মতামত

শঙ্কামুক্ত ঈদ পালনে সতর্কতা জরুরি

করোনা ভাইরাসের কারণে বিগত কয়েকটি ঈদ ছিল উৎসব বিমুখ। ফলে এই বছর ঈদ সকলের জন্য উৎসবমুখর হবে বলেই প্রত্যাশা করি। দীর্ঘদিনের বিধি-নিষেধ কাটিয়ে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে ঈদ করবে এমন প্রত্যাশা সকলের হওয়াটাই স্বাভাবিক। করোনার কারণে আমরা সকলেই এক প্রকার মানসিক অশান্তিতে ছিলাম। মানসিক প্রশান্তির জন্য সকলে মিলে ঈদ হোক উৎসবমুখর এমনই চাই।

Advertisement

ইতোমধ্যে ঘরমুখো মানুষের নাড়ির টানে গ্রামে যেতে চলেছে। এবার প্রতিদিন ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন-এমনটি বলা হচ্ছে। তবে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে ১৩ থেকে ১৪ লাখ মানুষের। ১৬ লাখের ঘাটতি রয়েছে। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ঈদযাত্রা কি শঙ্কামুক্ত হবে? পরিবারের সাথে ঈদ উপভোগ করা সম্ভব হবে কি? ঈদযাত্রা নিরাপদ হলেও ফেরা কি শঙ্কামুক্ত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

যাত্রাপথের ভোগান্তিতে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বেশি। কারণ ঈদ এলেই চোখে পরে মহাসড়কে মুত্যুর মিছিল, দীর্ঘ যানজট, যানবাহনে উপচেপড়া ভিড়, ট্রেনের টিকিটের দীর্ঘলাইন, টিকিট যেন সোনার হরিণ ইত্যাদি। যানবাহন চলাচলের সুব্যবস্থা না করে রাজধানী থেকে বের হওয়ার সব সড়ক-মহাসড়কে উন্নয়ন প্রকল্প চলমান থাকায় এই ঈদেও তীব্র যানজটের আশঙ্কা করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

সেই সঙ্গে খানাখন্দে ভরা সড়ক-মহাসড়ক, মূল সড়কে রিকশা-থ্রিহুইলার চলাচল, ঈদে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, মহাসড়কের পাশে বাজার, দুর্ঘটনা, ছিনতাই ও মলম পার্টির ভয়সহ নানা বিষয় ঈদযাত্রায় ভোগান্তি বাড়াবে বলে আশঙ্কা করা সমীচীনহীন নয়।

Advertisement

শুধু সড়কেই নয়, লঞ্চ, রেল এমনকি আকাশপথেও ভোগান্তির আশঙ্কা ভাবিয়ে তুলছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ঘটনা নদীপথে চলাচলও ঝুঁকিমুক্ত নয়। প্রায়ই ঘটছে লঞ্চডুবি। পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কার কারণে মাওয়ার শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি ফেরি পারাপারে বাস নেওয়া বন্ধ রয়েছে অনেক দিন। এই রুটের গাড়িগুলোও এখন পাটুরিয়া ঘুরে যাতায়াত করছে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। ৬-৭ ঘণ্টার পথ ১২ ঘণ্টার বেশি লাগছে। ঈদে এই সংকট আরও বাড়বে।

চোখ রাখলে দেখা যায় ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট ২৫০ জনের বেশি যাত্রী নিয়ে পদ্মা নদীতে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে ভোলার লালমোহনগামী এমভি নাসরিন-১ নামের লঞ্চটি চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ডুবে যায়। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাইয়ের কারণে লঞ্চটির তলা ফেটে গিয়েছিল। ওই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে প্রায় সাড়ে ৬০০ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।

এ দেশে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে কিছুদিন হৈচৈ হয়, গণমাধ্যমগুলোও এ নিয়ে কিছুদিন সরগরম থাকে। আর জাতীয় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথারীতি গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। নৌ-দুর্ঘটনার কিছুদিন পরে দেশে যদি অন্য কোনো বড় ধরনের ঘটনা বা সহিংসতা অথবা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন স্বাভাবিকভাবেই চাপা পড়ে যায় ওই নৌ-দুর্ঘটনার বিষয়। পরবর্তী সময়ে আর কেউ জানতে পারে না ওই নৌ-দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী ব্যক্তি কে অথবা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা। তারপরও ঘটনাগুলো তুলে ধরার উদ্দেশ্য হলো অতীতকে মনে করে আমরা যেন সতর্ক হই।

এরই মধ্যে সব রেল ও এয়ারলাইন্সে টিকিট সংকট দেখা দিয়েছে। ২৩ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি নিয়ে রয়েছে ভোগান্তি। তবে ঈদ যাত্রায় সবচেয়ে বড় শঙ্কা আমার কাছে দুর্ঘটনাকে নিয়ে। বিগত দিনের সড়ক, রেল ও নদীপথের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান এমন শঙ্কায় যেন তৈরি করছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে অনুযায়ী গত মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ১৯ জন নিহত হয়েছে। এই মাসে সারা দেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।

Advertisement

এতে ৫৮৯ জন নিহত এবং ৬৪৭ জন আহত হন। নিহতের মধ্যে ৬১ জন নারী ও ৯৬ শিশু। অথচ ফেব্রুয়ারি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে নিহত হার ছিল ১৬ দশমিক ৭৫। এই হিসাবে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চ মাসে প্রাণহানি বৃদ্ধির হার তিন শতাংশের বেশি। এছাড়া ওই মাসে ৫টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। ১১টি রেল দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত এবং ৮ জন আহত হয়েছেন। সুতরাং আমরা বলতে পারি সড়ক, রেল ও নদী কোন পথই ঝুঁকিমুক্ত নয়।

যাতায়াতের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সড়ক পথ। আর এই পথেই দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। সুতরাং সতর্কতা খুবই জরুরি। আমরা জানি কেন দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। তারপরও তা ঘটছে আর আমরাই তার শিকার হচ্ছি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মূলত সড়ক পরিবহণ খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে । মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ চালকদের বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা বাড়ছে।

এছাড়া পথচারী নিহতের ঘটনাও ব্যাপক বেড়েছে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলে না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। দুর্ঘটনা বাড়লেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয় বলেও দাবি করেছে সংগঠনটি। তারা বলেছে, ‘সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহণ কৌশল প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সুতরাং সরকার দুর্বল দিকগুলোর দিকে নজর দিলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। সম্ভব ঝুঁকিমুক্ত ঈদ পালন।

সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক হলো মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। মার্চ মাসে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, ১৭৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২২১ জন, যা মোট নিহতের ৩৭.৫২ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮.৪২ শতাংশ। সুতরাং মোটর সাইকেল চালিয়ে যারা বাড়ি ফেরার কথা ভাবছেন তাদের সময় ও সক্ষমতা উভয় দিক ভেবেই রাস্তায় বের হওয়া উচিত। সেই সাথে পথচারীদেরও সচেতন ভাবে চলা উচিত। কারণ সচেতন না হলে অসচেতন মোটর সাইকেল চালক আপনি বা আমাকে আঘাত করতেই পারে।

দুর্ঘটনা দুর্ঘটনায় তবে নিজেকে নিরাপদ রাখতে সর্তকতার কিন্তু বিকল্প নাই। দুর্ঘটনা রোধে কিছু সুপারিশ করা হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-সড়ক পরিবহণ আইন বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, পরিবহণ মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করা ও এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে। তবে এগুলোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিজেকে সতর্ক করা।

আমরা দেখি ঈদের শেষ মুহূর্তে দীর্ঘ যানজট, পথে লোকারণ্য। এর জন্য যেমন নিজেরা দায়ী তেমনি দায়ী মালিকপক্ষ। শিল্প প্রতিষ্ঠানের লোকসানের দিক খেয়াল করতে গিয়ে জীবনকে তুচ্ছ ভাবা হচ্ছে। কর্মীরা যারা তারাও অর্থের চিন্তা করে জীবনকে তুচ্ছ করে জীবন বাজি রেখে যানবাহনে ঝুঁকি নিয়ে চলছি। ফলে যেকোন সময় দুর্ঘটনার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

পদক্ষেপ ছাড়া দেশের বিশাল জনসংখ্যার শঙ্কামুক্ত যাত্রা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং সরকারকে বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে অন্তত ঈদ যাত্রা শঙ্কামুক্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক বেশি তৎপর থাকতে হবে, যাতে কোনো অসাধু পরিবহন মালিক বা চালক বেশি ভাড়া আদায় করতে না পারে।

ভাড়া নৈরাজ্যকারীদের বিরুদ্ধে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দৃষ্টান্তমূলক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে যাত্রাপথে দ্বিগুণ বা তিন গুণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ হবে। টিকিট কালোবাজারী, অতিরিক্ত যাত্রীবহন, যানজটপূর্ণ এলাকায় ট্রাফিক জোরদার বিষয়ক আইন তৈরি ও আইনের বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে। সব বিভাগীয় শহরে ফুটপাত হকার ও অবৈধ পার্কিংমুক্ত করা জরুরি।

ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ সিরাজগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কাঁচপুর সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু, রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়া বাইপাইল ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে যানজট নিরসনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনে সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় খুবই খারাপ পরিস্থিতি হতে পারে।

জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সেই সাথে জনগণকে আইন মানতে হবে। শঙ্কামুক্ত ঈদ পালনে ঝুঁকিমুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সকলকেই দায়িত্বশীল হতে হবে।

এইচআর/জিকেএস