মতামত

মন্ত্রীস্ত্রীর আত্মীয়ের বিনাটিকিটে রেলভ্রমণ ও পরের কেচ্ছা

রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে তিনজন যাত্রী পাবনার ঈশ্বরদী থেকে বিনা টিকিটে রেলগাড়ির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটি কামরায় চড়ে বসেছিলেন। বিনাটিকিটে ট্রেনযাত্রা বাংলাদেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়। এ রকম ঘটনা হামেশাই ঘটে। ধরা পড়লে কাউকে কাউকে জরিমানা দিতে হয়, কেউ বা টিটিইর সঙ্গে কিছু ‘লেনদেন’ করে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। কিন্তু এবার মন্ত্রীর স্ত্রীর আত্মীয়দের নিয়ে যত নাটকীয় ঘটনার জন্ম নিল, তা বলা যায় কিছুটা ব্যতিক্রম।

Advertisement

ট্রেনের টিকেট পরীক্ষক, অর্থাৎ টিটিই মো. শফিকুল ইসলাম বিনাটিকিটের তিন যাত্রী রেলপথমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় জেনে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পাকশী বিভাগীয় রেলের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (এসিও) মো. নুরুল আলমকে বিষয়টি জানান। এরপর নিয়মানুযায়ী নুরুল আলম সিদ্ধান্ত দিলে শফিকুল ইসলাম তা কার্যকর করেন। তিনি যাত্রীদের কাছে জরিমানাসহ সর্বনিম্ন ভাড়া নিয়ে এসি টিকিটের পরিবর্তে নন- এসির সাধারণ কোচেরটিকেট কাটান।

এ পর্যন্তই যদি ঘটনা থেমে থাকতো তাহলে আর কোনো নাটকীয়তা ঘটতো না, এ বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রিতেও পরিণত হতো না। কিন্তু ওই যাত্রীরা নিজেদের সাধারণ ভাবতে পারেননি। তারা যে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আত্মীয়। টিকিট নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা যাত্রীরা রেলমন্ত্রীর স্ত্রীকে জানালে তিনি রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে একজন ঊর্ধ্বতন  রেল কর্মকর্তার কাছে টিটিই-র বিরুদ্ধে নালিশ করেন। বলেন টিটিই যাত্রীদের সঙ্গে ‘অসদাচরণ’ করেছেন। মন্ত্রীস্ত্রীর নালিশ বলে কথা! সকাল না হতেই টিটিইকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিষয়টি আবার গোপন থাকে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।

রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর আত্মীয়-স্বজনের সম্পৃক্তির কথা অস্বীকার করেন। তবে একই সঙ্গে তিনি যা বলেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমরা রেলসেবা বাড়াতে কাজ করছি। বিনা টিকিটের যাত্রী যদি মন্ত্রীর আত্মীয়ও হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। একইভাবে কোনো রেল কর্মকর্তাও যদি যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে তাকেও শাস্তি পেতে হবে।’

Advertisement

এরপরের ঘটনাবলী অবশ্যই নাটকীয়। রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আত্মীয়দের বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ, জরিমানা, তাৎক্ষণিকভাবে সেই টিটিইকে বরখাস্ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ার ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে রোববার টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে দায়িত্বে বহাল করা হয়। অন্যদিকে বিধিবহির্ভূতভাবে শফিকুলকে বরখাস্তের দায়ে পাকশীর বিভাগীয় কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে শোকজ করা হয়েছে।

রোববার রেল ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। একই সঙ্গে তিনি এ ধরনের কাজে স্ত্রীর সম্পৃক্ততায় বিব্রত বোধ করেছেন উল্লেখ করে রেলমন্ত্রী বলেন, আমি যেভাবে এখানে স্বচ্ছভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি, সেখানে এ ধরনের একটি ঘটনা সেটা যেভাবেই ঘটুক না কেন, আমি অবশ্যই বিব্রত বোধ করছি। আমার বা রেলের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে যেন কেউ রেলে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা না নিতে পারে সে বিষয়ে আমি প্রতি বছর জানুয়ারিতে বিজ্ঞপ্তি জারি করি। গতকালও (রোববার) এ ধরনের একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, টিকিট ছাড়া ভ্রমণ করা যাত্রীরা যে তার আত্মীয়, তা গতকালও (শনিবার) জানতেন না। ভুলভ্রান্তি হলে মানুষ তো সেভাবেই দেখবে। এখানে যদি দেখা যায় আমার স্ত্রী কোনো ভুল করে থাকে… ইয়ে করে থাকে… আমার জানা ছিল না। তবে মেসেজটা যেভাবে গেছে সেটা সঠিক হয়নি। আমার স্ত্রীর যদি রেলের বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকে সে আমাকে বলতে পারতো। এটা না করে সে কেন ডিসিওকে বলতে গেল? তা নিয়ে আমি বিব্রত বোধ করছি।

মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোন পেয়েই টিটিই শরিফুলকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। রিপোর্ট আসলে বোঝা যাবে কার ফোন পেয়ে বা কেন ডিসিও তড়িঘড়ি টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করতে গেলেন। তবে আপাতত বরখাস্তের কারণ জানতে চেয়ে ডিসিওকে আমরা একটা শোকজ চিঠি দিয়েছি। দেখা যাক তার কী জবাব আসে।

Advertisement

রেলমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যমে আত্মীয়… ইত্যাদি নিউজ দেখার পর আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলি। তখন সে বলে টিটিই নাকি ওই (আত্মীয়) যাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানার অর্থ আদায় নিয়ে দুর্ব্যবহার করেছে। সেজন্য তারা অভিযোগ জানিয়েছে। তবে আমার স্ত্রীর বড় বোন বা আত্মীয়রা শনিবার গণমাধ্যমকে যে কথাগুলো বলেছেন সেসব ডাহা মিথ্যা কথা। আমি তাদের ফোনই করিনি।

তিনি বলেন, আমি মাত্র ৯ মাস হলো বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী ঢাকাতেই থাকে। তার নানা বাড়ি না ফুপু বাড়ি ঈশ্বরদী, মাঝে মধ্যে সে সেখানে যায়। আমি সব আত্মীয়কে চিনিও না। আমার স্ত্রীরও এখনো আমাকে ভালোভাবে জানাবোঝা হয়নি'।

মন্ত্রীর এসব কথাকে আমরা সত্য বলে ধরে নিয়ে দুচারটি কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি। রেলের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। টিকেট নিয়ে কালোবাজারির কথা কার না জানা বাকি। ঈদের সময় টিকিট নিয়ে কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রেলমন্ত্রী ‘স্বচ্ছভাবে’ কাজ করার যে কথা বলেছেন তা যথাযথভাবে পালন করার দিকে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে এটাই বলবো যে, কেবল মন্ত্রী একা সৎ থাকলে চলবে না। রেলের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে সততার পরিচয় দিতে হবে। এটা হচ্ছে কি না তা তদারকি করাও মন্ত্রীর কাজের মধ্যেই নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, আমাদের এই অঞ্চলে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার আদিকথা একটু মনে করা যেতে পারে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত রেললাইন চালু হওয়ার পর জল-কাদায় ডুবে থাকা পূর্ব বাংলা প্রথম দেখলো রেল ইঞ্জিনের মুখ। দুটো লোহার পাতের ওপর কয়লার আগুনে কী বিপুল শক্তিতে ছোটে গাড়ি! কামরার সঙ্গে কামরা জুড়ে দিয়ে এক বৃহৎ সরীসৃপের রূপ নিয়ে ছুটে চলে ট্রেন।

‘পথের পাঁচালি’র অপু দুর্গারা কাশবনের ফাঁক দিয়ে অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে দেখে সেই ট্রেন। ১৬০ বছর ধরে বাঙালির সেই মুগ্ধতা কাটেনি। কত গান কত গল্প কত অমর সাহিত্য রচনা হয়েছে রেলব্যবস্থাকে ঘিরে। নদীনালায় বিচ্ছিন্ন বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদকে রেলপথ একত্র করেছে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ পৌঁছে দিয়েছে তৃণমূলে। রেলের সঙ্গে পৌঁছেছে ডাক আর টেলিগ্রাফ। পণ্য সরবরাহ সহজ হয়ে উঠেছিল রেলব্যবস্থার কারণে।

উন্নত সড়ক যোগাযোগ না থাকায় এক সময় রেলের কোনো বিকল্প ছিল না। জনগণ ব্যাপক হারে ট্রেন ব্যবহার করতো। ফলে লোকসান তেমন প্রকট হয়নি। দিন দিন যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের সঙ্গে রেলের ওপর নির্ভরতা কমে আসতে থাকে। বিশেষ করে পণ্য পরিবহন দ্রুত কমে আসায় রেলের লোকসানের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলছে।

সামরিক স্বৈরশাসক ও গণবিরোধী সরকারগুলো পরিবহন মালিকদের স্বার্থে একপর্যায়ে রেলের ওপর নির্ভরতার নীতি থেকে সরে এসে সড়কের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ায় আমাদের রেলখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেল যোগাযোগ ভেঙে পড়েছিল। অনেক লাইন, স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে লোকসানের অভিযোগে। শ্বেতহস্তীর মতো এই বিশাল ব্যবস্থা সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে দাতা সংস্থাগুলো ছিল বেসরকারিকরণের পক্ষে। সে সময় বলা হতো রেলওয়ে বিনিয়োগের অভাবে লোকসান করছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে আবার রেলওয়ের দিকে নজর ফেরানো হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নে গত ৫ বছরে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। বর্তমানে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান রয়েছে ৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্প।

