এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা পর্যায়ের সদস্যদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা এখন গণমাধ্যমসহ সর্বত্র আলোচনায় রয়েছে। নির্যাতিত দু’জনই এখনও পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের দু’জনই কেন পুলিশ সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হলেন তা কারোরই বোধগম্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে বুথ থেকে রাতে টাকা তোলার সময় অপহরণ, প্রহার এবং জীবন লাশের পর্যায়ে নেওয়া হলো যা কোনো সন্ত্রাসীর কাজ, কোনো স্বাভাবিক মানুষের কাজ হওয়ার নয়। অথচ কাজটা করেছে কর্মকর্তা পদের মানুষ। তাদের যেখানে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা পাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো রাব্বীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করলেন, ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের মতো দাবি করে বসে পুলিশ সদস্যগণ। টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা রাব্বীর জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো ছিল। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তাকে ছিনতাইকারী অভিযোগ এনে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে- তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনা দু’টোই কর্মকর্তা পর্যায়ের পুলিশ সদস্যের হাতে ঘটেছে। প্রথমটির সঙ্গে যে সব পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তারা পুলিশের পোশাকে সন্ত্রাসী কাজে রাতের আধারে লিপ্ত হয়েছিল, তাদের সকল উদ্দেশ্যই ছিল টাকা আদায় করা- যা কোনো পাষণ্ড ব্যক্তিই কেবল করতে পারে। দ্বিতীয় ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছিলেন তারা টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে নয়, নিজেদের পুলিশি বাহাদুরি শক্তি প্রদর্শনের চমক দেখাতে গিয়ে আইনের সীমা লঙ্ঘন করেছেন, অমানবিক আচরণ করেছেন। উভয় দলের পুলিশ সদস্যগণই তাদের বাহিনীর মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন- যা ব্যক্তি হিসেবে তারা কেউ করতে পারেন না, কিন্তু তারা করেছেন সন্ত্রাসীদের মতো মানসিকতা প্রদর্শন করেই তাদের আচরণে দু’জন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়েছেন। এ ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্যে স্থায়ী হয়, অনেকে জীবনে আর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেন না। আমরা কামনা করবো রাব্বী এবং বিকাশ বাবু দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। দুঃখজনক কথা হলো, তারা দু’জনেই তাদের কর্মপরিচিতি উপস্থাপন করার পরও পুলিশ কর্মকর্তাগণ তাতে কর্ণপাত না করে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন অব্যাহত রেখেছিলেন। কর্মকর্তা পর্যায়ের পুলিশ সদস্যের আচরণ কতোটা বেপরোয়া হলে পরিচয় জানার পরও চিন্তা করতে চেষ্টা না করা বা বোধোদয় ঘটে না অধিকন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তা ‘বাংলাদেশের রাজা পুলিশ’ বলে নিজের নাম প্রকাশ করার মতো ঘটনাটি নিয়ে আমাদেরকে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। বলে রাখি, এ ধরনের ঘটনার জন্যে কোনো বাহিনীকে অভিযুক্ত করার সুযোগ নেই, সেভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করা বা দেখানোও কোনোভাবে যুক্তিযুক্ত নয়। আমরা সেভাবে দেখছি না। ঘটনা দু’টো যারা ঘটিয়েছিলেন তারা তাদের ব্যক্তিগত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। কাজ দু’টো পুলিশ আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে, বিভাগীয় তদন্ত এবং চাকুরিবিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। সেটি ভালো কথা। তবে বিষয়টি শুধু বিভাগীয় তদন্ত বা বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না। সমস্যার ভেতরে প্রবেশ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের পুলিশ বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের এ ধরনের, এর চাইতে ভয়াবহ বা গর্হিত কোনো অপকর্মের খবর আমরা সুদূর বা নিকট অতীতে জেনেছি, দেখেছি, দেশব্যাপী এ নিয়ে বড় ধরনের উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়ার খবরও আমরা দেখেছি। অনেক ঘটনার খবর আমাদের হয়তো জানার সুযোগ ঘটে না।পুলিশ বাহিনীর ভেতরের সদস্যগণ অনেক বেশি জানেন, অনেকেই চাকুরি হারায়, আবার অনেকে নানা রকম প্রভাব খাটিয়ে বহালও থাকেন। সব ধরনের অভিজ্ঞতাই আমাদের রয়েছে। বিষয়টি শুধু পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য তা নয়, অন্যান্য বাহিনী ও পেশাতেও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, বেআইনি কর্মকাণ্ডে অনেকেই জড়িয়ে পড়ে, তাদের হাতে সাধারণ মানুষ নির্যাতিত, ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি মৃত্যুমুখেও পতিত হয়- এই সাধারণ সত্যটি আমাদের অজ্ঞাত নয়। কোনো বাহিনী বা পেশার কর্মকর্তা ও সদস্যগণ সামগ্রিকভাবে বিতর্কের উর্ধ্বে নন। কেউ না কেউ সেই পেশায় বা বাহিনীতে রয়েছেন যারা নিয়ম ভঙ্গ করেন, ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেন, দেশ ও জাতির সম্মুখে নিজের বাহিনী ও পেশাকে হেয় প্রতিপন্ন করেন। তবে প্রত্যেক পেশার ক্ষেত্রেই ভিন্নতা রয়েছে। পুলিশের হাতে বৈধ অস্ত্র থাকে। এটি তার কাজের শক্তি জোগায়- সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো পুলিশ কর্মকর্তা সেই শক্তির অপব্যবহার করলে আমরা বিস্মিত হই, অসহায় হয়ে পড়ি। কেননা, পুলিশ জনগণের বন্ধু বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। পুলিশ আছে বলেই আমরা নিজেদেরকে অনেক বেশি নিরাপদ মনে করি। সেটি অনেক ক্ষেত্রেই সত্য। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগও রয়েছে। আবার এ কথাও সত্য যে, এখন বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীতে অনেক শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত, মার্জিত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকর্তা রয়েছেন- তারা বেশ স্মার্ট কর্মকর্তা হিসেবেই দেখা যায়। দেশে বিদেশে তাদের ভূমিকাও বেশ প্রশংসিত হচ্ছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তারা দেশে এবং দেশের বাইরে পালন করছেন। স্বীকার করতে হবে যে, দেশে জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা মোটেও পর্যাপ্ত নয়, তাদের লজিস্টিক সার্পোটও খুব বেশি নয়। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে পুলিশ বাহিনীকে কাজ করতে হয়। তাদের থাকার পরিবেশও খুব আরামদায়ক নয়। অতিরিক্ত চাপ ও দায়িত্বপালন পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের জানা বিষয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, মানবিক গুণাবলী ধারণ, জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গুরুত্বের সঙ্গে ধারণ করার শিক্ষা ও সংস্কৃতিক মান যথাযথভাবে থাকতে হবে। সমাজের নানা স্তর ও সাংস্কৃতিক মানের অবস্থান থেকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আগমন ঘটে। এ সব সদস্যের অনেকেই ক্ষমতার বিষয়টিকে চাকুরি বিধির সঙ্গে মিলিয়ে ধারণ করতে পারেন না। নানা লোভ, লালসা, উচ্চাকাঙ্খা তাদের কারো কারো মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে, এসবকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষাটি আত্মস্থ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। পুলিশ বাহিনীতে চাকুরি নেওয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মানসিকতা কারো মধ্যে থাকলে সেই সদস্যের কাছ থেকে পুলিশ বাহিনী খুব একটা উপকৃত হবে না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমাদের দেশে চাকুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব অর্জনের মানসিকতার চাইতে ক্ষমতা ও বৈষয়িক প্রশান্তির মোহটি অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। সেটিকে দূর করার জন্যে পেশাজীবী বা বাহিনীকেই উদ্যোগ নিতে হবে এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানবিক ও পেশাগত মূল্যবোধ অর্জনের সংস্কৃতিকে লালন করার মধ্য দিয়ে। পুলিশ বাহিনীকে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে- যুগোপযোগী চিন্তাধারা গড়ে তোলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পুলিশ বাহনীর সদস্যদের মধ্যে কেউ যেন আইনের উর্ধ্বে নিজেকে না ভাবে, সেভাবে কোনো অপকর্মে জড়িয়ে না পড়ে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে, তেমন কেউ জড়িয়ে পড়লে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান থাকতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেই তাদের গৌরবময় ভূমিকার জন্যে আমাদের শ্রদ্ধার আসনে রয়েছে। এই ইতিহাসে নতুন প্রজন্মের পুলিশ সদস্যদের জানাতে হবে, গৌরবময় ইতিহাস জানতে হবে, ধারণ করতে হবে সেই মহিমান্বিত ইতিহাসকে। তাহলেই বিচ্যুতি ঘটার আর কোনো আশঙ্কা থাকবে না। আমরা চাই পুলিশ বাহিনী যথার্থ অর্থেই জনগণের বন্ধু হয়ে যেন বেড়ে ওঠে, কারো ভয় বা আতঙ্কের কারণ যেন না হয়। সেটি পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকেই এটি স্মরণ রাখতে হবে। তা হলেই বিচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা কমে যাবে। লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্টএইচঅার/পিআর
Advertisement