অর্থনৈতিক দুরবস্থার যেসব সমীকরণে পাকিস্তান ডুবছে, শ্রীলঙ্কা পুড়ছে, সেই একই সমীকরণে পড়তে যাচ্ছে নেপাল। কি হতে যাচ্ছে নেপালে? শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টা করছে ভারত। এছাড়া বিশ্বব্যাংক এবং চীন সহায়তার জন্য এগিয়ে এসেছে। এমন সময়ে আশেপাশের আরেকটি দেশ নেপাল একই রকম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়ার পথে। নেপালেও অর্থনৈতিক সংকটের ক্লাসিক লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে।
Advertisement
গত বছরের জুলাই মাস থেকে এ বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৮ শতাংশ কমেছে, যা দিয়ে মাত্র ছয় মাসের আমদানি করা যাবে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি এখন ৭ শতাংশ যা গত ৬৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবারের বন্যার কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে ইতিমধ্যেই খাদ্য-জ্বালানির মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
নেপালের সরকার সমস্ত বিলাসবহুল সামগ্রী যেমন গাড়ি, প্রসাধনী, স্বর্ণ ও রৌপ্যসহ অন্যান্য জিনিস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। দেশটি সপ্তাহে অতিরিক্ত আরো একদিন ছুটির ঘোষণা দিয়েছে, যাতে জ্বালানি ঘাটতি কমানো যায়।
বাহ্যিক ঋণের দিক থেকে নেপাল প্রায় শ্রীলঙ্কার পথেই চলেছে। দেশটির ঋণ বনাম জিডিপির অনুপাত ২০২২ সালে ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে যা ২০১৫ সালে ছিল ২৫ শতাংশ। সরকার বলছে,, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু সরকারি অফিসিয়াল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস রিপোর্টে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও বেশিরভাগ নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরা সর্বোচ্চ সেটা ৪ শতাংশ অনুমান করছেন। নির্বাচনের বছরে এটি নিশ্চয়ই উদ্বেগজনক ব্যাপার।
Advertisement
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এক মতামত কলামে ড. মনিকা ভার্মা লিখেছেন, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বনিম্নের মধ্যেও সর্বনিম্ন এবং জুনের পর আর কিছু বাকি থাকবে না।
ইমরান খানের জনতুষ্টিবাদ নীতির জন্য দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি ৩৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ দায়িত্ব নেওয়ার পর তার প্রথম অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি ছিল সৌদিরা যে ৪.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কথা বলেছে তারচেয়েও আরো বেশি সৌদি সাহায্য চাওয়া।
মালদ্বীপও নিরাপদ অবস্থানে নেই। সমস্ত দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির মতো তেল আমদানিতেই তার জিডিপির সর্বোচ্চ অংশ খরচ হয়ে যায়। দেশটির ২০ শতাংশ পর্যটকই আসতো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দুই দেশ রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে।
সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা মনিকা ভার্মার মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বল অর্থনীতির লক্ষণগুলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল মহামারির আগে থেকেই।
Advertisement
তিনি লিখেছেন, বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালেই এটা বলেছিল। ২০১৪ সাল থেকে 'বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অঞ্চল'-এর তকমাটি অপ্রতিরোধ্যভাবে উপভোগ করে আসছিল দক্ষিণ এশিয়া। কিন্তু, ২০১৯ সালে পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কাছে স্থানটি হারিয়ে ফেলে এই অঞ্চল।
শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের অজুহাত হিসেবে করোনার কথা বলা হয়। কারণ উভয় দেশের অর্থনীতিই পর্যটন এবং রেমিট্যান্স নির্ভর। কিন্তু মহামারির আগেই পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল।
এই অঞ্চলের উপর করা বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়া কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জোড়া আঘাতে ভুগছে। কিন্তু এই কথাটি কেবল স্বল্প এবং মধ্যম মেয়াদের জন্যই সত্য।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় সর্বোচ্চ। এই দেশগুলোর একটি বড় সমস্যা হল তাদের রপ্তানি কর্মক্ষমতা খারাপ হওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য ঋণ এবং রেমিট্যান্সের উপর তারা অত্যধিক নির্ভরশীল। নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা তিনটি দেশই বিগত দুই দশকে রপ্তানির ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে।
২০০০ সালের ৩৯ শতাংশ থেকে নেমে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার রপ্তানি-জিডিপি অনুপাত ১৬ শতাংশ হয়েছে। নেপালের রপ্তানি- জিডিপি অনুপাত ২০০০ সালের ২৩ শতাংশ থেকে ৬.৮ শতাংশে নেমে আসে। রপ্তানির তুলনায় পর্যটন খাত নেপালের জন্য ভালো অবদান রেখেছে (জিডিপির ৭ শতাংশ)। পাকিস্তানের রপ্তানি-জিডিপি অনুপাত ২০০৩ সালের ১৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। এসবের বিপরীতে, বাংলাদেশের রপ্তানি-জিডিপি অনুপাত ২০০০ সালের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
রপ্তানি কমে যাওয়া যে দেশগুলো এখন সমস্যায় ভুগছে সেগুলোর অর্থনীতি আরো কার্যকর করতে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন করতে হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার উৎসের জন্য বাণিজ্যের ওপর মনোযোগ দিতে হবে। এই দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি অপ্রয়োজনীয় আমদানি রোধ করার এবং সঠিক কর নীতি ও ভর্তুকি দিয়ে দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
ঋণ চাওয়ার প্রবৃত্তির কারণে রেমিট্যান্স এবং পর্যটনের মতো কয়েকটি খাতের উপর দক্ষিণ এশিয়ার নির্ভরতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে, তাদের বিচক্ষণ রাজস্ব নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি রপ্তানির বহুমুখীকরণের উপর জোর দেওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যায়, অভিজাতরা জনতুষ্টিবাদে নজর দেওয়ায় ভালো অর্থনীতির উপর খারাপ রাজনীতি রাজত্ব করে।
দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে অর্থনৈতিক সংকট সমগ্র অঞ্চলের ভাবমূর্তি আরও খারাপ করে দিতে পারে। নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার বিপরীতে, বাংলাদেশ ও ভারত রপ্তানিকে উৎসাহিত করা, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানিকে বৈচিত্র্যময় করার দিকে মনোনিবেশ করেছে। উভয় দেশই প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং ভ্যাকসিন সহ বিভিন্ন ওষুধের যৌথ উৎপাদন শুরু করার জন্য একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। দেশ দুটি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করলে ভারতের মতো দেশের মূল বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি ভারতও তার অ্যাক্ট ইস্ট নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের সাথে এবং তার বাইরে সংযোগের ক্ষেত্রে সহায়তা পাবে।
দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে সেগুলো গুরুতর প্রকৃতির। কিন্তু তাদের এটাও মেনে নিতে হবে যে, এগুলো তাদের নিজেদেরই তৈরি। জিরো সাম গেম,উভয়ে সমানভাবে জয়ী হতে চাওয়ার যে খেলার নিট ফলাফল শূন্য এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংকীর্ণ লেন্সের বাইরে দেখলে এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান ভারত-বাংলাদেশ সমীকরণ অনুসরণ করা তাদের জন্য ভাল দৃষ্টান্ত হতে পারে।
এখানে উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি রেমিট্যান্স, কৃষি ও তৈরি পোশাক শিল্প কোনটিই ভারতের অংশিদারিত্ব ও সহযোগিতায় হয়নি। এগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব অর্জন। কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে প্রথম কাতারে রয়েছে। রেমিটেন্সে বাংলাদেশ অব্যাহত উন্নতি করে চলেছে। ক্রমেই বাড়ছে। তৈরি পোশাকের অবস্থায় এখন বিশ্বে শীর্ষ রয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রফতানি আয় বেড়েছে। জুনের পর তা আরো বাড়বে। তাই বাংলাদেশ কখনই দুরবস্থায় পড়বে না।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস