হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ইহুদিরা একবার নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আবুল কাসিম! (বৃষ্টির সময় আকাশে যে আওয়াজ হয় সেটা কীসের আওয়াজ?) আমাদেরকে রাদ (মেঘের গর্জনের আওয়াজ)প্রসঙ্গে বলুন, এটা কি?
Advertisement
তিনি বললেন, ‘মেঘমালাকে হাকিয়ে নেওয়ার জন্য ফেরেশতাদের একজন নিয়োজিত আছে। তার সঙ্গে রয়েছে আগুনের চাবুক। এর সাহায্যে সে মেঘমালাকে সেই দিকে পরিচালনা করেন, যেদিকে আল্লাহ তাআলা চান।
তারা বললো, আমরা যে আওয়াজ শুনতে পাই তার তাৎপর্য কি?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এটা হচ্ছে ফেরেশতার হাকডাক। এভাবে হাকডাক দিয়ে সে মেঘমালাকে তার নির্দেশিত স্থানে নিয়ে যায়।’ তারা বললো, আপনি সত্য বলেছেন।’ (তিরমিজি)
Advertisement
বজ্রপাতের শক্তিশালী আলোর ঝলকানি ও প্রচণ্ড গর্জন মহান আল্লাহ তাআলার মহাশক্তির নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। শক্তিশালী এই আলোর ঝলকানি ও বজ্রপাতের গর্জন মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ সতর্কবাণী। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সাবধান করার জন্যই বজ্রপাত বর্ষণ করে থাকেন। তিনি চাইলে এ বজ্রপাতের মাধ্যমে তাঁর অবাধ্য সীমালংঘনকারী বান্দাদের শাস্তিও দিতে পারেন।
যদিও আল্লাহ তাআলা সব সময় তাঁর বান্দাদের প্রতি শাস্তিদানের মতো কঠোর আচরণ করেন না। কেননা আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য রাহমান, রাহিম; গাফুর ও গাফ্ফার।
বজ্রপাত সম্পর্কে কোরআনের ঘোষণা
মহান আল্লাহ তাআলা বজ্রপাত প্রসঙ্গে কোরআনু কারিমে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে পাক নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশাল আওয়াজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
Advertisement
وَ یُسَبِّحُ الرَّعۡدُ بِحَمۡدِهٖ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ مِنۡ خِیۡفَتِهٖ ۚ وَ یُرۡسِلُ الصَّوَاعِقَ فَیُصِیۡبُ بِهَا مَنۡ یَّشَآءُ وَ هُمۡ یُجَادِلُوۡنَ فِی اللّٰهِ ۚ وَ هُوَ شَدِیۡدُ الۡمِحَالِ
‘মেঘের গর্জন তাঁর প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং ফেরেশতারা তাঁর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে তাসবিহ পাঠ করে; তিনি বজ্রপাত করেন এবং (অনেক সময়) তাকে যার ওপর চান, ঠিক সে যখন আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডায় লিপ্ত তখনই নিক্ষেপ করেন। অথচ আল্লাহ তাআলার কৌশল ও শক্তি বড়ই জবরদস্ত।’ (সুরা রা’দ : আয়াত ১৩)
’রাদ’ বা বজ্রপাত আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার তাসবিহ পাঠ করে এবং ফেরেশতারা তার ভয়ে তাসবিহ পাঠ করে। হজরত মুজাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, রাদ বলে যদি মেঘের গর্জন বুঝা হয়, তবে এ তাসবিহ পাঠ করার অর্থ হবে আল্লাহ তাতে জীবন সৃষ্টি করেন।’ (কুরতুবি)
অথবা এটা ঐ তাসবিহ যা কোরআনুল কারিমের অন্য এক আয়াতে উল্লেখিত রয়েছে যে, ’সাত আকাশ, পৃথিবী এবং ওদের অন্তর্বর্তী সব কিছু তারই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৪৪/ইবন কাছির)
কোনো কোনো হাদিসে আছে যে, বৃষ্টি বর্ষণের কাজে নিযুক্ত ফেরেশতার নাম রাদ।’ (তিরমিজি)
হাদিসে পাকে আরও এসেছে, এক প্রভাবশালী লোকের কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে লোক পাঠালে সে বললো, ‘কে আল্লাহর রাসুল? আল্লাহ কি? সোনার না রূপার? নাকি পিতলের?
এভাবে তিনবার সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাঠানো লোককে বলে পাঠাল। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তার উপর আকাশ থেকে বজ্রপাত করালেন। ফলে তার মাথা গুড়িয়ে যায়। তখন এ আয়াত নাজিল হয়।’ (ইবনে আবি আসেম : আস সুন্নাহ)
বজ্রপাত আল্লাহর অপার শক্তির নিদর্শন
পথহারা মানুষের জন্য মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎচমক শিক্ষণীয় বিষয়। কারণ মেঘের গর্জন এ কথা প্রকাশ করে যে, আল্লাহ তাআলা যে বায়ু পরিচালিত করেন, বাষ্প ও মেঘমালাকে একত্র করেন। এ বিদ্যুৎকে বৃষ্টির মাধ্যম বা উপলক্ষ বানান এবং পৃথিবীর সৃষ্টিকূলের জন্য তিনি পানির ব্যবস্থা করেন।
তিনি যাবতীয় ভুল-ত্রুটি-অভাব থেকে মুক্ত। তিনি জ্ঞান ও শক্তির দিক থেকে পূর্ণতার অধিকারী। পশুর মতো নির্বোধ শ্রবণ শক্তির অধিকারীরা তো এ মেঘের মধ্যে শুধুই গর্জনই শুনতে পায় কিন্তু বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন সজাগ শ্রবণ শক্তির অধিকারী ব্যক্তিরা মেঘের গর্জনের মধ্যে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার নির্দশন দেখতে পান।
আল্লাহর শক্তিমত্তা ও অপার কৌশল দেখে মেঘমালাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকা ফেরেশতাসহ অন্যান্য সব ফেরেশতারাও তাঁর ভয়ে তাসবিহ পাঠ করে।
আরবের মুশরিকরা আল্লাহর উপাসনা বাদ দিয়ে ফেরেশতাদেরকেও দেবতা হিসেবে গণ্য করতো। মানুষের আল্লাহদ্রোহীতা ও জুলুম-অত্যাচার, জিনা-ব্যাভিচারসহ যাবতীয় মানবতা বিবর্জিত অন্যায় কাজই এ বজ্রপাতের মূল কারণ।
আল্লাহর দিকে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা
এ সব বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমক থেকে বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই মানুষকে দুনিয়ার যাবতীয় অন্যায় পরিত্যাগ করতে হবে। নিজেদের গুনাহ থেকে খাঁটি তাওবা করতে হবে। যারা খাঁটি তাওবার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার দিকে ফিরে আসবে তারাই বজ্রপাত থেকে মুক্ত থাকবে। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দারা যাদ আমার বিধান যথাযথ মেনে চলত, তবে আমি তাদেরকে রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম আর সকাল বেলায় সূর্য (আলো) দিতাম এবং কখনও তাদেরকে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ)
কোরআন এবং সুন্নাহর বর্ণনায় এ কথা সুস্পষ্ট যে, বজ্রপাত পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক মহাদুর্যোগ। আল্লাহ প্রদত্ত এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেঁচে থাকতে হলে কোরআন-সুন্নার দিকনির্দেশনা পালনের বিকল্প নেই।
বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায়
সম্প্রতি সময়ে পত্র-পত্রিকায় তাকালেই দেখা যায়, কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে। আবার একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। যা মানুষের জন্য তাদের অবাধ্যতার সতর্কবাণী। কোরআনের বিধান পালন এবং নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো তাসবিহ ও দোয়া পাঠে বজ্রপাতের দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষায় নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতদের বিভিন্ন দোয়া ও তাসবিহ শিখিয়েছেন। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা এভাবে এসেছে-
১. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন তখন বলতেন-
اَللَّهُمَّ لَا تَقْتُلْنَا بِغَضَبِكَ وَ لَا تُهْلِكْنَا بِعَذَابِكَ وَ عَافِنَا قَبْلَ ذَلِكَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা লা তাক্বতুলনা বিগাদাবিকা ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিকা, ওয়া আ’ফিনা ক্ববলা জালিকা।’ (তিরমিজি)
অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! তোমার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমাদের মেরে ফেল না আর তোমার আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করো না। বরং এর আগেই আমাদের ক্ষমা ও নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে নাও।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে-
হজরত ইবনে আবি জাকারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি বজ্রের আওয়াজ শুনে এ দোয়া পড়বে-
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ
উচ্চারণ : ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।’
সে বজ্রপাতের আঘাত থেকে মুক্ত থাকবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)
অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেঘের গর্জন শুনতেন তখন কথাবার্তা ছেড়ে দিতেন এবং এ আয়াত পাঠ করতেন-
سُبْحَانَ الَّذِىْ يُسَبِّحُ الرَّعْدُ بِحَمْدِهِ وَالْمَلَائِكَةُ مِنْ خِيفَتِهِ
উচ্চারণ : ‘সুবহানাল্লাজি ইউসাব্বিহুর রাদু বিহামদিহি ওয়াল মালাইকাতু মিন খিফাতিহি।’
অর্থ : ‘পবিত্র সেই মহান সত্তা প্রশংসা যিনি পানিভরা মেঘ উঠান। মেঘের গর্জন তার প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং তার ফেরেশতারাও তাঁর ভয়ে কম্পিত হয়ে তাঁর তাসবিহ পাঠ করে।’ (মুয়াত্তা মালেক, মিশকাত)
পরিশেষে...
মেঘের গর্জন তথা বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভয়াবহ শাস্তি থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহ তাআলার বিধান মেনে চলা জরুরি। পাশাপাশি বজ্রপাতের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে থাকতে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো দোয়া ও তাসবিহগুলো পড়া উচিত।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মেঘের গর্জন তথা বজ্রপাতের সময় আল্লাহর প্রশংসা করা, সব ধরণের অন্যায় ও অবাধ্য আচরণ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার এবং তার বিধান পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম