মতামত

শ্রমিক স্বার্থ ও অধিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু

স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মহান মে দিবস ছিল শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এক জ্বলন্ত প্রতীক। দিবসটি সারা বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।বঙ্গবন্ধু শোষিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিলেন এবং তার আজীবনের লড়াই ছিল সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার, সে জন্য মে দিবস হয়ে উঠেছিল অনুপ্রেরণার এক অনন্য উদাহরণ। জেলের কয়েদিদের আপনি সন্মোধন কিংবা হঠাৎ ফসলের খেতে কৃষককে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন বঙ্গবন্ধুর জীবন চলার মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন উদাহরণের পাল্লা ভারী করে সর্বদাই৷

Advertisement

মহান স্বাধীনতা লাভের পরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নব প্রণীত সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় সুদৃঢ়করণ করেন। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে: রাষ্টের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশ সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।

১৫ (খ) অনু্চ্ছেদে কর্ম ও মজুরির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে: কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিম্চিয়তার অধিকার; যুক্তিসংগত বিশ্রাম বিনোদন ও অবকাশের অধিকার। ৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তি- শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে: সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম; এবং এই বিধান কোনভাবে লংঘিত হইলে আইনত; দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। বঙ্গবন্ধু নিখাদ আন্তরিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

জাতির পিতা যেমন ছিলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তেমনি তিনি ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর’ জন্য ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শ্রম অধিকার নিশ্চিতে তিনি তেমন শ্রমিককের পাশে থেকেছেন তেমনী শ্রমজীবিদের বিরোধী তথাকথিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে দিয়েছেন চিরচেনা সে বজ্রহুংকার৷ ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহান স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু চাকরিজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "আপনি চাকরি করেন আপনার মায়না দেয় ঐ গরীব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়, আমি গাড়ি চলি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন, ওরাই মালিক" শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রতি কতটা টান,কতটা দরদ, কতটা মমত্ববোধ থাকলে একজন রাষ্ট্র নায়ক তাঁর দেশের গরীব শ্রমজীবীদের দেশের মালিক বলে ঘোষণা দিতে পারেন।

Advertisement

সেদিন বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবী মানুষকে নব জাগরণের প্রেরণা দিয়েছেন। তিনি বুঝিয়েছেন যে, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ হচ্ছে উৎপাদন, শিল্পোন্নয়ন, তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে নিহিত থাকে দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষকে বেশি ভালবাসতেন। তিনি আজীবন শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পাশে ছিলেন।

শ্রমিকরা দেশের চালিকাশক্তি তা বঙ্গবন্ধু বহু আগেই অনুধাবন করেছিলেন সুস্পষ্ট ভাবে৷ বিশেষত বঙ্গবন্ধুর "আমার দেখা নয়াচীন" গ্রন্থে চীনের অর্থনৈতিক কিংবা কারিগরি বিকাশকে বঙ্গবন্ধু সুনিপুণ ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, কর্মপরিবেশ, বিনোদন সবকিছুকেই তিনি নিজস্ব চিন্তার জালে মেলে ধরেছেন এবং বাংলাদেশকে সাজানোর আংশিক রূপরেখা, শ্রমিকদের নির্ভরতা ও সুপার পাওয়ার ন্যাশনে পরিণত যর্থার্থ দিকনির্দেশনাও ছিল তাঁর এই গ্রস্থে। বঙ্গবন্ধু কতোটা শ্রমিক বা শ্রমজীবি অন্তঃপ্রাণ তা উপলব্ধি করতে হয়তো বিস্তর পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। তবে পাঠ কার্যক্রম বাড়ালে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই৷ কেননা বঙ্গবন্ধু ছিলেন সূক্ষ্ণ বুদ্ধি, চিন্তা ও আপন বলয়ের একজন দূরদর্শী ব্যক্তি। যিনি অর্ধশতকের ভবিষ্যৎ আজকেই দেখতে পেতেন।

স্বপ্নের বাংলাদেশকে অনেকটা সেভাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন জাতিরপিতা। দুর্ভাগ্য, হায়েনার বুলেট ধ্বংস করেছিল একটি জাতিকে! অন্যদিকে,১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ২২ জুন আইএলসি সম্মেলনে ৬টি কোর-কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে পহেলা মে’কে মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। এর আগে পাকিস্তানী শাসন-শোষণ থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্য জাতির পিতা ৬ দফা দাবি পেশ করেন, সেখানও তিনি বাংলার শ্রমিক-কর্মচারীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে মুক্তির মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। স্বপ্ন দেখান একটি সোনালি দিনের, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সে প্রত্যাশায় শ্রমজীবী মানুষ উজ্জ্বীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিকরা আত্মত্যাগের দীক্ষা গ্রহণ করেছে।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন- ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন,“বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত, এক দিকে শোষক, আর অন্য দিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে”| শুধু দেশেরই নয়, সারা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে হৃদয়ে শক্তপোক্ত স্থান দিয়েছিলেন বলেই বিশ্ব দরবারেও এমন মর্মভেদী বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি জানতেন শোষিত নিপিড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে সাম্যতা আসবে না।

Advertisement

শ্রমিকরা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়না এবং চালিকা শক্তি। তাদের সামনে যা করবেন, তা-ই প্রতিবিম্ব হবে বারবার৷ শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে বেশি শেখ হাসিনার সরকার কাজ করেছে। জাতির পিতার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই কেবলমাত্র শ্রমিকদের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা- বেতন-ভাতা নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে শ্রমিকদের ভূমিকা রয়েছে এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় অনুভব করেন। আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে, দেশের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য।

মালিক-শ্রমিকের একটা সুন্দর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে। এ সম্পর্কের অবনতি হলে দেশের উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।আমরা বিজয়ী জাতি তাই মাথা উঁচু করে চলতে চাই। মাথা উঁচু করতে চলতে হলে আমাদের মালিক-শ্রমিক একযোগে কাজ করতে হবে।

শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে আপন করে নিয়েছেন, সম্মান দিয়েছেন তা ইতিহাসে বিরল। শ্রমজীবীদের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ এ জাতির প্রেরণা, দিক নির্দেশনা তথা প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। আসুন আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বাস্তবায়নে একত্রে কাজ করি। মালিক শ্রমিকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ অর্থনীতির পথে নিরবচ্ছিন্ন এগিয়ে যাবে সে প্রত্যাশা রইলো।

পাশাপাশি শ্রমিক সংশ্লিষ্ট আইন (বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬) এবং অন্যান্য আইনে নির্ধারিত শ্রমিকের স্বার্থ,সুরক্ষার বিষয়গুলো জোরদার করা খুবই প্রয়োজন৷ এমনকি আইনের মাঝে অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে তা ত্রুটিমুক্ত করাও এখন সময়ের দাবি৷ প্রতিষ্ঠিত হোক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ যেখানে সবাই সমান, থাকবে না ক্ষুধা, দারিদ্র্য কিংবা বৈষম্য।

লেখক: উপ- তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

এইচআর/এমএস