মতামত

মুহিত: জনতার মঞ্চ থেকে জনগণের ভাগ্য বদলের নায়ক

খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের রাজনীতি দ্রুত মোড় নেয়। এবং পুরো রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। আর তার ফলে মেয়র হানিফের নেতৃত্বে প্রেসক্লাবের সামনে গড়ে ওঠে জনতার মঞ্চ। সেখানে মেয়র হানিফ থেকে শুরু করে মতিয়া চৌধুরি সকলের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা আন্দোলন। আর যার সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন প্রতিদিন নানান পেশাজীবীরা। সাধারণ মানুষে ও আওয়ামী লীগের কর্মীতে সারাদিনই ভরপুর থাকে প্রেসক্লাব থেকে পল্টনের সিপিবি অফিস অবধি।

Advertisement

সিপিবি অফিসের উল্টো পাশে গাজী শাহাবুদ্দিন আহম্মদের সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার অফিস ও প্রেস। জনতার মঞ্চে আসা বিখ্যাত শিল্পী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ডাক সাইটে সাংবাদিক ও আমলা সহ আমাদের মত ছোট খাট সাংবাদিকরা তাই জনতার মঞ্চ থেকে অন্তত এক বার হলেও ঢু মারি গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের অফিসে।

ওই মঞ্চ তৈরি হবার দুই দিন পর থেকেই আমার একটা নিয়মিত ডিউটি পড়ে গেলো, যেখানে থাকি না কেন, বিকেলের দিকে এসে আবুল মাল আব্দুল মুহিত ভাই ও শওকত ওসমান (ঔপন্যাসিক) স্যারকে সঙ্গে নিয়ে জনতার মঞ্চের কাছাকাছি কোন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ানো। জনতার মঞ্চের মানুষের উচ্ছাস, মঞ্চে শিল্পীদের গান থেকে মেয়র হানিফ এমনকি লাজুক ও বিনয়ী কবি শামসুর রাহমানের ভাষণও মুহিত ভাই যেন সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে নয়, নিজের শরীর দুলিয়ে ছন্দ দিয়েও উপভোগ করেন। আর ওখানে দাঁড়িয়েই তো কোন কোন দিন শওকত ওসমান স্যার লিখে ফেলেন ওনার শেখের সম্ভরার একটি সম্ভরা। তারপরে আবার গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের ডেরায় ফিরে যাওয়া। এবং গাজী ভাইয়ের বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বইয়ের পরিকল্পনা।

মুহিতভাই লিখবেন, ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমলের পঞ্চাশের দশক অবধি। আর ষাটের দশক থেকে নব্বই অবধি আমাকে লিখতে হবে। (কাজও অনেকটা এগিয়েছিলো, তারপরে মুহিত ভাইয়ের রাজনৈতিক ব্যস্ততা ও আমার পেশাগত ব্যস্ততার কারণে আর শেষ হয়নি। গাজী ভাইও অকালে ক্যান্সারে মারা যাওয়াতেও বইটির কাজ শেষ করার তাড়না করারও কেউ ছিলেন না)

Advertisement

মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ১৯৮২ সালে সেই উনি এরশাদের মন্ত্রী থাকার সময় থেকে। একটা বিষয় হয়তো অনেকে জানেন না, এরশাদের মন্ত্রী থাকার সময়ে তিনি কিন্তু স্বাধীনভাবেই মন্ত্রীত্ব চালাতেন। এরশাদ তাঁকে কখনও ডিস্টার্ব করেননি। তিনি পরে এরশাদের সঙ্গে তার শর্ত ভঙ্গ হওয়াতে চলে যান। ওই সময়ে দেশে ও বিদেশে এরশাদ সরকার আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে নানান ভাবে বিব্রত করেছেন। তিনি যাতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কাজ না পান সেজন্যও চাপ প্রয়োগ করেছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও তার মতো একজন দক্ষ লোককে হারাতে চায়নি বলে নানানভাবে কনসালটেন্সি দিয়ে তাঁকে তাদের সঙ্গে জুড়ে রাখে। সেগুলো আবুল মাল আব্দুল মুহিতের জীবন সংগ্রামের একটা বড় অধ্যায়। কিন্তু সীমাহীন মনোবলের মানুষ আবুল মাল আব্দুল মুহিত- তাই কখনো তিনি কোন কিছুতে ভেঙ্গে পড়তেন না।

যেমন ২০০৮ এ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার দুই তিনদিন পরে রাতে তাঁর বাসায় জিজ্ঞেস করি, পৃথিবী জুড়ে এখন মন্দা চলছে এ অবস্থায় আপনি সামাল দিবেন কীভাবে? তিনি বলেন, দেখ আমাদের প্রায় বারো তেরো কোটি মানুষের একটা অভ্যন্তরীন বাজার আছে। এই অভ্যন্তরীণ বাজারটাকে চালু রাখতে হবে। সে জন্যে প্রণোদনা দিতে হবে কিছু খাতে। যাতে মানুষের হাতে টাকা আসে। আর দ্রুত এই বাজারকে আরো বড় করতে হবে।

বাস্তবে অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রেখে, কিছু কিছু দ্রব্যের দাম কমিয়ে এনে তিনি সত্যিই অভ্যন্তরীণ বাজারকে শক্তিশালী করে দিয়ে গেছেন। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় ভিত্তি। এবং শহর থেকে গ্রাম অবধি অর্থনীতির একটা সমন্বয় তিনি করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিলো আরো বৈষম্য কমিয়ে আনা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, ইনইকুয়ালিটি ইজ ডেমোক্রেসি। কিন্তু নানান রাজনৈতিক হিসাব নিকাশসহ, গোষ্ঠীবদ্ধ ব্যবসায়ীদের চাপ, তাদের রাজনীতিতে স্টেইক নেয়া, ধীরে ধীরে নীতি নির্ধারক পদে অনেকের চলে আসাতে- তিনি তাঁর আকাঙ্খা অনুযায়ী বৈষম্য কমাতে পারেননি।

আর এটা যখন পারছিলেন না তখন তিনি বেশি মনোযোগী হয়েছিলেন, ম্যাক্রো ইকোনমির দিকে। তাঁর চিন্তা ছিলো অর্থনীতির আকার দ্রুত বাড়িয়ে ফেলতে পারলে তখন এই গোষ্ঠীবদ্ধ ব্যবসায়ীদের স্টেইক কমে যাবে। নানান জায়াগায় স্টেইক চলে যাবে। এ সময়ে একদিন তাঁর কাছে জানতে চাই আপনি যে অর্থনীতির আকার বাড়াবেন- আপনার মূল পরিকল্পনা কি? তিনি বলেন, শোন, আমাদের প্রথম সমস্যা হলো, আমাদের প্রবৃদ্ধি একটা বৃত্তের ভেতর গতো দশ বারো বছরের বেশি আটকে আছে।

Advertisement

অর্থাৎ পাঁচ, সাড়ে পাঁচ ও ছয়ের ভেতরই আটকে আছে। আমাদের সাহস করে এই বৃত্ত ভাঙ্গতে হবে। আমি তাকে বলি, শুধু সাহস করেই যদি ভাঙ্গা যায়, তাহলে এতদিন ভাঙ্গছে না কেন কেউ। আবুল মাল আব্দুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে শ্রদ্ধা করতেন। ভালো জানতেন। এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি তাঁর যথেষ্ট কাজের সুনাম করতেন। এটা জানা ছিলো বলেই তার কাছে জানতে চাই, সাইফুর রহমান এটা ভাঙ্গেননি কেন?

তিনি উত্তরে বলেছিলেন, সাইফুর রহমান কিছুটা রক্ষণশীল। তাছাড়া তাঁর দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবল নয়। সেদিক থেকে তিনি নিজে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। তিনি কীভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন সেটা জানতে চাইলে বলেন, দেখো, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে অত্যন্ত সাহসী। তার মত সাহসী নেতা খুবই কম মেলে; কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। তাই তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, আমি যেটা করবো, তিনি তা বাস্তবায়নে যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় সেটা নিবেন।

আবুল মাল আব্দুল মুহিত সত্যিই ম্যাক্রো অর্থনীতির এই চরিত্র পরিবর্তন করেছিলেন। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি অর্থনীতির আকার বাড়িয়ে যান। আর শেখ হাসিনা তাঁর প্রতি কাজের রাজনৈতিক সমর্থন ও সেটা বাস্তবায়ন করার জন্যে যা প্রয়োজন তা করতেন। আরো বাস্তবতা হলো, তৃতীয় বছরে এসে তিনি বলেন, অর্থনীতির আকার এবার অনেক বেড়ে যাবে। কারণ, নেত্রী আমাকে অনেক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তাতে এবার অর্থনীতির আকার বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে আরো বেশিভাবে।

বাস্তবে অর্থনীতির আকার বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধির ওই বৃত্ত ভেঙ্গে ফেলার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার ও নতুন পণ্যের রফতানির বাজার তিনি বাড়াতে থাকেন। তিনি তাঁর প্রথম বাজেটেই অনেক সুবিধা দেন, ফার্নিচার, খেলনা, জুতো এসব শিল্পকে। তাঁর মতে গার্মেন্টেসের মতো এগুলোতেও বাংলাদেশ অনেক বড় বাজার নিতে পারবে।

অনেক সময় এন বি আর এর কর্তাব্যক্তিরা তাদের চিরাচরিত নিয়মের মধ্যে চলতে গিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের এই নতুন নতুন উদ্ভাবনী কাজের অনেক বাধা হয়েছেন। যেমন ছোট্ট একটা বিষয়। দেশের নতুন প্রজম্মকে- দক্ষ প্রজম্ম ও তিনি নিজে যেমন শিক্ষিত ছিলেন ওই মাপের বা তার কাছাকাছি শিক্ষিত একটা প্রজম্ম গড়ে তোলার জন্যে তিনি বিদেশী বই আমদানীর শুল্ক উঠিয়ে দিয়েছিলেন।

আমাদের প্রোটেকশানের মধ্যে বড় হওয়া বই ব্যবসায়ী ও এনবিআর- এর লোকদের সনাতন চিন্তার কারণে তাঁর এই দক্ষ জনশক্তি গড়ার এ পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়নি। তবে তারপরেও সত্য অর্থনীতির আকার বড় করে তিনি বাংলাদেশকে এমন জায়গায় নিয়ে যান যা সত্যিই জনগণের ভাগ্য বদল করে দেয় তাঁর দশ বছরে।

এখন সেটাকে ধরে রাখা পরবর্তীদের কাজ। সেখানে তারা সফল হবেন কি ব্যর্থ হবেন তা ভবিষ্যত বলবে। তবে ভবিষ্যত এটা বলবে যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবুল মাল আব্দুল মুহিত সেই অর্থমন্ত্রী ছিলেন, যিনি জনগণের ভাগ্য বদলে দিয়ে গিয়েছিলেন। মানুষ নিজের দেশে নিজের ভাগ্য খুঁজে পাবার পথ পেয়েছিলো।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস