মতামত

প্রধানমন্ত্রীর ঈদ সালামি!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবার জাতিকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নয়, তিনি ফোন করে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। যদিও রেকর্ডেড শুভেচ্ছা বার্তা, তবুও এমনভাবে পাঠানো অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন।

Advertisement

সাধারণ নাম্বার থেকে আসা ফোনকলটি রিসিভ করলেই বলেন, আমি শেখ হাসিনা। শুনেই অনেকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। বার্তাটি যে আগেই রেকর্ড করা, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেননি। অনেকে রেকর্ডেড বার্তার সাথেই কথোপকথন চালিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাকেও পাল্টা ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

রেকর্ড করা বার্তা হলেও শেখ হাসিনার শেখ হাসিনার স্বকণ্ঠে পাঠানো এই ঈদ শুভেচ্ছা অনেককে আপ্লুত করেছে। আমার সহকর্মী শহীদুল আজম তিনবার শেখ হাসিনার ঈদের শুভেচ্ছা পেয়েছেন, আমি একবারও পাইনি। এবার ফেসবুকে অভিনব এক স্ট্যাটাস দিচ্ছেন অনেকেই। একটি খামের ছবি পোস্ট করে অনেকেই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেই খামে প্রাপকের নাম-পদবী লেখা। পাশে লেখা ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঈদ সালামি-২০২২’।

ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি খামের ভেতরে কিছু নগদ নারায়ণও আছে। টাকার অঙ্কটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রধানমন্ত্রী মনে রেখে ঈদের সালামী পাঠিয়েছেন, এটাই বিশাল ব্যাপার। সালামীটা আসলে আমাদের ঈদের আনন্দের অংশ। সালামি ছাড়া ঈদ সম্পূর্ণ হয় না। এখন আর সালামি পাই না। এখন আনন্দ দিয়ে। তবে ছেলেবেলায় ঈদের সালামি পাওয়ার আনন্দটা এখনও মনে হলে ভালো লাগে।

Advertisement

ফেসবুকে হিংসুটেদের অনেকে দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর ঈদ সালামি নিয়েও টিপ্পনী কাটছে। যারা পেয়েছে, তাদের দালাল বলা হচ্ছে। ভাইয়েরা, খামের ভেতরে প্রথধানমন্ত্রী কিন্তু টিভির লাইসেন্স বা প্লটের দলিল দেননি। এটা নিছকই ভালোবাসার প্রতীক। যারা প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করেন, সাংবাদিকদের মধ্যে যারা প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সংগ্রহ করেন; তারাই প্রধানমন্ত্রীর ঈদ সালামি পেয়েছেন।

আর প্রধানমন্ত্রীর ঈদ শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছেন আমজনতার অনেকেই। আমি ঈদ সালামি তো পাইইনি, এমনকি ঈদের রেকর্ড করা শুভেচ্ছাও পাইনি। আমার কি মন খারাপ করা উচিত। উচিত হলেও আমার মন খারাপ নয়। প্রধানমন্ত্রীর ওপর মন খারাপ করবো অত সাহস আমার নেই। এখন নাকি কারো মন খারাপ সেটা ফেসবুকে লেখাও ঝুঁকিপূর্ণ। কী দরকার আগ বাড়িয়ে ঝুঁকি নেয়ার।

প্রধানমন্ত্রীর সালামি বা শুভেচ্ছা না পেয়েও আমার মন খুবই ভালো। কেউ ভাববেন না, ভয়ে আমি মিথ্যা মিথ্যা মন ভালো বলছি। প্রধানমন্ত্রী আসলে শুধু আমার নয়, গোটা জাতির মন ভালো করে দিয়েছেন। কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠকে পুলিশের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করে তিনি আসলে আমাদের সবার মন ভালো করে দিয়েছেন।

এটাই আমাদের সবার ঈদের সালামি। তবে এত আনন্দের মাঝে ঝুঁকি নিয়েও একটু মন খারাপের কথা বলি। তেঁতুলতলা মাঠ বাঁচানোর প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে আমরা যেমন আনন্দিত, তেমনি এই সামান্য মাঠ বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হলো দেখে মন একটু খারাপও হলো।

Advertisement

বাংলাদেশের হাজারটা সমস্যা। কিন্তু গত এক যুগে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছুই হয় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অনেক মানবিক, তিনি সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে পারেন, সবদিকে তাঁর নজর থাকে; এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ।

