মতামত

বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু আশাবাদী হওয়ার মত ঘটনা

মানুষ মাত্রেরই আইন অমান্যের প্রবণতা থাকে এবং সে কারণেই আইন করে শাস্তি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, যাতে মানুষ অন্যায় না করে। যে সকল দেশ সভ্য বলে আজ স্বীকৃত সেসব দেশের সভ্য হওয়ার মূল জায়গাটি হলো নাগরিকের আইন মান্য করার প্রবণতা এবং না মানলে নির্ধারিত শাস্তি ভোগের নিশ্চয়তা। বাংলাদেশ ক্রমশঃ সেদিকে যাচ্ছে বলে ধরে নিতে চাই এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা থেকে এ বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই।

Advertisement

আমরা জানি যে, রেলমন্ত্রীর স্ত্রী’র আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করে টিটিই’র সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে পার পেতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে টিটিই’কে চাকুরিচ্যুত করার যে ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছে সে বিষয়টি নিঃসন্দেহে আলোচনাযোগ্য এবং এর থেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখার একটা আশাবাদী চিত্রও পাওয়া যায়। এটা বলতে গেলে স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার যে, ক্ষমতার জোর থাকলে রেলগাড়ি থেকে শুরু করে যে কোনো টিকিট বা সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় এদেশে। রেলমন্ত্রী হয়ে রেলের জায়গাজমি নিজের স্ত্রীর নামে লিখে দেওয়ার ঘটনাও এদেশে ঘটেছে এবং তা নিয়ে তখন উচ্চবাচ্য করা সম্ভব হয়নি, কিংবা হলেও তাতে কাজ হয়নি। কিন্তু এবার দেখা গেল উল্টো ঘটনা।

রেলমন্ত্রীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের বিনা টিকিটে ভ্রমণ ধরে ফেলার জন্য মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনে রেলের উধ্র্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে টিটিই চাকুরিচ্যুত হওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়। গণমাধ্যম সরব হলে মন্ত্রী প্রথমে অস্বীকার করেন যে, যাদের কারণে এসব ঘটেছে তিনি তাদেরকে চেনেন না বা তারা তার আত্মীয় নন। কিন্তু গণমাধ্যমই মন্ত্রীর স্ত্রীর সেসব আত্মীয়দের পরিচয় খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রমাণ করে দেয় যে, মন্ত্রীর স্ত্রীর এক ফোনেই রেলের উধ্র্বতন কর্মকর্তা টিটিই’র চাকরিটি খেয়েছেন। যেখানে টিটিই’র পুরস্কৃত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে তিনি হলেন চাকুরিচ্যুত। রাষ্ট্রের হাতে রাষ্ট্রের কর্মচারীর এত বড় নিগ্রহের ঘটনা যদি পার পেয়ে যেতো তাহলে বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।

সৌভাগ্যজনক ভাবে সেরকমটি হয়নি। জনমতের চাপে হোক কি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হোক রেলমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত টিটিই’র চাকুরি ফেরত দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করার নির্দেশ দিয়েছেন বা বলা ভালো বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এ ঘটনা একটি সত্যিকার উদাহরণ হয়ে থাকবে। কিন্তু উদাহরণটি আরো ভালো হতো যদি, বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী আত্মীয়দের শাস্তি নিশ্চিত করা যেতো। সাধারণ মানুষ যেখানে রেলের টিকিটের জন্য রাতভর বসে থেকেও টিকিট কিনতে পারেনি সেখানে মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করাই কেবল নয়, ধরা পড়ার পর তার জন্য রেলের একজন টিটিই’কে চাকুরিচ্যুত করা যে ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার এবং এর জন্য কেবল টিটিই’কে চাকুরিতে বহাল করাই যে যথেষ্ট নয়, সেটি মন্ত্রী মহোদয় এবং এদেশের শাসনকারী রাজনৈতিক দলকে বুঝতে হবে। আপাততঃ মন্ত্রীকে এই ঘটনায় দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ায় ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি।

Advertisement

প্রতি বছর রোজার আগেই দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বিশেষ করে তেল, ছোলা, ডাল ইত্যাদির দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা ফায়দা নিতে চান এবং এ নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের একাধিক বৈঠকের খবর পত্রপত্রিকা/টেলিভিশনে শিরোনাম হয়। এবারও যথারীতি ঘটনাটি ঘটেছে এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের অযুহাতে তেলের দাম কয়েক গুণ বাড়ানোর চেষ্টাকে সরকার থামিয়েছে কেবল তাই-ই নয়, অবৈধভাবে তেলের মজুদ করা প্রায় অর্ধশত ব্যবসায়ী, সরকারী কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তেলের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে সাধারণ নাগরিকের জন্য তেলের মূল্য সহনীয় করে রাখার চেষ্টা হয়েছে রমজানে। কিন্তু হঠাৎই ঈদের পরের প্রথম কার্যদিবসে সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে তেলের মূল্য এক লাফে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি করে দেয়ার ঘটনা সবাইকে হতবাক করেছে। তার পরেই দেখা গেল সরকারের পক্ষ থেকে একেকজন একেকরকম ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন যে, তিনি ব্যবসায়ীদের বন্ধু ভেবে ভুল করেছেন।

এধরনের আবেগপূর্ণ কথায় যে চিড়ে ভেজে না তাতো বলাই বাহুল্য। মানুষের জীবনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যতোটা সহনীয় রাখা যাবে ততোটাই শান্তিপূর্ণ হবে সরকারের স্থিতি। দেখা যাচ্ছে যে, একের পর এক মজুদদারকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, দেশের বড় ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন করা হচ্ছে মজুদ বিষয়ে। আমরা আশা করতে চাই যে, বিষয়টি সরকার সুরাহা করবে এবং সেটা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই। এরমধ্যে সুখকর ঘটনা হচ্ছে মজুদদারদের গ্রেফতারের বিষয়টি।

বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে সবচেয়ে সমালোচিত যে রাজনৈতিক সংগঠন তার নাম ছাত্রলীগ। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছাত্রলীগ নিজেরা যেমন সংবাদ-শিরোনামে থেকেছে তেমনই সরকারের মুখ যারপরনাই নিচু করেছে। সর্বশেষ পাবনার ছাত্রলীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দিকি রাতুল বিদেশি পিস্তুল হাতে ফেসবুকে ছবি দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়েছিল। রাতারাতি সেই ছবি ভাইরাল হয়ে পড়ে এবং জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। রাতুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে দু’দিন আগে এবং সে এখন শ্রীঘরে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের উদাহরণ হিসেবে রাতুল একেবারে শেষের স্তরের কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা এবং আইনের আওতায় আনাটা এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার একটি ক্ষুদ্র উদাহরণও বটে। যে আশাবাদের কথা দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু করেছিলাম সেখানে এই ঘটনাও যুক্ত করাটা অযৌক্তিক হবে না।

Advertisement

গোটা বিশ্ব কেবল একটি মহামারিকাল কাটিয়ে উঠেছে। দেশে দেশে এই মহামারির অন্তর্ঘাত অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। জিনিসপত্রের দাম ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ত্রিশের দশকে গোটা বিশ্বে যে ভয়ঙ্কর মন্দা দেখা দিয়েছিল (বিশেষ করে আমেরিকায়) তার ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল বলে ধরা হয়, এমনকি বিংশ শতকের শুরুতে যে মহামারি দেখা দিয়েছিল তার ফলশ্রুতিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল- মহামারি ও বিশ্বযুদ্ধ এভাবেই সম্পর্কিত বলে গবেষণায় প্রমাণ রয়েছে। এবারও মহামারি শেষ না হতেই ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। একে অনেক বিশ্লেষকই তৃতীয় মহাযুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করছেন। এমতাবস্থায় গোটা পৃথিবীই এক ভয়ঙ্কর দুর্বিপাকে পড়েছে। টিকে থাকা বিশেষ করে অর্থনীতিকে সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারগুলো। উপমহাদেশে ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে, পাকিস্তান ও নেপাল দেউলিয়া হওয়ার পথে।

মহামারির শুরুতে বাংলাদেশ নিয়ে স্ব-ঘোষিত বিশেষজ্ঞগণ এমনটাও বলেছিলেন যে, কোভিডের কারণে বাংলাদেশে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাবে এবং বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদে পড়বে। অংক কষেই তারা এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কেউ কেউ তো আগ বাড়িয়ে একথাও বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের রাস্তায় লাশের স্তুপ জমবে, জনগণ সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবে। সৌভাগ্যজনকভাবে তেমনটা শুধু ঘটেনি তাই-ই নয়, বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে কোভিড মোকাবিলা করেছে এবং কোভিড-ব্যবস্থাপনায় গোটা বিশ্বে পঞ্চম এবং এশিয়াতে প্রথম হয়েছে। এটা আরও বিস্ময়কর যে, কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো করেছে।

করোনা-পরবর্তী রফতানিতে বাংলাদেশ রেকর্ড করতে যাচ্ছে বলেও প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। গত অর্থবছরের দশ মাসে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য, বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই রফতানির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। এর মানে হচ্ছে, বাংলাদেশ কোভিড-দুর্দশা প্রায় কাটিয়ে উঠেছে বা উঠতে যাচ্ছে, যা অনেক দেশই পারেনি বা পেরে উঠছে না। একে যদি সফলতা না বলি, তাহলে সফলতা কোনটি সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।

হ্যাঁ, একথা সত্য যে, বাংলাদেশ একটি অনিশ্চয়তার দেশ। এদেশের ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশেও হঠাৎ করেই কালবৈশাখী দেখা যায়, এবং তার ভয়ংকর পরিণতি এদেশের জনগণকে বহন করতে হয়। রাজনীতি এবং অর্থনীতিতেও এরকম দুর্যোগ দেখা দেওয়া দ্রুততম সময়েই হতে পারে যদি না আগে থেকে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়। বিশেষ করে শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও নেপালের পর বাংলাদেশে এরকম ঘটনা ঘটিয়ে বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের পথে গর্ত খুঁড়তে দেশি-বিদেশি অপশক্তিগুলো বলতে গেলে মুখিয়ে আছে। তারা রীতিমতো এ নিয়ে ‘সেল’ খুলেছে বলেও বোঝা যাচ্ছে। ফলে অনেক নেতিবাচক ঘটনার ভেতর থেকে আশাবাদী হওয়ার মতো কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করে পাঠকের মনে একটু স্বস্তি দেয়াই ছিল এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/জেআইএম