দেশজুড়ে

দুই ছেলে থেকেও নেই বিধবা ঝলকির

‌‘কাইলকে আইতের মধ্যে ফেতরার চাউল তুলি আইনছোং এক কেজি। টেহা দিছে পয়ষট্টিটে। এক কেজি নবন আইনছোং আর ফেতরার চাউল আনিয়া হাফ কেজি আন্দিছোং। পাশের বাড়ি থাকি তহাই (তরকারি) দিছে। তাহে দিয়া অর্ধেক ভাত খাইছোং, বাকি অর্ধেক ভাত পানি দিয়া ভিজি আইখছোং। সকালে মাইনষে ভাত দিছে তাহে খাইছোং আর দুপরে পনতা খানু।’

Advertisement

এমনি করে কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধা ঝলকি (৬৫)। কথাগুলো বলার সময় বারবার তিনি বলছিলেন, বাবা খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয় না। শরীর অসুস্থ, তাই কথা আটকিয়ে যায়।

ঝলকি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পার্বতীপুর গ্রামের মৃত নান্টু শেখের স্ত্রী।

ঈদের দিন মঙ্গলবার (৩ মে) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বসতঘরের ভেতরে একটি গামলাতে করে বাসি-পান্তা ভাত খাচ্ছেন ঝলকি। পাতে কোনো তরকারি নেই। হাতের মুষ্টিতে থাকা পান্তা পেটে না গেলেও ক্ষুধা নিবারণে অনেকটা জোর করে মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তিনি।

Advertisement

ঘরের মাঝে একটি চৌকি বসানো। চৌকিতে নেই বিছানাপত্র। ঘরের জিনিসপত্র চারদিকে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ঘরের ভেতরটা অনেকটাই বসবাসের অযোগ্য।

স্থানীয়রা জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর এক কষ্টের জীবন শুরু হয় ঝলকির। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এলাকাবাসীর কাছে সহযোগিতা নিয়ে একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আব্দুল জলিল প্রায় ৩০ বছর আগে কর্মের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে আর বাড়িতে ফেরেননি। সেখানেই বিয়ে করে সংসার বেঁধেছেন। মায়ের খোঁজ নেন না।

ছোট ছেলে শামসুলও বিয়ে করার পর ঢাকায় গিয়ে দিনমজুরের কাজ করছেন। তার ঘরে চার সন্তান মিলে সংসারে মোট ছয় সদস্য। ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে অক্ষম শামসুল। তাই মা ঝলকিরও ভরণপোষণ চালাতে পারেন না তিনি।

পরপর পাঁচবার আগ্রাসী ব্রহ্মপুত্রের কবলে বাড়িভিটা হারিয়েছেন ঝলকি। নদীভাঙনে নিঃস্ব ঝলকি ছন্নছাড়া হয়ে পড়লে প্রতিবেশী মোস্তফা মানবতার হাত বাড়িয়ে দেন। নিজ বসতভিটায় আশ্রয় দেন অসহায় ঝলকি ও তার ছেলে শামসুলের পরিবারকে। ঝলকি এনজিও আরডিআরএস থেকে পাওয়া ত্রাণের টিন দিয়ে ঘর তোলেন সেখানে।

Advertisement

জীবন-জীবিকার তাগিদে নিরুপায় ঝলকি শুরু করেন দিনমজুরের কাজ। কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বার্ধক্য। দিনমজুরের কাজ করতে গিয়ে কোমরে আঘাত পেয়ে বর্তমানে রোগে-শোকে জরাজীর্ণ তিনি।

স্থানীয়রা আরও জানান, এই বয়সে ঠিকমতো তিনবেলা খাবার জোটে না ঝলকির। অধিকাংশ সময় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে তার। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা খোঁজ নেন না তার। এজন্য আজ ঈদের দিনও ভালো খাবার জোটেনি এই বৃদ্ধার।

আক্ষেপ করে ঝলকি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইজ ঈদের দিন। কতজনে মাছ-গোস্ত কত ধরনের খাবার নাগছে (রান্না করছে)। আর মোর ভাতে জোটে না। ভাত জোটে তা তহাই জোটে না! মেম্বার-চেয়ারম্যান মোক কিচ্ছু দেয় না। নাই দেয় মোক ভিজিএফের চাউল। না দেইল মোক সরকারি ঘর। মুই মাইনষের জাগাত ঘর করি আছোং।’

দুপুরে পান্তা খেলেন রাতে কী খাবেন, জানতে চাইলে এই বৃদ্ধা বলেন, ‘ফেতরার ৫০ টেহা আছে। ৫০ টেহা দিয়ে যাত্রাপুরহাট বাজার থাকি কি আনিম? ওই টেহায় না হইবে মাছ কেনা, না হইবে গোস্ত কেনা! আলু কিনি আনিয়া তহাই করি খাইম।’

ঝলকির আশ্রয়দাতা মোস্তফা বলেন, ঝলকি নদীগর্ভে পাঁচবার বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। পরে তার দুর্দশা দেখে আমার বসতবাড়িতে আশ্রয় দেই। কিন্তু তার খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট। তার দুই ছেলে থেকেও নেই। তাকে অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হয়। মেম্বার-চেয়ারম্যান তাকে কোনো সহায়তা দেন না। ভিজিএফের চাল দেওয়ার নামে মেম্বার ঝলকির কাছ থেকে ভোটার আইডি কার্ড নিয়েও চাল দেননি। আজ ঈদের দিন ঝলকিসহ আমাদের কারো মুখে এক টুকরো মাংস ওঠেনি।’

প্রতিবেশী শিউলী বলেন, ‘ঝলকি খুবই অসহায়। ঠিকমতো খেতে পারে না। মেম্বার ভোট নেওয়ার সময় হাতে-পায়ে ধরে ভোট নেয়। অথচ ঝলকিকে কোনো সহায়তা দেয় না। মেম্বার ঝলকির ভোটার আইডি কার্ড জমা নিয়েও তাকে ভিজিএফের চাল দেয়নি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার বলেন, ‘ইউপি মেম্বাররা নিজ নিজ ওয়ার্ডের ভিজিএফের সুবিধাভোগীর তালিকা করলেও ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মোয়াজ্জেম রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে তালিকা করেননি। তিনি ক্ষমতাসীন দলের লোক। তবে, বিষয়টি আমি দেখছি।’

ঝলকিকে কোনো সহায়তা ও সরকারি ঘর দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঝলকির সহায়তার বিষয়টি আমি এখনি দেখছি। তিনি যদি চান তাহলে তাকে সরকারি ঘরের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে কথা বলতে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেদুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

মাসুদ রানা/এসআর