অরলান্ডোর রাস্তায় ট্রাফিক বাড়ছে আজকাল। অফিসে যাবার আধা ঘণ্টার রাস্তা প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যায়।
Advertisement
ট্রাফিকে আটকে থাকা সময়টা খানিকটা শাপেবর হয় আমার জন্য। আমি প্রতিদিন সকালে গাড়িতে করে কাজে যাবার পথে মা-বাবার সাথে কথা বলতে বলতে যাই। এটি আমার অনেক দিনের অভ্যাস। আমার সুখ-দুঃখ, নিত্যদিনের বাধা-বিপত্তির গল্প করি। মায়ের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব আছে। কোনো না কোনোভাবে তার সাথেই কথা বেশি হয়।
যেদিন সকালে অরলান্ডোর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ে, আমি আমার মায়ের সাথে বৃষ্টি বাদলের গল্প করি। সে গল্পজুড়ে থাকে বৃষ্টিমুখর দিনে মতিঝিল এজিবি কলোনির বারান্দায় বসে আমাদের পুরোনো সেসব দিনের স্মৃতিচারণ, নড়াইলের চিত্রা নদীর বুকে বৃষ্টির মাঝে নৌ ভ্রমণের গল্প। কিংবা নানাবাড়ির বৈঠক ঘরে বসে নানির ভাঙা রেকর্ডের গান শোনার সাথে নারকেলের নাড়ু খাবার গল্প।
যেদিন সকালে অরলান্ডোর শহরজুড়ে চকচকে রোদ ওঠে, আমি আমার মায়ের সাথে রোদলা দিনে খড়রিয়ার বিলের গল্প করি। সে গল্পজুড়ে থাকে ফেদা মামার নৌকা বাইচের স্মৃতি, ফরিদ মামার সাথে শিকারে যাবার নেশার হাতছানি। আমাদের দীঘির বুকে নৌকা চালানোর স্মৃতিচারণ করেন আমার মা। এ জনমে আবার দেখা হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। দুজনেই চুপ করে থাকি খানিকক্ষণ। তখন মা জিজ্ঞেস করেন: “কাজে পৌঁছে গেছো বাবা?”
Advertisement
আমার মনে আছে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে যখন আফ্রিকার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাড়লাম আমার মা আমার স্যুটকেসে দু'কেজি চালের একটা প্যাকেট দিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন বাবা তোর ভাতের কষ্ট যেন না হয় ওই জীবজন্তুর দেশে। সেসব কথা নিয়ে আজও একগাল হাসি আমরা। জাম্বিয়ার এক প্রত্যন্ত শহর মজবুকতে ছিলাম বেশ কিছুটা সময়। তখন আমার ডাক বাংলো থেকে প্রায় প্রতিদিন রাত দুপুরে প্রশ্ন করতাম তাকে রান্নার রেসিপি নিয়ে। আজও করি। তার রন্ধন প্রণালীর নিখুঁত বর্ণনা শুনে আমি অনেক স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়ি অনেক নিচে।
আমার মা নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে তাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম নায়েগ্রা জলপ্রপাতে। একটা ছোট জাহাজ করে যখন জলপ্রপাতের কাছাকাছি পৌঁছলাম আমার মা তখন চিৎকার করে তারস্বরে গান গেয়ে উঠেছিলেন। আমার মা সাধারণত গান গান না। তবে তিনি গানের একনিষ্ঠ শ্রোতা। আমার বাবা গলা ছেড়ে গান গাইতেন আমাদের মতিঝিলের বাসায়। আমার মা মুড়ি মেখে আনতেন। কিংবা ভাজা পিঠে। আমার সব প্রিয় গানের সাথে মায়ের মমতা মাখা।
আমার সারাজীবনের শখ বিশ্বমানব হবার।রসে শখটি বুনে দিয়েছিলেন আমার মা। ভূগোল পড়াবার সময় খুব মজা করে সারা দুনিয়ার গল্প বলতেন তিনি। আমি মুগ্ধ হয়ে তা শুনতাম। আর তাই আমাজনের উৎস খুঁজতে ছুটে বেড়াই ইকুয়েডরের বানিওসে, তিব্বতের লাসায় খুঁজে বেড়াই ব্রহ্মপুত্রের উৎস আর কাঞ্চনজঙ্ঘায় খুঁজি হিমালয়।
আমাদের মেয়ে আমাদের ছেড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গিয়েছে। ছেলেটিও সে সুযোগ পেয়েছে।কিছুদিন পর ছেলেও তার সাথে চলে যাবে। মাঝে মধ্যে মাকে আমার উৎকণ্ঠার কথা বলি। আমার মা আমাকে সান্ত্বনা দেন সবসময়। মনে করিয়ে দেন তার জীবনের সবচে' সুখের দিন ছিল যেদিন আমি চিকিৎসক হলাম। আর আমার জীবনেও যেন সে দিন আসে সে প্রার্থনা তিনি করেন সব সময়। আমাকে কাছে না পাবার দুঃখকে তিনি বরণ করে নেন আমার জীবনের সব প্রাপ্তির কাছে। কঠিনেরে ভালোবেসেছেন তিনি।
Advertisement
এবার ঈদের দিন বললেন , এ রমজান মাসে আমি দিনে রাতে বেশি বেশি করে কোরান খতম করে তোমাদের জন্য প্রার্থনা করছি। জানিনা আগামী রমজানে থাকবো কিনা।' আমার গলা ধরে আসে এসব কথা শুনলে। আমি ওসব শুনতে চাইনা।
প্রতিদিনই আমার মায়ের দিন। আমার মা আমার হৃদয়জুড়ে থাকেন প্রতিদিন। মধুর আমার মায়ের হাসিতে হেসে ওঠে আমার প্রতিটি দিন।
এইচআর/এমকেআর