এটা ঠিক যে, রেলওয়ে ব্যবস্থাটি অন্য যেকোনো পরিবহনব্যবস্থা থেকে ব্যয়বহুল। অন্য কোনো পরিবহন খাতে সেবাদাতা সংস্থাকে পরিচালনের সঙ্গে সঙ্গে পথ রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করতে হয় না। এমনকি অন্য পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তাও রেলকে দেখতে হয়। বিভিন্ন সড়কের ওপর লেভেল গেট বসিয়ে সড়কের নিরাপত্তা বিধান করতে হয়। তাই নিরাপদ এই পরিবহনব্যবস্থা মোটেও সাশ্রয়ী নয়। কিন্তু এটিকে জনগণের কাছে সাশ্রয়ী হিসেবে পৌঁছে দিতে হয়। এর ফলেই লাভ-লোকসানের দ্বন্দ্বটা শুরু হয়। যেসব দেশে রেল খাতে যাত্রী পরিবহনে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না, সেখানেই দেখা যায় সড়কপথ থেকে রেলপথের যাতায়াত খরচ বেশি। তবে রেল পরিচালনে সৃজনশীলতা প্রয়োগ করা গেলে ভর্তুকি দিয়েও রেল লাভ করতে পারে।

যার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ প্রতিবেশি দেশ ভারত। রেলওয়ের সম্পদের সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক ব্যবহার করছে ভারতীয় রেলওয়ে। বাংলাদেশ রেলেরও প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নজরদারির অভাবে তার কিছু কিছু বেহাত বা দখল হয়ে গেছে হয়তো। এখন সময় এসেছে, নিজের সম্পদের সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে রেলকে সময়োপযোগী একটি সচল ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার। প্রয়োজন শুধু সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের। নুরুল ইসলাম সুজন কি সেই নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবেন?

প্রায় ষাট বছর আগে ভারতের রেলমন্ত্রী ছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। সততা ও সাধারণ জীবনযাপনের কারণে তিনি এখনো ভারতের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনেই আছেন। সুজনের সামনেও তেমন সুযোগ আছে। শেষ করতে চাই একটি গল্প দিয়ে। রেলওয়ের একজন সিগনাল ম্যান বিয়ের পর স্ত্রীকে বললো, জানো আমার কত ক্ষমতা? স্ত্রী বিস্ময়ের চোখে তাকালে সিগনালম্যান বলে, আমি হাত তুললেই চলন্ত ট্রেন থেমে যায়।

স্ত্রীর চোখেমুখে অবিশ্বাস। তখন সিগনালম্যান স্ত্রীকে নিয়ে গেল রেললাইনের ধারে। একটি ট্রেন আসতে দেখে সিগনালম্যান পকেট থেকে লাল কাপড় বের করে ঝোলাতে থাকে। ট্রেনটি থেমে যায়। ট্রেনের চালক নেমে এলে একটু দূরে গিয়ে স্ত্রীর কাছে তার ক্ষমতা দেখানোর বিষয়টি বলে। চালক ক্ষিপ্ত হয়ে সিগনালম্যানের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে গজগজ করে ট্রেনের ইঞ্জিনে ওঠে আবার চালাতে শুরু করে থেমে যাওয়া ট্রেনটি।

স্ত্রী দূর থেকে সব দেখেছে। স্বামী কাছে এলে জানতে চায় তার গালে কেন চড় মারলো ওই লোকটা।স্বামী শান্তভাবে জবাব দিল : আমার ক্ষমতা আমি দেখিয়েছি। ও ওর ক্ষমতা দেখিয়েছে।

আমাদের দেশে চলছে ক্ষমতা দেখানোর নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। মন্ত্রী এমপি নেতা পাতি নেতারা শুধু ক্ষমতার দাপট দেখায় তা নয়, তাদের নিকট ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়রাও ক্ষমতা দেখাতে ভুল করে না। অথচ সব ক্ষমতার উৎস যে জনগণ, সংবিধানে যাদের দেশের মালিক বলে উল্লেখ করেছে, সেই জনগণের কোনো সুযোগ নেই ক্ষমতা দেখানোর। কিন্তু জনতা যখন রুখে দাঁড়াবে তখন পরিস্থিতি কি খুব মধুর বা সুখকর থাকবে?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস