দেশের বিষয় নিয়ে বিদেশিদের কাছে নালিশ জানানো আমাদের দেশের কতিপয় রাজনৈতিক দলের একটি নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংকটে মধ্যস্থতা করার জন্য একাধিকবার বিদেশিদের ডেকে আনার নজির আমাদের আছে। দেশের অবস্থা নিয়ে বিদেশিদের কাছে বিরূপ মন্তব্য আর কোনো দেশের রাজনীতিবিদরা করেন কি না, আমি জানি না। তবে প্রতিবেশি দেশ ভারতে দেখা যায় জাতীয় স্বার্থে, জাতীয় ইস্যুতে প্রায় সব রাজনৈতিক দল অভিন্ন অবস্থান নিয়ে থাকে।
Advertisement
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মতবিরোধ ও ঝগড়াঝাটি থাকলেও অন্য দেশে গিয়ে কোনো দলই এমন কিছু করে না বা বলে না যাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। এমন কি বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দহরমমহরমের বিষয়টিও অন্য দেশে দৃষ্টিকটূভাবে দৃশ্যমান নয়। সব কিছুতেই ব্যতিক্রম থাকাই বুঝি আমাদের বৈশিষ্ট্য। তাই নিজেদের ঝগড়া মেটানোর জন্য অন্যদের কাছে ধরনা দিতে আমাদের কোনো গ্লানি বা লজ্জা নেই।
আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো জাতীয় ইস্যুতে একমত হতে না পারলেও শক্তিধর রাষ্ট্রের কাছে পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে এক ধারাতেই চলতে পছন্দ করে। বিদেশিদের দ্বারস্থ বিএনপি বেশি হয়, না আওয়ামী লীগ সেটা অবশ্যই লম্বা বিতর্কের বিষয়। তবে এখন আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছে বলে বিএনপিই বেশি অভিযোগ জানায় বলে মনে করা হয়। বিএনপিকে সে জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয় বাংলাদেশ নালিশ পার্টি। কিন্তু আওয়ামী লীগের কি এমন অভ্যাস নেই? হলফ করে এটা বলা যাবে না যে, আওয়ামী লীগ কখনো কোনো বিষয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়নি।
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন বলে খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। তিনি অবশ্য পরে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি এ ব্যাপারে আমেরিকার ‘হস্তক্ষেপ’ চাননি, কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা তো চেষ্টা করি সবাইকে নির্বাচনে আনতে কিন্তু বিএনপি আসতে চায় না। আপনারা চেষ্টা করে দেখুন না!
Advertisement
যেভাবেই বলা হোক না কেন, এটা ঠিক হয়নি। কারণ বিষয়টি একান্তই আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দুর্বলতা। এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে আমাদেরই। বাইরের কেউ সেটা পারবে না। যেমন স্যার নেনিয়ান বা আর কেউ আমাদের নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংকট সমাধানের পথ বাতলাতে।
আমেরিকায় থাকা বঙ্গবন্ধুর একজন খুনিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি বিএনপির কারণে বলেও জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এটা কি সম্ভব? মার্কিন সরকার আমাদের সরকারের কথা না শুনে বিএনপির কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফিরিয়ে দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে? আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকা যেসব প্রতিবেদন তৈরি করে সেগুলোর তথ্য নাকি কিছু এনজিওর এবং ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে চাকরিরত বাংলাদেশি নাগরিকদের দেওয়া।
এটাও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন। যদি এটা সত্য হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ কি তাহলে? কিংবা আমেরিকায় আমাদের যে দূতাবাস আছে তার কর্মকর্তারাই বা কি করেন? দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও ধারণা কেন দেওয়া হয় না? সরকারি তথ্যের চেয়ে অন্যদের তথ্য কেন মার্কিন প্রশাসনের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়? এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার সময় এসেছে বলেই মনে হয়।
তবে বিএনপি যে ক্ষমতার বাইরে থেকে নিরুপায় হয়ে নানা ধরনের বেসামাল কাজে জড়িয়ে পড়ছে, সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জমাতে না পেরে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। বিদেশিদের সঙ্গে কিংবা ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে বিএনপি যে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে তাও মিথ্যা নয়। নানা তথ্য সম্বলিত কাগজপত্র সরবরাহ করে বিএনপি স্বস্তি বোধ করে।
Advertisement
বিদেশি কূটনীতিকরা তাদের কতটুকু আস্থায় নেন বা তারা সত্যি সরকারের ওপর কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করেন কি না তা স্পষ্ট নয়। তবে সম্প্রতি ঢাকাস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারের একটি রাষ্ট্রদূতের প্রতিক্রিয়ায় নিঃসন্দেহে বিব্রত হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি।
গত ১৭ মার্চ ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। দেড় ঘণ্টা বৈঠকের পর সাংবাদিকরা বৈঠকের বিষয়ে বিশেষত, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য জানতে চান।
জবাবে আমীর খসরু সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সম্বন্ধে বিশ্বব্যাপী সবাই অবগত আছে। এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। এসব ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্ন’। এমনকি এ ব্যাপারেও জার্মানের পর্যবেক্ষণ আছে বলে জানান তিনি।
গণমাধ্যমে দেয়া বিএনপি নেতার এমন বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে জার্মান রাষ্ট্রদূত দাবি করেন, কিছু বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিতভাবে কথা বলেছে বিএনপি। বৈঠকে যা আলোচনা হয়নি তা নিয়েও তারা মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়েছে। রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার জানান, তাকে বিএনপির নেতারা ভুলভাবে উদ্ধৃত করেছেন, যাতে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
তিনি বলেন, আমি পড়েছি (খবরের কাগজে), বিএনপি আমাকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। কথাটি এভাবে সত্য নয়। কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নয়, আমি সরাসরি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারের বৈঠকটি যদি ‘ক্লোজডোর’ হয়ে থাকে তাহলে তা নিয়ে বিএনপির আলাদা করে সংবাদ সম্মেলন করা কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে পড়ে না। তাছাড়া বিএনপির এ ধরনের আচরণ অবশ্যই অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের নজরে আসবে। এর ফলে তারা বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করতে সতর্ক থাকবে; এমনকি আগামীতে সরকারের বিরুদ্ধে করা বিএনপির অভিযোগ তারা আর বিশ্বাস করতে চাইবে না।
আবার একমাসেরও বেশি সময় পর জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার কেন এমন অসন্তোষ প্রকাশ করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। কেউ বলছেন, এই বক্তব্যের পেছনে সরকারের সম্পৃক্ততা আছে। সাংবাদিককে দিয়ে প্রশ্ন করিয়ে এমন উত্তর আদায় করা হয়েছে। এখানে বিএনপির কী করার আছে? কেউবা বলছেন, কথা কি হয়েছিল সেটা বৈঠকে যারা ছিলেন তারাই ভালো বলতে পারবেন, তবে এটা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং না করলেই হতো।
তবে জার্মান রাষ্ট্রদূতের ‘অসন্তুষ্টির’ পর কূটনৈতিকদের চোখে আপাতত ‘অবিশ্বাসী’ হিসেবে চিহ্নিত হলো বিএনপি। এতে দলটির পররাষ্ট্র উইংয়ের নেতাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ‘বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের অভাবনীয় সাফল্য’ শিরোনামে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাংবাদিক-কলামিস্ট মহিউদ্দিন খান মোহন। তিনি একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিবের দায়িত্বও পালন করেছেন। এখন তিনি বিএনপির সঙ্গে না থাকলেও বিএনপি ধারার রাজনীতিরই সমর্থক।
মোহন লিখেছেন : আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বেশির ভাগের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতরা যোগ দেননি বিএনপির ইফতার পার্টিতে। এটাকে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের বিশাল সাফল্য না বলে উপায় কী! এসব দেশ এক সময় বিএনপির বন্ধুদেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল। বিশেষ করে চীন, সৌদি আরব। তাহলে কেন তারা বিএনপি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল? বিএনপির অতিদক্ষ কূটনৈতিক উইং তাহলে এই ক' বছরে কী অর্জন করলো? দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা তো বিদেশেই থাকেন। তাহলে বিদেশিদের সাথে সম্পর্কের এমন দশা কেন? হল ভাড়া করে গুটিকয়েক কর্মী- সমর্থকের সামনে উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতা দেয়াই যে রাজনীতি নয়, সেটা বুঝতে হবে।
মোহনের পোস্টের পাল্টা একটি পোস্ট দিয়াছিলেন লে. আবু রূশদ (অব.)। তাতে তিনি লিখেছেন, কোভিডের কারণে চীনের কূটনীতিকরা তাদের দূতাবাসের বাইরে কদম ফেলেন না। এরপর আবার মোহন সাধু ভাষায় লিখেছেন : বন্ধু আবু রূশদের কথাকে সত্য ধরিয়া নিয়া নিজে নিজেই লজ্জা পাইতেছিলাম। কেননা, দেশ-বিদেশের কূটনীতিক মহলের সঙ্গে তাহার ভালোই যোগাযোগ রহিয়াছে, যাহা আমার একেবারেই নাই। কিন্তু অদ্য পত্রিকার খবরে আওয়ামী লীগের ইফতারে রাশিয়া ও চীনের অংশগ্রহণের সংবাদ দেখিয়া ধন্দে পড়িয়া গেলাম। যেই চীন করোনায় ডর পাইয়া ঘরের বাহির হয় না, তাহারা কী করিয়া গতকাল বাহির হইল! তাহলে উহারা কি আওয়ামী লীগকে ভয় পায়? তাই বিষয়টি বুঝিবার জন্য বন্ধু আবু রূশদের শরণাপন্ন হইলাম। তিনি নিশ্চয়ই এই পুরানা ইয়ারকে ধন্দ হইতে মুক্ত করিবেন।
মোহন লিখছেন : বন্ধু লে. আবু রূশদ (অব.), ছাগল দিয়া হাল চাষ করা যায় না। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির দিকে একটিবার তাকাইয়া দেখুন। সেখানে সব অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের সমাবেশ দেখিতে পাইবেন। আর বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক অঘোষিত কমিটিতে প্রধান হিসাবে রহিয়াছেন বৃহৎ শক্তিগুলি যাহাকে একেবারেই পছন্দ করে না, তেমন একজন ব্যবসায়ী-নেতা; যার ব্যক্তিস্বার্থজনিত একটি সিদ্ধান্তের কারণে বিগত বিএনপি-জোট সরকারের আমলে চীন বিএনপির দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়াছিল।
উল্লেখ্য, ওই সময় তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। আর যাহারা বিএনপির বৈদেশিক বিষয় দেখাশোনা করেন তাহাদের কাহারো কোনো কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নাই। চোখে আইশ্যাডো মারিয়া, মাসকারা মাখিয়া, আলগা পিছি লাগাইয়া, কড়া মেক-আপ মারিয়া উর্বশী সাজে সজ্জিত হইয়া অনুষ্ঠানে নিজেকে উপস্থাপন করা ছাড়া তাহারা আর কোনো কর্ম সম্পাদনের যোগ্যতা রাখেনা। আবার কেউ স্কুলের গন্ডি পার হইতে না পারিয়া বিদেশে কামলা দিতে যাইয়া নানা ফন্দি- ফিকির করিয়া অর্থ-কড়ির মালিক হইয়া তাহার সদ্ব্যবহার করিয়া ওই পদে আসীন হইয়াছেন। তাহাদের নিয়া জনসমাজে রসাত্মক কথা প্রচলিত আছে যে, বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে গিয়া এক-দুইটা ইংরেজি শব্দ উচ্চারণেরও যোগ্যতা নাই। কেহ কেহ বলেন, পদ কিনিয়া সদ্য বিএনপির আন্তর্জাতিক নেতা হওয়া সৌদি পরবাসী লোকটি "ইউর এক্সিলেন্সি" বলিতে যাইয়া ভয়াবহ ধরনের এক্সিডেন্ট ঘটাইয়া ফেলিতে পারে। সুতরাং, এইসব অপোগন্ড দ্বারা বিএনপি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কী করিতে পারিবে, তাহা বুঝিতে আর বাকি নাই। এখন, বন্ধু রূশদ আমাকে বিষয়টি বুঝাইয়া বলিলে মনে শান্তি পাইতাম।
ঘরের কথা পরে জানলো কেমনে – এই প্রশ্ন বিএনপির কেউ করলে তার জবাব পরে দেওয়া যাবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম