দেশজুড়ে

নারী বলেই পারিশ্রমিক কম!

শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে মে দিবস পালনের এত বছর পরও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরির দাবি এখনো উপেক্ষিত। বিশেষ করে শ্রমজীবী নারীদের মজুরি বৈষম্য। এখনো তাদের বিরাট অংশ মৌলিক এ অধিকার থেকে বঞ্চিত।

Advertisement

শ্রমআইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত করতে হবে। এর বিধিমালা আরও কঠোর। তবে তা মানা হচ্ছে না।

মে দিবস উপলক্ষে কৃষি, খেতখামার, কলকারখানা, নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতের ২০ জন নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে মজুরির এ বৈষম্যের চিত্র পাওয়া গেছে। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমিকরা বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে তাদের দাবি।

আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল গ্রামের বিধবা জরিনা বেগম জানান, স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। তার উপার্জনে চলে সংসার। তিনি বাকাল বাজারের বিভিন্ন দোকানে কলসিতে করে পানি পৌঁছে দেয়ার কাজ করেন। প্রতি কলস পানিতে ২ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। একই কাজ করে পুরুষরা বেশি টাকা পাচ্ছেন। পার্থক্য শুধু তারা ভ্যানে করে প্লাস্টিকের জারে পানি সরবরাহ করেন।

Advertisement

ধানের খেতে নিড়ানি, বীজ বপন থেকে মাড়াইয়ে কাজ করা রহিমা খাতুন বলেন, স্বামী অনত্র বিয়ে করে তাকে তালাক দিয়েছেন। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে আছে। সারাদিন কাজ করে যে মজুরি পান তা দিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়।

তিনি বলেন, একযুগ আগে একজন পুরুষ শ্রমিকের মজুরি ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা। কিন্তু কয়েক বছরে পুরুষদের শ্রমের মজুরি বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। বর্তমানে একজন পুরুষ শ্রমিক মজুরি পাচ্ছেন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আর একই কাজ করে একজন নারী মজুরি পাচ্ছেন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

আগৈলঝাড়া উপজেলা শহরের কাকলী ঘরামী নামে এক নারী নির্মাণ শ্রমিক জানান, তিনি রাজমিস্ত্রির সহযোগীর কাজ করেন। একই কাজে পুরুষদের দৈনিক মজুরি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ দৈনিক তাকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়।

বরিশাল নগরীর রূপতলী এলাকার খুকুমনি নামে এক নারী শ্রমিক জানান, তিনি সোনারগাঁও টেক্সটাইল মিলে কাজ করেন। মিলে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন নারীরা। কিন্তু মাস গেলে পুরুষদর থেকে নারী শ্রমিকরা দেড় দুই হাজার টাকা কম বেতন পাচ্ছেন।

Advertisement

তিনি বলেন, বেতন বৈষম্য নিয়ে নারীদের মধ্যে আক্ষেপ থাকলেও প্রতিবাদ করার সাহস নেই। বেশি বেতনের দাবিতে হইচই করলেই তাদের চাকরি হারাতে হয়। বছর দুয়েক আগে কয়েক মাসের বেতন বকেয়া রেখে হঠাৎ করে সোনারগাঁও টেক্সটাইল মিল লে-অফ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তখন অভাব টের পেয়েছিলাম। চাকরি ছাড়া সংসার চালানো খুব কষ্টের।

বিসিক শিল্প নগরীতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলিয়ে অর্ধশতধিক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে কাজ করছেন কয়েক হাজার শ্রমিক

শনিবার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে সেখানে সরেজমিনে গিয়ে সেতু আক্তার নামে বিস্কুট তৈরি কারখানার এক নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তাদের কারখানায় নারী কর্মীদের মাসিক বেতন ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা। তবে সমান কর্মঘণ্টা এবং একই কাজ করে পুরুষ কর্মীরা মাসিক বেতন পাচ্ছেন ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা।

তার সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে উপস্থিত হন কয়েকজন নারী শ্রমিক। তারা বিসিক শিল্প নগরীর বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।

তারা বলেন, পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারীরা ২৫ থেকে ৪৫ শতাংশ কম বেতন পাচ্ছেন। অথচ পুরুষ শ্রমিকদের সমান কাজ করছেন তারা। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে চাকরি হারাতে হয়। এছাড়া কর্মরত কম বয়সী নারীরা ঘরে-বাইরে প্রায় সময় যৌন হয়রানির শিকার হন। কিন্ত অনেকেই মুখ বুঝে সহ্য করেন। কারণ মাস শেষে বেতন হিসেবে যা পান তা দিয়েই পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে হয়।

আগৈলঝাড়ায় নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে ‘সুদিপ্ত মহিলা উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠন। সংগঠনের সভানেত্রী সুমা কর বলেন, নারী শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আর শোষণ-বঞ্চনার শেষ নেই এখনো। পেটের দায়ে সামান্য মজুরিতেও কাজ করে যান শ্রমজীবী নারীরা। সমাজে ও কর্মক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের বৈষম্য আছে। পারিশ্রমিক, সুযোগ সুবিধা, আচরণ সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য। এই বৈষম্য দূর করতে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক মো. ইউসুফ আলী জাগো নিউজে বলেন, নারী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন আমাদের কাছে কেউ এ ধরনের কোনো অভিযোগ করেননি। খোঁজখবর নিয়ে প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত করতে হবে। আইন আছে। বিধিমালা আরও কঠোর। কারখানার মালিক ও কর্মকর্তারা এসব মেনে চললে নারী কর্মীদের সমস্যা অনেক কমে যাওয়ার কথা। প্রচলিত সাধারণ শ্রম আইনেও অনেক সুবিধা নারী কর্মীদের পাওয়ার কথা। একজন শ্রমিক তার কাজের ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেলে তার কর্মদক্ষতা বাড়ে। শিল্পকারখানায় পুরোপুরি শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

এফএ/জেআইএম