কিন্তু সবকিছু যদি প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হয়; তাহলে এতবড় মন্ত্রিসভা, এত বিস্তৃত আমলাতন্ত্র, এতসব বাহিনী রেখে লাভ কী? কলাবাগান থানার কিছু পুলিশের অবিমৃশ্যকারিতায় সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ সরকারের সমালোচনায় নামে, তোলপাড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তেঁতুলতলার ছোট্ট মাঠে গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড়। এসবই আসলে করেছে পুলিশ।

মাঠ বাঁচানোর আন্দোলন করার অপরাধে সৈয়দা রত্না নামে এক নারী এবং তার শিশু সন্তানকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, যাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। থানা হাজতে থাকা এক শিশুর ছবিই আসলে গনেশ উল্টে দিয়েছে। ১৩ ঘণ্টা পর পুলিশ তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

পুলিশের এই অতি উৎসাহে বিপাকে পড়ে সরকার। কিন্তু সমস্যা হলো, পুলিশ তো নয়ই, এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও মাঠের দরকারটা বোঝেননি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের মুখপাত্রের মত কথা বলেছেন। নিজের নির্বাচনী এলাকার ফার্মগেটের পার্কটি মেট্রোরেল গিলে খেয়েছে। আমরা কেউ কিছু বলিনি বা বলতে পারিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও নিজের এলাকার পার্কটি বাঁচাতে পারেননি। পাশের এলাকার মাঠ বাঁচাতেও অনীহা ছিল তার।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বলে গেছেন, এটি সরকারি জায়গা, পুলিশ এটি ২৭ কোটি টাকায় কিনে নিয়েছে। তাই এটি পুলিশের জায়গা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুল কিছু বলেননি। কিন্তু ছোট্ট একটা মাঠ যে সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, সরকারকে মাঠ বিরোধী বানিয়ে দিচ্ছে; এটা তিনি বুঝতে পারেননি। তাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের তিনি মাঠের জন্য বিকল্প জায়গা খোঁজার পরামর্শ দেন।

তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন করার ব্যাপারেই অনড় ছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরদিনই প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, তেঁতুলতলা মাঠ যেমন ছিল, তেমনই থাকবে; কোনো থানা হবে না। সে সিদ্ধান্তও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্তের দুই পিঠ দেখতে এবং নিজ মুভে সেটা বলতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কেমন লেগেছে।

বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মত অসংবেদনশীল নন। উল্টাপাল্টা কথা বলার বদনামও তার নেই। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও তেঁতুলতলা মাঠের বিষয়ে জনগণের আবেগটা তিনি ধরতে পারেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই যদি মাঠটা শিশু-কিশোরদের জন্য ছেড়ে দিতেন; তাহলে কী এমন ক্ষতি হতো। পুলিশ তো ২৭ কোটি টাকা বাইরের কাউকে দিয়ে দেয়নি। সরকারের মাঠ সরকার কিনেছে।

২৭ কোটি টাকাও সরকারের কোষাগারেই আছে। আমি তো মনে করি, পাড়ায় পাড়ায় যাতে মাঠ থাকে, পুলিশেরই উচিত তা নিশ্চিত করা। শিশু-কিশোররা যদি খেলাধুলার সুযোগ পায়, শরীরচর্চা করে; তারা অপরাধে জড়াবে না, মাদকে আসক্ত হবে না। শেষ পর্যন্ত তো মাঠ থাকলে পুলিশেরই লাভ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল চাইলে তো নিজে থেকেই এই মাঠটি শিশুদের জন্য ঈদ উপহার দিয়ে দিতে পারতেন।

অনেক আগেই আমরা বুঝে গেছি, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই দেশে কিছু হবে না। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছেই দাবি তেঁতুলতলা মাঠকে ঘিরে গড়ে ওঠা আবেগকে মূল্যায়ন করুন, ঢাকার হারিয়ে যাওয়া, দখল হয়ে যাওয়া মাঠগুলো উদ্ধার করে আমাদের শিশু-কিশোরদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিন।

অবশ্য প্রথানমন্ত্রীর কাছে এই দাবি জানানো মায়ের কাছে মাসির বাড়ির গল্প করার মত। শিশুদের বিকাশের ভাবনা সবার চেয়ে বেশি শেখ হাসিনারই। তাঁর মত করে কেউ বিষয়গুলো ভাবে না। আমরা শুধু চাই সেই ভাবনার বাস্তবায়ন।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম