ভ্রমণ

কবিগুরুর কুঠিবাড়িতে একদিন

বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। এখানে যুগে যুগে কালে কালে পদধূলি দিয়েছেন কত মনীষী। তাদের পদধূলিতে যেমন বাংলাদেশের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে; তেমনই আমরা পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার সৃষ্টিকর্ম। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়ই কোনো না কোনো মনীষী বসবাস করেছেন বা জন্মগ্রহণ করেছেন।

Advertisement

সামনে থেকে কুঠিবাড়ি

সেদিক দিয়ে বিচার করলে কুষ্টিয়ার সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে বেশ ক’জন মহামানবের সংস্পর্শে। এখানে জন্ম নিয়েছিলেন মরমি ফকির লালন শাহ, সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারসহ অনেকে। আবার এখানে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বরাও।

কুঠিবাড়ির সামনে নবনির্মিত মঞ্চ

Advertisement

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জমিদারির দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করতেই এখানে আসেন। এরপর থেকেছেন বহুদিন। কুষ্টিয়ার মাটি ও নদীর প্রতি কবির মমতার কথা ফুটে উঠেছে তার বহু সৃষ্টিতে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এখনো বহন করে চলেছে কবিগুরুর বহু স্মৃতি।

কবিগুরুর সময় ব্যবহৃত সিন্দুক

শিলাইদহ কুঠিবাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী ইউনিয়নে অবস্থিত। দোতলা বাড়িটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এক সময় এর দোতলার বারান্দায় বসলে একদিকে পদ্মা নদী, অন্যদিকে গড়াই নদী দেখা যেত।

কুঠিবাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো ছবি

Advertisement

ধারণা করা হয়ে থাকে, কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতা ‘ছোট নদী’ কুষ্টিয়ার গড়াই নদীকে কেন্দ্র করে লেখা। আপনি যদি কখনো কুষ্টিয়ায় বেড়াতে যান, তাহলে এই নদী দেখলে আপনারও সেই কথাই মনে হবে।

কবিগুরুর ব্যবহৃত নৌকা

‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’

কুঠিবাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো ছবি 

বিশাল আয়তনের বাড়িটির মধ্যে দোতলা ভবনের পাশে আছে একটি বিশাল দীঘি। পুরো বাড়ির আঙিনাজুড়ে আছে অনেক গাছপালা। গাছপালাগুলোর অবয়ব তাদের বয়সের সাক্ষী দিচ্ছে। একেকটি গাছ যেন দাঁড়িয়ে আছে একেকজন জাতিস্মরের ভূমিকায়। গাছগুলোর মধ্যে আম এবং পাইনের সংখ্যাই বেশি।

কুঠিবাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো ছবি

পাশাপাশি আছে কাঁঠাল, নিম, কাঠবাদামসহ অনেক প্রজাতির গাছ। দীঘির দুই পাড়ে আছে দুটো শান বাঁধানো ঘাট। সেখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন।

শিশুর জন্য আনন্দ-আয়োজন

অনেকেই এ শানের উপর শুয়ে তার শীতল পরশে শরীরের ক্লান্তি জুড়িয়ে নেন। আর দামাল ছেলেরা দলবেঁধে লাফিয়ে নেমে পড়ে গোসল করতে। আরও আছে অধুনালুপ্ত একটি পাতকুয়া।

বাংলোর বারান্দা

দোতলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষে রাখা আছে কবিগুরুর ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাব। আছে ইতিহাসের সাক্ষী অনেক আলোকচিত্র। পালকি, সিন্দুক, খাটের পাশাপাশি আছে কবিগুরুর ব্যবহৃত বজরা।

প্রথম প্রবেশদ্বার

এগুলো দেখলে আপনার মনে হবে, আপনি যেন আজ হতে শত বছর আগে কবিগুরুর সময়ে চলে গেছেন। যেখানে কবির বাড়ির নারীরা পালকিতে করে নৌকা থেকে কুঠিবাড়িতে এসে নামছেন।

কবিগুরু ব্যবহৃত বজরার মডেল

সিন্দুকে রাখা আছে তাদের ব্যবহৃত তৈজসপত্রাদি। আর কবিগুরু খাটে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কখনো বা বজরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন পদ্মার বুকে। ভ্রমণপিপাসু যে কারো নিকট শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এক আরাধ্য স্থান। কুঠিবাড়ির দেওয়াল থেকে শুরু করে সবকিছুই আপনার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে।

কুঠিবাড়ির বাইরে কুলফি মালাই বিক্রেতাদের সারি

বর্তমানে কুঠিবাড়ির অনেক সংস্কার করা হয়েছে। কুঠিবাড়ির সামনে নির্মাণ করা হয়েছে উঁচু মঞ্চ। ঢোকার মুখে মূল কুঠিবাড়ির বাইরে দেওয়াল তুলে নির্মাণ করা হয়েছে উঁচু প্রবেশদ্বার।

কবিগুরুর ব্যবহৃত খাট

প্রবেশদ্বারের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে প্রবেশ করতে হয়। আর একবারে বাইরে মূল রাস্তার পাশে আছে বিভিন্ন সাজ-সরঞ্জাম কেনার দোকান। তার পেছনে আছে অতিথিদের থাকার জন্য ছোট ছোট বাংলো।

মূল প্রবেশদ্বার

এই বাংলোগুলোর পাশে সব সময়ই চলে ছোটখাটো মেলা। সেখানে নাগরদোলা থেকে শুরু করে আছে ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা। আর পাওয়া যায় অনেক রকমের মজার খাবার।

দীঘির শানবাঁধানো ঘাট

তার মধ্যে কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী কুলফি এবং তিলের খাজা অন্যতম। তবে এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়, বাংলোগুলোর অবস্থান আরও একটি ছোট পুকুরকে কেন্দ্র করে ইংরেজি ইউ অক্ষরের আদলে। এই পুকুরের পারে অনেক আবর্জনা পরিবেশের সৌন্দর্য একেবারে মলিন করে দিয়েছে।

নাগরদোলা

এখানে-সেখানে ছড়ানো আছে পলিথিন ব্যাগ। আমার মনে হয়েছে, কর্তৃপক্ষ যদি কয়েকটি রাবিশ বিন দিয়ে দেয়, তাহলে আর দর্শনার্থীদের এখানে-সেখানে ময়লা ফেলতে হতো না। দিনের শেষে বিনগুলো পরিষ্কার করে আবার নতুন বিন বসিয়ে দিলে খুব সহজেই এখানকার পরিবেশের সৌন্দর্য ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

বাংলোর সামনে নোংরা পুকুর

ঢাকা থেকে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে অনেকভাবেই যাওয়া যায়। কল্যাণপুরে কুষ্টিয়াগামী বাসগুলোর টিকিট কাউন্টার আছে। আপনি চাইলে আগে থেকে অনলাইনেও টিকিট কিনে রাখতে পারেন। এরপর বাসে উঠে বসলে একবারে চলে যাবেন কুষ্টিয়া শহরে। কুষ্টিয়া শহরে আছে চমৎকার কিছু হোটেল।

বেলুন ফুটানো

আর কুষ্টিয়ার যে কোনো রেস্তোরাঁয় আপনি খেয়ে নিতে পারেন। এরপর কুষ্টিয়া থেকে অটোতে করে শিলাইদহে আসতে পারেন। দুই দিক দিয়ে কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহে যাওয়া যায়।

দ্বিতীয় প্রবেশদ্বার

গড়াই সেতু পার হয়ে অথবা ঘোড়ার ঘাট পার হয়ে। কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহে যাওয়ার রাস্তাগুলোর পরিবেশও অতি মনোরম। ছায়াঘেরা পাখিডাকা রাস্তাগুলো আপনাকে কবিগুরুর সেই গানটার কথা মনে করিয়ে দেবে,‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে।’

এমআরএম/এসইউ/জিকেএস