আজ ১২ মে, আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। বিশ্বে পালিত হচ্ছে দিনটি। মূলত সমাজের প্রতি নার্সদের অবদান ও মানুষের সেবায় যেভাবে তারা কাজ করেন, তা সবার সামনে তুলে ধরতে দিনটি পালন করে বিশ্ব।
Advertisement
আধুনিক নার্সিং পেশার রূপকার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন উপলক্ষে এ দিবস পালন শুরু হয়। এ বছর নার্স দিবসের প্রতিপাদ্য ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী নার্স নেতৃত্বের বিকল্প নেই—বিশ্ব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নার্সিং খাতে বিনিয়োগ বাড়ান ও নার্সদের অধিকার সংরক্ষণ করুন'।
যুগে যুগে অন্ধকার দূরে সরিয়ে আলোর পথে এগিয়ে নিতে জন্মান কিছু মানুষ। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। নামের মতোই আলো ছড়িয়েছিলেন বিশ্বে। ১৮২০ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শহরের নামেই তার নাম।
ধনী পরিবারে জন্ম নেওয়ায় বেশ বিলাসবহুল কেটেছে শৈশব। সে সময় নারীদের বাইরে কাজের অনুমতি ছিল না। নারীদের কাজ ছিল শুধু সংসার সামলানো,বাচ্চা জন্ম দেওয়া ও তাদের লালন-পালন করা। তবে ফ্লোরেন্সের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল নার্স হওয়া। কিন্তু তখনকার সময়ে নার্সিংকে সম্মানের চোখে দেখা হত না। এ ছাড়া তার পিতা-মাতা চাননি ফ্লোরেন্স নার্স হোক। তাই ফ্লোরেন্স বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন। কেননা তার নিজ বাড়িতে তার স্বপ্নটি পূরণ করা সম্ভব ছিল না।
Advertisement
১৭ বছর বয়সে তিনি বাবা-মাকে জানান, তিনি ‘দৈবাদেশ’ পেয়েছেন মানুষের সেবার জন্য। এ কথা বিশ্বাস করেছিলেন তার বাবা-মা। তার ইচ্ছার কথা জানলে তাকে কখনোই যে এ কাজে আসতে দেবেন না, তা খুব ভালোভাবেই জানতেন তিনি। তারপরও পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধিতার শিকার হয়েছিলেন ফ্লোরেন্স। কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেননি। বেছে নিলেন সেবিকার জীবন। প্রথমে ১৮৫০ সালে শিক্ষানবিশির পাঠ নিলেন জার্মানিতে। ফিরে এসে লন্ডনে হ্যারো স্ট্রিটের একটি নারী-হাসপাতালে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করলেন।
তবে অঙ্ক ছিল তার প্রিয় বিষয়। পরে ভালোবাসেন পরিসংখ্যানবিদ্যাকে। কম বয়স থেকেই তথ্য লিপিবদ্ধ করার দিকে ছিল ঝোঁক। তাই রকমারি লিখিত তালিকা করতেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতি শেখার জন্য যেতে হয়েছিল ইউরোপে। সেখানেও তার প্রিয় ছিল জনসংখ্যা, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানের বিশদ লিপিবদ্ধকরণ। পরে অঙ্কে বিশেষ শিক্ষা (প্রাইভেট টিউশন) নিয়েছিলেন, তাতে মায়ের সম্মতি না থাকলেও। অঙ্কে ও পরিসংখ্যানবিদ্যায় তার ব্যুৎপত্তি ভবিষ্যতে রোগের আকৃতি, প্রকৃতি চার্ট দিয়ে সহজে বোঝার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল।
ফ্লোরেন্স ১৮৫৩-১৮৫৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের ‘কেয়ার অব সিক জেন্টলওমেন ইনিস্টিটিউটের’ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেন। ১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য কাজ শুরু করেন। নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। পরে তিনি ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর গবেষণা চালান। যা ভারতবর্ষে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৮৫৯ সালে তিনি ‘রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির’ প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং। ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’।
Advertisement
নাইটিঙ্গেলের একটি সাবলীলতা ছিল ক্ষমতাবান মানুষের বন্ধুত্ব অর্জনের। ১৮৪৭ সালে তার সঙ্গে পরিচয় হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সিডনি হারবার্টের সঙ্গে, যিনি ছিলেন সেক্রেটারি অব ওয়ার (একটি রাজনৈতিক পদ)। ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে। ব্রিটেনে যুদ্ধাহতদের করুণ অবস্থার কথা জানতে পারেন ফ্লোরেন্স। ১৮৫৪ সালের ২১ অক্টোবর তিনি তার কাছেই প্রশিক্ষিত ৩৮ জন সেবিকা, তার এক আত্মীয় মেই স্মিথ এবং ১৫ ক্যাথলিক নানসহ ইস্তানবুলের স্কুটারির ব্যারাক হাসপাতালে পৌঁছান।
হারবার্টের সহায়তায় নাইটিঙ্গেল সেখানে সেবিকা হিসেবে যোগদান করেন। সেখানের সেনা-হাসপাতালের দুর্দশার খবর জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছিল। সেখানে অসুস্থ ও আহত সৈনিকদের নিরাময়ের ক্ষেত্রে পেলেন অভূতপূর্ব সাফল্য। ভালোবাসা ও নিষ্ঠায় কৃচ্ছসাধনার সঙ্গে নিয়েছিলেন কিছু ব্যবস্থা। রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্যের ও সবার হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, হাসপাতাল পরিচ্ছন্নকরণ, আবর্জনা নিষ্কাশন ও বায়ু চলাচল ইত্যাদির ব্যবস্থা। মৃত্যুহার নেমে এসেছিল শতকরা বিয়াল্লিশ ভাগ থেকে শতকরা দুই ভাগে।
হাতে দীপ নিয়ে রাতে অসুস্থদের দেখতে বেরোতেন বলে পরিচিতি পেলেন ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ বলে। ‘দ্য টাইম' পত্রিকা সর্বপ্রথম দেয় উপাধিটি। এ উপাধি নিয়ে সবার কাছে হয়ে উঠলেন সেবাপরায়ণতার এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব। এটি ছবিসহ স্মারক হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল বিভিন্ন জিনিসপত্রে। রচিত হলো কবিতা, গান ইত্যাদি। কবি হেনরি ওয়ার্ডফোর্থ তাকে নিয়ে লিখলেন ‘সান্তা ফিলোমেনা’ কবিতা। এ প্রচার কিন্তু তার পছন্দ ছিল না। তাই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে থাকতেন সাধারণ-যাপনের মধ্যে। আর বাইরে ভ্রমণে গেলে ব্যবহার করতেন ‘মিস স্মিথ’ ছদ্মনামটি।
ফিরে এসে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন নাইটিঙ্গেল। প্রতিষ্ঠা করলেন পৃথিবীর প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ নার্সিং স্কুল। এটি এখন লন্ডনের কিংস কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি’ নামে পরিচিত।
সামরিক বাহিনীর স্বাস্থ্যের মান নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন নাইটিঙ্গেল। তার অনুরাগী মহারাণী ভিক্টোরিয়াসহ সবাইকে সেটি বোঝাতে কাজে লেগেছিল তার অঙ্কের ব্যুৎপত্তি। সংগৃহীত জটিল ও বিপুল তথ্যকে সহজবোধ্য ভাবে পরিবেশন করেছিলেন পরিসংখ্যানের গ্রাফগত পরিভাষায়, ‘পাইচার্ট’-এ, ‘রোজ ডায়াগ্রাম’-এ। দেখিয়েছিলেন শতকরা ৯০ ভাগ অসুখই হয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের অভাবের জন্য, যা নিবারণযোগ্য। তার উদ্যোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়।
তিনি রোগীর অসুখ ও চিকিৎসাগত সব তথ্য নথিবদ্ধ করে রোগীর আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার জন্য পাঠিয়ে দিতেন পরিষেবা যেখানে সুলভ এবং উন্নত সেখানে। সেই অর্থে নাইটিঙ্গেলকে ‘মেডিক্যাল ট্যুরিজম’র পথিকৃৎ বলা যায়। অন্তত দুশ’টির ওপর বই এবং বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন নাইটিঙ্গেল। ১৮৫৯ সালে লিখেছিলেন ‘নোটস অব নার্সিং’। এটিকে রোগীসেবা নিয়ে নার্সিংয়ের প্রথম বই বলা যায়।
এ গ্রন্থে তিনি নার্সিং স্কুলে পাঠ্যসূচির ভিত্তি রচনা করেন। তার কিছু কথা এখনো গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য। যেমন- তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিদিন পরিষ্কার থাকার জ্ঞান, অথবা নার্সিংয়ের জ্ঞান, অন্য কথায় কিছু নিয়মাবলী, যা নিয়ে যাবে রোগমুক্ত অবস্থায় অথবা রোগ থেকে মুক্ত করবে, আরও ভালো করবে, এটা সার্বজনীন জ্ঞান, যা সবার থাকা উচিত, চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে কিছুটা আলাদা, যেটি নির্দিষ্ট পেশার মানুষে সীমাবদ্ধ।’
১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে লন্ডনের পার্কলেনে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন আলোর পথের যাত্রী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। বিশ্বব্যাপী সেবিকা পেশার বিকাশের মাধ্যমে তিনি আর্ত-মানবতার কষ্টের আঁধার কেটে এনেছেন আশাবাদী আলোর জোয়ার। এখনো তিনি সেবিকাদের মডেল হয়ে আছেন। তার দেখানো পথেই হেঁটে চলেছেন নিবেদিতপ্রাণ শত-সহস্র সেবিকা।
কেএসকে/এসইউ/জিকেএস