মতামত

জাপায় চলিতেছে সার্কাস

কোনো একটি টেলিভিশন চ্যানেলে একটি ধারাবাহিক নাটকের বিজ্ঞাপন মাঝে মাঝেই শুনি। খুব সম্ভবত নাটকটির নাম ‘চলিতেছে সার্কাস।’ জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থায় ওই নাটকের নামটিই বারবার মনে আসছে। এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল এরশাদ যতদিন দলের কর্ণধার থাকবেন ততদিন সার্কাস চলতেই থাকবে। ৩০ বছরের পুরানো এই দলটির অস্তিত্বও নির্ভর করছে  এরশাদের অস্তিত্বের ওপর। ১৯৮৬ সালে ক্ষমতায় থেকে সামরিক শাসনামালে জন্ম দেয়া এই দলটি এরশাদের অবর্তমানে যে হারিয়ে যাবে তা ৩০ বছরের জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।সবশেষ জাতীয় পার্টিতে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে বা এখন যে সার্কাস চলছে সেটি হল দলের উত্তরসূরি নির্ধারণ। এই পর্বে এরশাদ রংপুরে বসে হুট করেই ঘোষণা দেন তার ভাই জিএম কাদের হবেন তার রানিংমেট। দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে কো-চেয়ারম্যান বলে কোনো পদ না থাকলেও জিএম কাদেরকে ওই পদে আসীন করা হয়। এদিকে ঢাকায় তার স্ত্রী রওশন এরশাদ বসে থাকবেন কেন? উনি মনে করেন এরশাদের পরেই দলে তার অবস্থান থাকা উচিত। তিনিতো সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী বটে। হতে পারে রওশনের মাথা থেকে এই বুদ্ধি আসেনি, কিন্তু তাকে ঘিরে যে বলয়টি তৈরি হয়েছে তারাই রওশনকে এরশাদের রানিংমেট বানাতে চাচ্ছেন। তাই তাকে এরশাদের অনুপস্থিতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। যেটিকে এরশাদ অবৈধ সিদ্ধান্ত বলে জানান। রওশনকে এরশাদের উত্তরসূরি বানানোর কারিগর দলেরই মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু। এরশাদ এটি জানতে পেরে তাকে মহাসচিব পদ থেকেই সরিয়ে দিয়ে আগের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে ওই পদে বহাল করেন। রওশনের পক্ষের গ্রুপ এরশাদের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে। এরপর হয় দুপক্ষের বৈঠক। বৈঠক শেষে এরশাদ বলেছেন, ‘আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেই সিদ্ধান্তে অটল আছি। মরার আগ পর্যন্ত অটল থাকব।’ সার্কাসের পরবর্তী দৃশ্যপট জানতে আমাদের আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। এরশাদ বলেছেন মরার আগ পর্যন্ত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। তাহলে বলতে হবে এরশাদ এ পর্যন্ত কতোবার মরেছেন। এরশাদ যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন অর্থাৎ চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর- সিএমএলএ হন, তার কিছুদিন পরেই তার সহকর্মীরা সিএমএলএ’র অর্থ দাঁড় করান এভাবে-ক্যান্সেল মাই লাস্ট এনাওন্সমেন্ট। তাই এটা বলাই যায় মরার আগ পর্যন্ত তার সিদ্ধান্ত কতোবার পরিবর্তন হবে সেটা তিনি নিজেও জানেন না। আমরা যদি জাতীয় পার্টির জন্মের কুষ্ঠি ঘাঁটাঘাঁটি করি তাহলে দেখতে পাই বিভিন্ন দল থেকে কিছু ক্ষমতালোভি ব্যক্তিকে নিয়ে এসে তিনি ৩০ বছর আগে সামরিক শাসন চলাকালেই দলটির জন্ম দেন। সবচেয়ে বেশি বিএনপি থেকেই তিনি লোক ভাগাতে সক্ষম হন। এরশাদ যখন সেনাপ্রধান তখন থেকেই নানা ছক আঁকতে শুরু করেন কিভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবেন। জেনারেল জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর স্বপ্ন বাস্তবের কাছাকাছি চলে আসে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে তখন বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি হলে এরশাদ সেনাপ্রধান পদে থেকেই সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদারিত্ব দাবি করেন। খুব সম্ভবত কোনো একজন সেনাপ্রধানের প্রকাশ্যে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ভাগ বসানোর দাবি করার নজির পৃথিবীতে তিনিই সৃষ্টি করেন। ক্যান্টনমেন্টে বসে পত্রিকা সম্পাদকদের ডেকে তিনি এক রকম সংবাদ সম্মেলন করেই সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রক্ষমতায় ভাগ দিতে বলেন। এর তিন মাসের মাথায় রাষ্ট্রক্ষমতা তিনি সম্পূর্ণই দখল করে নেন। এরপর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে জেনারেল জিয়াকে অনুসরণ করেন। জিয়া যেমন প্রথমে জাগদল করে পরে জাতীয়তাবাাদী দল তৈরি করেন সামরিক শাসক থাকা অবস্থায়, তেমনি এরশাদ প্রথমে জনদল করে পরে জাতীয় পার্টির জন্ম দেন। ১৯৮৬ সালে জন্মের পর এ পর্যন্ত অন্তত ১০ বার দলটি ভেঙ্গেছে। প্রতিটি ভাঙ্গনই ক্ষমতার ভাগ বসানো বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট। জাতীয় পার্টি নামে এখনো দল আছে পাঁচটি। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনই আছে চারটির। দলটিতে প্রথম ভাঙন ধরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে এরশাদের কারামুক্তির শর্তে জাতীয় পার্টি সমর্থন দেয়। সেসময়  আনোয়ার হোসেন মঞ্জু শেখ হাসিনার কেবিনেটের সদস্য হন। পরে এরশাদ মঞ্জুকে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বলে বিএনপির সাথে মিলে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করেন। মন্ত্রিত্ব না ছেড়ে মঞ্জু ১২ জন সংসদ সদস্যসহ আলাদা হয়ে যান। এরই মধ্যে একবার এরশাদের কথিত বান্ধবী জিনাত মোশাররফকে ঘিরে দলের মধ্যে ভাঙ্গন ধরে। সেটির নেতৃত্ব দেন কাজী জাফর আহমদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তারা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলন করেন। তখন কাজী জাফর বলেছিলেন এরশাদ একটা দুর্গন্ধযুক্ত মরা পচা রাজনৈতিক লাশ। এরশাদ জবাব দিয়েছিলেন এ বলে যে, তিনি চিনি চোর বলে খ্যাত একজনকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে ভুল করেছিলেন। অবশ্য এর কিছুদিন পর এরশাদ আর কাজী জাফর কোলাকুলি করে আবার এক হয়ে গিয়েছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন ধরে। এরশাদ ওই সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদল থেকে বের হয়ে আলাদা নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিলে নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে জোটের সাথেই থেকে যায়। পরে ওই দলটির নাম দেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও জাতীয় পার্টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়েছিল, পরে অবশ্য এ দুটি অংশই এরশাদের নেতৃত্বে এক হয়ে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আবার কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন বিএনপি-জোটে।     ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর রওশন এরশাদ বিরোধী দলীয় নেত্রী ও দলের তিনজন মন্ত্রী হলে দলের মধ্যে দুটি বলয় তৈরি হয়। রওশন হয়ে পড়েন সরকারপন্থি। অথচ ১৯৯৬ সাল থেকে যখন আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সখ্য তৈরি হয় তখন থেকেই রওশন বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জাতীয় পার্টির মধ্যে নানা সময়ের ভাঙ্গনের এই ইতিহাসই বলে দিচ্ছে কখনোই দলটি নিজস্ব নীতি নিয়ে এগুতে পারেনি। সব সময় কারো না কারো সাথে থাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছে।জাতীয় পার্টির এবারের সংকটও ক্ষমতা কেন্দ্রিক। দলের তিনজন মন্ত্রী আর মন্ত্রীর মর্যাদায় বিরোধী দলীয় নেতার প্রটোকলের লোভ সামলানো তাদের পক্ষে কঠিন। তাই এরশাদ যতোই বলুন না কেন জাতীয় পার্টিকে প্রকৃত বিরোধী দল হতে হবে ততই হাস্যকর হয়ে ওঠে যখন তিনিও মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদটি আঁকড়ে আছেন। তারও আছে ক্ষমতার সাধ। এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যখন দল গঠন করেন তখন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দল থেকে কিছু নেতা এই দলে এসে মন্ত্রী হয়ে আবার ফিরে গেছেন। এরশাদের পতনের পর দলটি ক্রমেই ক্ষয়ের দিকে এগুতে থাকে। ৯১ সালের নির্বাচনে চরম বৈরী পরিবেশে সংসদে ৩৫ টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। ১৯৯৬ সালে ৩৩টি, ২০০১ সালে ১৭টি ২০০৮ সালে ২৭টি আসন পায়। সর্বশেষ স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনে জাতীয় পার্টির দু-চারজন ছাড়া কেউ জয়ী হতে পারেননি। তাই গত পৌরসভার নির্বাচনের আগে এরশাদ নিজেই দুঃখ করে বলেছিলেন মনোনয়ন দিতে তিনি কোনো প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছেন না। ৩০ বছরের পুরোনো এই দলটি আজো নিজস্ব কোনো নীতি দাঁড় করাতে পারেনি। ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, এরশাদের একার হাতে সব ক্ষমতা রাখা, অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন দেয়া, মামলার ভয়ে সরকারের সাথে আপস করা, কথায় কথায় মহাসচিব পরিবর্তন করা, হালুয়ারুটির ভাগ পেয়ে দলত্যাগ করা সর্বোপরি এরশাদের দিনেরাতে নীতি পরিবর্তন করার কারণেই দিনকে দিন দলটির অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। এরশাদ হয়তো এখন বলছেন মনোনয়ন দেয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না, কিছুদিন পর তাকে বলতে হবে দল করার জন্যই কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। এইচআর/পিআর

Advertisement