মতামত

বাংলাদেশের ৫০ বছরে পাক প্রোপাগান্ডা

বাংলাদেশের ৫০ বছরে পাকিস্তানের চাওয়া-পাওয়া কি? গত অর্ধ শতক তাদের আচরণ, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তির প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? বিভিন্ন সূচকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশটিকে ছাপিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পররিবর্তন এসেছে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুব বেশি দূর যাওয়ার দরকার পড়ে না। কেবল সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে বাইনোকুলার রাখলেই কিছু জবাব মেলে।

Advertisement

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে। ‘খেল খেল ম্যায়’ নামের সিনেমাটি মুক্তি দেয়ার জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর সময়টিকেই, ২০২১ সাল। পাকিস্তানের বাণিজ্যিক ধারার এই সিনেমায় প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন সজল আলী ও বিলাল আব্বাস খান। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন পাকিস্তানের খ্যাতনামা নির্মাতা নাবীল কুরেশি। এর গল্প লিখেছেন ফিজা আলি, মীর্জা ও নাবীল কুরেশি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা নিরীহ বাংলাদেশিদের ওপর হামলা চালায়।

বাঙালিদের ওপর পৈচাশিক নির্যাতন চালায় পাকিন্তানি বাহিনী। যুদ্ধ চলে দীর্ঘ নয় মাস। এরপর জন্ম লাভ করে নতুন এক বাংলাদেশ। আর লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করে পাকিস্তান। ভালো দিকটি হল নিজেদের কুকর্ম পাকিস্তান তুলে ধরছে তাদেরই সিনেমায়। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ‘খেল খেল ম্যায়’-এ দুটি প্রজন্মকে দেখানো হয়। একটি প্রজন্ম যারা বাংলাদেশির বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছিল। এরপর পাকিস্তানে বাংলাদেশিদের নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিথ্যাচার চালানো হয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম আসল সত্যটা জানতে চায়।

গত বছরের ৩০ অক্টোবর সিনেমাটির প্রথম টিজার প্রকাশ পায়। যা দেখে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার একটি চেষ্টা রয়েছে। কিন্তু মোরাল অব দ্য স্টোরি হল এই মুক্তির সংগ্রামেও ভারতের ষড়যন্ত্র খুঁজে পায় তারা। আর সবশেষ বক্তব্য হল, যা হবার হয়েছে, এবার আমরা মিলেমিশে চলি। কিন্তু এতটা সহজেই কি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ ভুলে থাকা সম্ভব?

Advertisement

প্রোপাগান্ডার এই চালটি খানিকটা বুদ্ধিদীপ্ত হলেও শেষের অতি সরণ সমীকরণ আর ভারত বিদ্বেষ ঘোলা করে দিয়েছে আবেদনটিকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশে বিদেশি শিল্পীদের শুটিংয়ের যে অনুমতিপত্র নিতে হয় ছবিসংশ্লিষ্ট কেউই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তানের কোনও প্রযোজক আবেদন করেননি। মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্বে থাকা উপসচিব মো. সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ‘খেল খেল ম্যায়’ চলচ্চিত্রটির বিষয়ে তিনি অবগত নন।

ইউটিউব ব্লগিং এক নতুন ট্রেন্ড। ব্লগিং এর এই ধরনটি ইতোমধ্যেই তরুণদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই ট্রেন্ডে যুক্ত হয়েছেন পাকিস্তানের বেশ কটি গ্রুপ। এঁরা মূলত বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ভিডিও দেখে খুশি খুশি প্রতিক্রিয়া দেন। এই ধরনটির নামই রি অ্যাকশন ভিডিও। জানা কথা বাংলাদেশে ফেসবুক এবং ইউটিউব তথা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যে উচ্চ গতির সাথে বাড়ছে তাতে এই প্রক্রিয়ায় প্রোপাগান্ডা টিম যুক্ত হতে চাইবেই। যথারীতি এই ভিডিও গুলো বাংলাদেশ থেকে দেখাও হয় প্রচুর।

কূটনৈতিক তৎপরতা গত বছরের পুরোটা সময় ধরেই ছিল। বাংলাদেশ বার বার আহ্বান জানালেও পাকিস্তান এখনো ক্ষমা না চাওয়ার ব্যাপারে অনড়৷ ২০০৯ সালে পকিস্তানের দূত আলী বাসার খান দেখা করতে এলে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাথে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন৷ কিন্তু আলী বাসার বলেন, ‘পকিস্তান ক্ষমা চাইবে না৷’ ২০২১ সালের অক্টোবরে ঢাকায় পাকিস্তান দূতবাসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়৷ ৯ অক্টোবর ঢাকায় পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর প্রতিবাদ জানালে তারা ভিডিওটি সরিয়ে ফেলে৷

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের একটি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করা হয়৷ গত বছরের ১৬ই মে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘‘ঢাকায় পাকিস্তানি অপতৎপরতা”শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু করেছে। মূলত আইএসআই নেপথ্যে থেকে ওই গ্রুপের মাধ্যমে ধর্মকে পুঁজি করে প্রতিনিয়ত নানা প্রচারণা চালাচ্ছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাটি কিছু স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে ভুল তথ্যের পাশাপাশি বানোয়াট তথ্য প্রচার করছে।

Advertisement

গত মার্চে (২০২১) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ইসলামপন্থী বিক্ষোভে মদদ ও সংগঠিত করার সঙ্গে পাকিস্তানের নাম জড়িয়ে পড়ার কথা শোনা যায়। সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্যবাদীদের যোগসাজশে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালানো হয়। ওই নাশকতায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রচার রয়েছে। নাশকতার ওই ঘটনার তদন্তে হেফাজতে ইসলামের একাধিক নেতার সঙ্গে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগসাজশের অভিযোগ এসেছে। ঢাকার বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আইএসআই তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্যের ওপর বিশেষভাবে পুঁজি করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নানা ধরনের ভুল তথ্য, খবর এবং অপপ্রচার সঠিক তথ্যের চেয়ে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

গত বছর (২০২০) মধ্যপ্রাচ্যে আইএসআইয়ের এ ধরনের প্রোপাগান্ডা চালানোর বিষয়টির তথ্য জানা যায়। এরপরই টুইটারের একটি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে দেখা গেছে, ভারতের বিরুদ্ধে আইএসআইয়ের হয়ে টুইটারের অ্যাকাউন্টটি চালানো হতো। সুশীল তৎপরতাতেও পিছিয়ে নেই দেশটি। বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মী, বিশ্লেষক, গবেষকদের দিয়ে বলা হচ্ছে ‘দেখো বাংলাদেশ কোথায় গিয়েছে। আমাদের শেখা উচিত।’ কিন্তু আসলেই কি শিখতে চান তারা তা পরিষ্কার নয়।

একাত্তরে গণহত্যা চালানোর ঘটনায় অনেক পাকিস্তানি বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সমর্থন করেন বলে গত বছর জানান হুসেন হাক্কানি, যিনি পাকিস্তানের দূত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ছিলেন। বর্তমানে হাডসন ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিভাগের পরিচালক হুসেন হাক্কানি রবিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি কনফারেন্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে হাক্কানি বলেন, ‘এই দাবি সবার, যারা বিশ্বাস করে সমষ্টিগত ক্ষমাপ্রার্থনা কষ্টমোচন করে এবং দুই দেশের মধ্যে ভুলে ভরা অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।’

রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড পিস কনফারেন্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরি, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন, সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গো চক টং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তবে নিজে কূটনীতিক থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে কি উদ্যোগ, পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন তা তিনি জানাননি। কিন্তু বাংলাদেশের চাওয়া কি? ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে- এটিই পাঁচ দশক ধরে বলে আসছে বাংলাদেশ। যার কোনো প্রতিফলন পাক প্রোপাগান্ডায় পরিষ্কার করতে দেখা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

এইচআর/জিকেএস