁচিয়ে রেখেছিল। নিজের মেয়েকে রিয়ার সঙ্গে না মেলামেশার জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিল। বিয়ের প্রস্তাব আসে, ভেঙে যায়, এগোয় না কেউ। রিয়া বিয়ে করতে আগ্রহী না। তবু বিয়ের প্রস্তাব ভেঙে যাওয়াকে সে সহজভাবে নিতে পারে না। কারণ ঘটনার পেছনে অন্যদের উপলব্ধি হলো―রিয়া ধর্ষিতা একটা মেয়ে। অন্যদের ধারণা হলো রিয়া নষ্ট মেয়ে।সে যেখানে গিয়েছে মোটামুটিভাবে তার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা নানাজনে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছে। কথার খোঁচায় তাকে আক্রান্ত করেছে, রক্তাক্ত করেছে।অন্যদের দ্বারাই কেবল সে আক্রান্ত হয়নি।নিজের দ্বারাও নিজে আক্রান্ত হয়েছে।
নানা ইস্যুতে ‘ভুল’ ঘটনা জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে।এমনকি বিনোদনের জন্য টিভি দেখছিল রিয়া। জি ক্যাফে-তে ইংরেজি মুভি চলার সময় প্রায় একই রকম একটা দৃশ্য দেখে সে। দৃশ্যটা ছিল অনেকটা তার আটক অবস্থায় সন্ত্রাসীদের আচরণের মতো। ফলে হুবহু নিজ জীবনের ঘটনাটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। দ্রিম করে কেঁপে ওঠে মন, কেঁপে ওঠে বুক। ঢিপঢিপ বেড়ে যায়। বুকের ভেতর ঘোড়দৌড়ের শব্দ শুনতে পায়।স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাতে ধরা রিমোট কন্ট্রোল চাপ দেয় সে। টিভি অফ করে দেয়।এটা হলো পিটিএসডি বা পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের উপসর্গ। অর্থাৎ রিয়ার মনে একধরনের চাপ থেকে যায়। চাপ বহন করে বেড়ায় সে। এই রোগের মূল উপসর্গ হলো হঠাৎ আলোড়িত হওয়া, হঠাৎ ঝড় ওঠা মনে। এটাকে বলে হাইপার অ্যারোজাল। এমন অবস্থার ধকল ভোগ করে দেহমন। দ্রিম করে কেঁপে ওঠা, বুকের ভেতর ঘোড়দৌড়ের শব্দ শুনতে পাওয়া দৈহিক আলোড়ন, দৈহিক উপসর্গ।মনের উপসর্গ হচ্ছে, উদ্বেগ, বিরক্তি, ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের ঘাটতি।ঘটনাটা বিভিন্ন ইস্যুতে মনে পড়ে যায়। মনে ঢুকে যায় জোর করে। এটাকে বলে ইনট্রুশান অব দি ইভেন্ট। দুঃস্বপ্নেও হানা দেয় দৃশ্যপট। এই অবস্থায় মন অ্যাভয়েড করে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গগুলো। যেমনটা আমরা দেখেছি রিয়ার আচরণে। টিভি অফ করে দিয়েছে সে। কুসুমকলিদের বাসার দিকে আর পা বড়াতে দেখিনি আমরা। তবে কুসুমকলির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে ঠিক থেকে যায়। আবেগের দিক থেকেও আমরা লক্ষ করি, কিছুটা ভোঁতা হয়ে যায় রিয়া, একাকিত্ব বাড়তে থাকে, ডিটাচমেন্ট বাড়তে থাকে। এগুলো পিটিএসডি রোগের উপসর্গ হিসেবে তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। পরবর্তী সময়ে, সে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে গেছে। তার আবেগের সংবেদনশীলতা ফিরে এসেছে। ডিটাচমেন্ট কমে গিয়েছিল। ন্যুড ছবির ব্যাপারে পজিটিভ নিউজ পাওয়ার পর গুটিয়ে যাওয়া রিয়া অবরুদ্ধ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।এই উপন্যাসে মিসেস রহেলা চৌধুরীর মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাসটা বোঝা জরুরি। উপন্যাসের রাহেলা চৌধুরী আচরণ বিশ্লেষণ করলে নানা দিক থেকে বিজ্ঞান উঠে আসে। উপন্যাস পাঠের সময় পাঠক হয়তো বিজ্ঞানটা খুঁজে পাননি। তাই এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:রিয়ার সৌন্দর্য মায়ের মনে কাঁপন ধরায়।মেয়ের সঙ্গে বেড়াতে যেতে চান তিনি। গাড়ি নিয়ে মুনাদের বাসার সামনে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। একা ছাড়তে চান না, বিজ্ঞান-আলোচনার শুরুতে প্রসঙ্গটা তুলে ধরা হয়েছে।জীবনে পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতার কারণে রাহেলা চৌধুরী ভয় পান। ভয়ের চক্রবৃত্তে ঘুরপাক খায় তাঁর বিশ্বাস, আচরণ, কথাবার্তা। গোপন অভিজ্ঞতা তাঁকে গোপনে চালায়। তিনি নিজেও জানেন না এই গোপন প্রণোদনার খবর। মূলত রিয়ার প্রতি তার কোনো অবিশ্বাস নেই। মায়ের মন রিয়াকে বিশ্বাস করে, রিয়াকে বুকে আগলে রাখতে চায়।রেজা এসেছে রিয়াদের বাসায়। রিয়ার সঙ্গে কথা বলছে।রিয়াকে একাকী কথা বলতে দেখে গোপনে সনাতন মায়ের মন চমকে ওঠে। ভীত হয়। চট করে তিনি প্রশ্ন করে বসেন, একা এসেছেন? মুনা আসেনি?মাকে চেনে রিয়া।মায়ের এই প্রশ্ন এবং অভিব্যক্তিটার আড়ালের উদ্দেশ্য পড়তে পারে, বুঝতে পারে সে। রেজা মামার একা আসা পছন্দ করেননি রাহেলা চৌধুরী। অপছন্দটা লুকিয়ে রাখতে পারেননি তিনি।রিয়া পদে পদে হোঁচট খেয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারেনি।এই ঘটনাকে কীভাবে দেখছে বিজ্ঞান?রিয়া নিজের কাছে স্বচ্ছ। কোনো দোষ করেনি, নির্দোষ একটা মেয়ের প্রতি মায়ের আচরণকে অবিচার হিসেবে দেখেছেন।মা বুঝতে পারেননি যে অবিচার করছেন।মা বিচার করেছেন সনাতন মায়ের চোখ দিয়ে। সামাজিক চোখ দিয়ে। মায়ের সামাজিক চোখে বিষ ঢেলে দেয় শেফালি―বাসার কাজের বুয়া।বুয়া বলে, বাইরের পুরুষের লগে রিয়া আম্মারে একলা ছাইড়া দেওন ঠিক না।শেফালির মনে ঈর্ষা কাজ করে। ঈর্ষার কারণে অন্যের মনে বিষের আগুন ছড়িয়ে আনন্দ পায় সে।রাহেলা চৌধুরী বিষ পান করেন। নিজের মনের গোপন বিষ এবং শেফালির ঢেলে দেওয়া বিষ রাহেলার আচরণ কথাবার্তা সংকুচিত করে ফেলে। এই সংকুচিত মনোভঙ্গির প্রভাব পড়ে রিয়ার ওপর। রেজা কিছু টের না পেলেও রিয়া গোপনে শক্ত হয়ে যায়। রেজা মামাকে বুঝতে না দিয়ে নিজের মনের চোট নিজে নিয়ন্ত্রণ করে রিয়া।
এখানে মা’র চিন্তন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি মনোবিজ্ঞানের কগনিটিভ মডেলটা আবার আমাদের সামনে টেনে আনে। এই মডেলের আলোকে স্বয়ংক্রিয় ‘নেগেটিভ থটস’ জাগে রাহেলার মনে। এর অতলান্তে আছে মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া অতীতের কঠিন ঘটনা।খালুর সঙ্গে রাহেলার উঠতি বয়সের অসংযমী ঘটনা উপন্যাসে বাড়তি কিংবা আরোপিত আখ্যান নয়, সমান্তরাল ধারারও ঘটনা নয়। উপন্যাসের মূল ধারার শেকড়েই বাঁধা আছে অতীত জীবনের সত্য দৃশ্যপট। রাহেলা জানে, খালুর মতো শ্রদ্ধাস্পদ পুরুষও কেমন নির্লোভ নির্মোহ শব্দ-ব্যঞ্জনায় ধীরে ধীরে মনে নেশা জাগিয়ে তুলতে পারে, যৌনতার প্রতি বেপরোয়া টান তৈরি করে দিতে পারে। রাহেলা জানে, এ ধরনের দক্ষ পুরুষেরা কীভাবে খুলে দেয় দেহের পাপড়ি, খুলে নেয় যৌবনগোলাপ।নিজ জীবনের শিক্ষা, অতীত অভিজ্ঞতা গোপনে নির্ধারণ করে দেয় মায়ের আচরণ। কথাবার্তা। এটাই মনস্তত্ত্বের একটা সক্রিয় ভিত, চক্র। এই প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে মা সব বিচার করে। এই বিচারে রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপরও মাকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ এমন ঘটনা একটা না, শত শত ঘটছে। সামাজিক এই শিক্ষাকে কীভাবে অবজ্ঞা করবেন রাহেলা চৌধুরী। তিনি তো মেয়েকে বুকে পুরে রাখতে চাইবেনই। তবে তিনি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেননি যথাযথ পথে।মেয়ের ব্যাপারে মা সচেতন হবেন―এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখতে হবে অতি সচেতনতা সীমা লঙ্ঘন করে কি না। সীমা লঙ্ঘিত হলে কষ্ট বাড়বে। ঝুট ঝামেলা বাড়বে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা করতে পারলে মায়ের মন শান্ত হতো, উদ্ভূত পরিস্থিতি বৈজ্ঞানিকভাবে মোকাবিলা করতে পারতেন তিনি।কীভাবে আসবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি?সমাজে তো এমন ঘটনা ঘটছে। এমন কয়েকটা এপিসোডও আছে এই উপন্যাসে: ‘মুনার প্রতি আহসান স্যারের সরাসরি প্রপোজাল, তোমাকে পেতে চাই, দেবে?’যূথীর ছোটবেলায় হুজুরের অনৈতিক স্পর্শ। ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের ব্যাপারে সিনিয়র ছাত্রী তানজির সতর্কবার্তা।লিফটে আটকে যাওয়ার পর বয়স্ক পড়শির হাতের অসভ্যতা।রেজার সঙ্গে বুবলির কথোপকথন: ‘বুবলি বলে, যে বেডা আমারে দ্যাহে, হেই বিয়া করবার চায়। কুমতলব করে। বেডাদের চোখ ছিনি আমি।’চোখ চেন?হঁ। ছিনি। সুযোগ পাইলেই কয় আমি নাহি সুন্দর। আমার মুখে নাহি খুব মায়া।ওহ্। এসব বলতে সুযোগ দাও?সুযোগ আবার দেওন লাগে। কুত্তা-বেড়ালের মতো বড় হইছি। কুত্তা-বেড়ালের কাছে আইতে পুরুষ মানষেরে তো সুযোগ দেওনের দরকার অয় না।’এপিসোডগুলো উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। মূলধারার পাশাপাশি সমান্তরাল ধারাটাকে বেগবান করেছে। সমান্তরাল ধারায় কেবলই ছুটে যায়নি, ঘটনাগুলো মূল ধারার সঙ্গেই সংযুক্ত হয়ে গেছে। এই সংযুক্তি ঘটেছে সমাজবিজ্ঞানের আলোকে, মনোবিজ্ঞানের আলোকে তো অবশ্যই।
Advertisement
চলবে...
এসইউ/এমএস