ঈদের আগে ঢাকা ঘুরে গেছেন ভারতের পররাষ্টমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তার আসার আগে কয়েকটি পত্রিকা শিরোনাম করেছিল, ‘সুখবর নিয়ে আসছেন জয়শঙ্কর’। কিন্তু কি সেই সুখবর সেটি তাঁর চলে যাওয়ার পরও পরিষ্কার করেনি সেই সব পত্রিকা। মনে হচ্ছে এই সফরের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের দিনক্ষণ ঠিক করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো জুলাইয়ে ভারত সফরে যাবেন। ২০১৯ সালের পর তিনি আর ভারত সফরে যাননি। এর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।
Advertisement
ভারতের মতো নিকট প্রতিবেশি দেশের এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর আলাদা গুরুত্ব বহন করে। সবাই উৎসাহী হয়, জানতে চায় বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলোর কতটুকু কী হলো। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। কোন সফরেরই তাৎক্ষণিক কোনো লাভালাভের হিসাব মেলানো সহজ হয় না। দুই পররাষ্টমন্ত্রী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, উভয় দেশের সম্পর্ক আরও মজবুত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে তিনি ভুটান গেছেন এবং সেটারও কারণ আছে। এ অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বাণিজ্য সম্পর্কিত সহযোগিতার বিষয়টি (বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান) একটা ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা রয়েছে ভারতের দিক থেকে।
ভারতের সঙ্গে যতগুলো ইস্যু অসমাপ্ত রয়ে গেছে তার অন্যতম তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা। ঢাকার সঙ্গে দিল্লির তিস্তার পানির ব্যাপারে একটা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এই সমস্যা সমাধানে খুব একটা আলোচনা যে এ সফরেও হয়নি সেটা বোঝা গেছে। তিস্তার যে পানি পশ্চিমবঙ্গে আছে, বিশেষ করে শীত মৌসুমে এর বণ্টন নিয়ে সমঝোতার জন্য আরও জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা জরুরি।
ভারত সর্বাগ্রে তার স্বার্থ দেখবে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রতিবেশির সঙ্গে সহযোগিতা-সহমর্মিতার আবহ তৈরি করাও তার দায়িত্ব। নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যায় বা কেন্দ্র-রাজ্য জটিলতায় বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য আচরণ পাচ্ছে না, সেটা ভারতকেই সমাধান করতে হবে।
Advertisement
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে। সেই বিবেচনাতেই বলা চলে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বেশ কিছু ইস্যুর সমাধান আলোচনার টেবিলে রয়ে গেছে। তার মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়টি একদমই এগুতে পারছে না। এই পানি বণ্টনের বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করা দরকার। ভারত বিপুল পরিমাণে বাঁধ নির্মাণ করছে সিকিমসহ আরও উজানে। এর ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পানির পরিমাণ আরও কমতে থাকবে। এই ইস্যুটিকে বাংলাদেশের দিক থেকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।
আরেকটি বড় ও স্পর্শকাতর বিষয় হলো সীমান্ত হত্যা। সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা বন্ধ করার আনেক প্রতিশ্রুতি ভারতের কাছ থেকে পাওয়া গেলেও তা বন্ধ হয়নি, যদিও কমেছে খানিকটা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দৃষ্টান্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। গর্হিত কাজ যদি সীমান্তে কেউ করে তাহলে তাকে আটক বা বন্দি করা যেতে পারে, হত্যা নয়। অভিযুক্ত বিচারে যে দণ্ডে দণ্ডিত হবে তা কার্যকর হলে প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু যখন তখন গুলি করে হত্যা নাগরিক মনে যে রেখাপাত সৃষ্টি করে তা দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলে।
জয়শঙ্করের ঢাকা সফরের সময় আমাদের দুই দেশের ইস্যু নয় এমন একটি বিষয়ও আলোচনায় উঠে এসেছে। সেটি হলো র্যাবের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। এ ব্যাপারে জয়শঙ্করকে সাংবাদিকরা প্রশ্নও করেছেন এবং ঝানু কূটনীতিকের মতোই তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নটি এসেছে কারণ, আমাদের পররাষ্টমন্ত্রী বলেছিলেন, এ ব্যাপারে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হবে। বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হয়নি।
সমস্যা সরাসরি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের, সেখানে কেন ভারতকে জড়িত করার ভাবনা এলো? ভারত নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক বিষয়ে দ্বিমত করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের সময়টাতেও আমরা সেই দূরত্ব দেখছি। বিচারবহির্ভূত হত্যা, বা গুম যেটাই হোক, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আমাদের নিজেদেরই অঙ্গীকার। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র কী অভিযোগ করলো বা না করলো, তার চাইতেও বেশি জরুরি নিজেদের অবস্থার উন্নতিতে মনোনিবেশ করছি আমরা।
Advertisement
জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্বেগ নিরসনে নয়াদিল্লি সাধ্য মতো চেষ্টা করবে। ভারতীয় সহায়তায় চলা বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রকল্প দ্রুত শেষ করার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার কথাও বলেছেন তিনি। তার ভাষায় এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কোভিড মহামারির চ্যালেঞ্জের মধ্যেও নিয়মিত ভাবে দুই সমন্বয় বজায় রেখে চলেছে। আমাদের অমীমাংসিত ইস্যু আছে, আবার সম্ভাবনাও অনেক। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই উপমহাদেশ এবং এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ঘিরে বাণিজ্যিক ও রাজনীতির নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ এ অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের চালচিত্র পাল্টে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতকে এসব দিকে গভীর দৃষ্টি রাখতে হবে নিজেদের স্বার্থেই। দুই প্রতিবেশির সুন্দর সম্পর্কের বিষয়টি এ মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জয়শঙ্কর নিজে যেমনটা বলেছেন. “প্রতিবেশি হিসেবে নিয়মিত, আনুষ্ঠানিক ও আন্তরিক আলোচনা দুই দেশের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কের প্রতিফলন। ”
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস