ব্রিটিশ লেখক ও কবি মার্টিন টাপার বলেছেন, ‘বই হচ্ছে সব বন্ধুর সেরা বন্ধু। পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম তাঁর বেহেশতের সরঞ্জামের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে বইয়ের কথা ভোলেননি। মার্কিন দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরু বলে গেছেন: ‘সবচেয়ে ভালো বইগুলো আগেভাগে পড়ে রাখো। কারণ, ওগুলো পড়ার সময় আখেরে না-ও পেতে পারো।’
Advertisement
এদিকে, খানিকটা অভিমানবশে হলেও, ইংরেজ স্টেটসম্যান ও লেখক বেঞ্জামিন ডিসরেইলি বলেছিলেন, ‘প্রতি দশটি বইয়ের নয়টিই বাজে বই।’ তিনি মন্তব্যটি করেছিলেন ১৮৭০ সালে। এখন ২০২২ সাল। বেঞ্জামিনের আমলের তুলনায় বর্তমানে বই প্রকাশিত হচ্ছে ঢের বেশি। সে-সব বইয়ের প্রতি দশটির মধ্যে নয়টিই ‘বাজে’ কি না বলা মুশকিল। তবে, বেঞ্জামিনের মৃত্যুর (১৮৮১) পরে জন্ম নেওয়া, তাঁরই স্বদেশি লেখক, হাক্সলি বলেছিলেন: একটি বাজে বই সৃষ্টি করতেও সংশ্লিষ্ট লেখককে কষ্ট করতে হয়, হতে হয় যথেষ্ট আন্তরিক।
সৈয়দ মুজতবা আলীর কল্যাণে মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরি গড়ে তোলার কাহিনীও সবাই জানেন। টোয়েন বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে আর ফেরত দিতেন না এবং এভাবেই নাকি তিনি গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক লাইব্রেরি। তবে, মুজতবা আলীর কাছ থেকে যে-তথ্যটি আমরা জানতে পারিনি সেটি হচ্ছে: টোয়েন কি শুধু ভালো ভালো বই মেরে দিয়েই নিজের লাইব্রেরি সাজিয়েছিলেন, নাকি বাজে বইও তার লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছিল!
সৈয়দ সাহেব অবশ্য ‘ভালো বই’ ও ‘বাজে বই’-এ মধ্যে পার্থক্য করার চেয়ে বরং বাঙালিকে বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতেই বেশি কসরত করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ‘বই কিনে কেই দেউলে হয়নি’ আমরা সবাই জানি। বই পড়ে আনাতোল ফ্রাঁসের মতো ‘মনের চোখ’ বাড়ানোর বা বাট্রার্ন্ড রাসেলের মতো ‘এক গাদা নতুন ভুবন’ সৃষ্টি করার লোভও তিনি বাঙালিকে দেখিয়েছেন। তাতে কতোটা কাজ হয়েছে বলা মুশকিল। আজও প্রতিবছর বইমেলার সময় শুনতে হয়: বাঙালি বই কেনে না, বই পড়ে না!
Advertisement
বই ছাপাতে কাগজ লাগে। সেই কাগজের উৎপত্তি চীনে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই চীনেই কাঠের ব্লক থেকে মুদ্রণকৌশল আবিষ্কার হয়েছিল। চীনা সভ্যতার বয়সও প্রায় পাঁচ হাজার বছরের। এই চীনেও নাকি মুদ্রিত বইয়ের কদর কমছে, মানে লোকজন আজকাল বই পড়ছেন কম। ‘নাকি’ বললাম, কারণ এই দাবির সপক্ষে পর্যাপ্ত সাক্ষী-সাবুদ নেই। দাবির পক্ষে শুধু ২০১৯ সালের একটি জরিপের ফল উল্লেখ করা যায়। জরিপ অনুসারে, ওই বছর চীনে প্রতিজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বই পড়েছেন গড়ে ৪.৭ টি করে। এর সঙ্গে যদি ই-বুক যুক্ত করা হয়, তবে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৮টিতে। অথচ জার্মান ও জাপানে প্রতিজন প্রতিবছর গড়ে অন্তত ১৬টি বই পড়েন।
আবার কেউ কেউ দাবি করেন যে, চীনারা আগের তুলনায় বেশিই বই পড়ছেন। তাদের বক্তব্য: অনেক চীনা মুদ্রিত বইয়ের পরিবর্তে কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে ই-বুক ও অন্যান্য রিডিং ম্যাটেরিয়াল পড়ছেন নিয়মিত। তাদের পড়ার পদ্ধতি বদলেছে, কিন্তু তারা বই পড়ছেন। তাদের বক্তব্যের পক্ষেও যুক্তি আছে। এক হিসাব অনুসারে, চীনে অনলাইন-পাঠকের সংখ্যা বেড়ে ৪৬ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। মানে, তাঁরা অনলাইনে কমবেশি বই-পুস্তক পড়েন।
চায়না ডেইলির সাবেক ডেপুটি এডিটর-ইন-চিফ খাং পিং অবশ্য গোটা বিষয়টাকে খানিকটা ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখছেন। তিনি মনে করেন, আজকালকার তরুণ-তরুণীরা তাদের আমলের তুলনায় কম বই পড়ছে। আজকাল তারা স্কুল-কলেজের বাইরেও নানান ধরনের কোর্স করার সুযোগ পায়, ইন্টারনেটে গেমস খেলে, পার্টি করে। তাঁর সময় তেমন সুযোগ ছিল না। তখন লোকজন জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি বিনোদনের জন্যও বই পড়তেন। স্বাভাবিকভাবেই তখন বই কেনার সামর্থ্য অধিকাংশ মানুষের ছিল না। তাই তাদেরকে বই ধার করে পড়তে হতো। এখন অবস্থা পাল্টেছে। ছেলেমেয়েদের আজকাল জ্ঞান অর্জনের জন্যও যেমন শুধু মুদ্রিত বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয় না, তেমনি বিনোদনের জন্যও বইকে আপন করে নিতে হয় না।
খাং পিংয়ের কথায় যুক্তি আছে। মনে আছে, আমরা ছোটবেলায় বিনোদনের জন্য মাঠেঘাটে খেলাধুলা করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই পড়তাম, অধিকাংশই ধার করে। সহপাঠীদের একজন একটা দস্যু বনহুর বা মাসুদ রানা কিনলে, বাকিদের আর তা কিনতে হতো না; পালাক্রমে সবাই তা পড়ার সুযোগ পেতো।
Advertisement
এসব বই ঠিক ভালো বই কি না, বলা মুশকিল, তবে ভালো বইও আমরা পড়তাম। পল্লীকবি জসিম উদদীনের ‘জীবন কথা’ বইটির কথা আমার এখনও মনে আছে। মোদ্দাকথা, ছাত্রজীবনে ভালো-মন্দ সবধরনের বইই পড়েছি; যতটা না জ্ঞান অর্জনের জন্য, তারচেয়ে বেশি বিনোদনের জন্য। এই ইন্টারনেটের যুগে এসে আমার নিজের পাঠাভ্যাসেই কি খানিকটা পরিবর্তন আসেনি? এসেছে। সুতরাং খাং পিংয়ের বক্তব্য আমার কাছে গ্রহণযোগ্যই মনে হয়।
একসময় চীনে বিদেশি বই পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং নাগরিকদের বই পড়তে উৎসাহিত করতে নানান উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় গ্রন্থপাঠ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ২৮ সেপ্টেম্বর চীনের আধ্যাত্মিক গুরু কনফুসিয়াসের জন্মদিন। চীনাদেরকে বইপাঠে উৎসাহিত করার জন্য এই দিনটির চেয়ে ভালো দিন হতে পারে না। তবে, শুধু দিবস পালনের মাধ্যমেই প্রচেষ্টা সীমিত রাখা হয়নি। চীনের প্রায় সকল প্রশাসনিক গ্রামে সাংস্কৃতিককেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে রিডিং রুম আছে; আছে প্রচুর বই, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের সংগ্রহ। পাশাপাশি আছে কম্পিউটারও।
চীনের পাবলিক লাইব্রেরির সংখ্যাও কম নয়। দেশব্যাপী সরকার ৩,১৯৬টি পাবলিক লাইব্রেরি চালায়। এসব লাইব্রেরিতে ১১০ কোটি মুদ্রিত বই, ৮৬ কোটি ৬০ লাখ ই-বুক, এবং ২২৫,০০০ কম্পিউটার আছে। এক হিসেব অনুসারে, পাবলিক লাইব্রেরিগুলো থেকে ২০২১ সালে লোকজন পড়ার জন্য ধার করেছেন ৫৪ কোটি ১০ লাখ বই। চট করে সংখ্যাটা অনেক বড় মনে হলেও, আসলে বড় নয়। কারণ, চীনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। তাছাড়া, ২০২০ সালে চীনারা বই ধার নিয়েছিল ৩৯.৩ শতাংশ বেশি।
চীনা জনগণের পাঠাভ্যাসের ওপর ২০২১ সালে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। জরিপ অনুসারে, ৫১.৮ শতাংশ চীনার প্রতিজন দিনে গড়ে অন্তত আধা ঘন্টা সময় ব্যয় করেন অনলাইনে ই-বুক বা অন্যান্য রিডিং ম্যাটেরিয়েল পড়তে। আবার যাদের বয়স কম তারা তুলনামূলকভাবে বেশি সময় একাজে ব্যয় করে। আরেক পরিসংখ্যান অনুসারে, চীনে ১৮ কোটি ৩০ লাখ শিশু-কিশোর (যারা মাইনর হিসেবে চিহ্নিত) নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এই সংখ্যা অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে বাড়ছে। কেউ কেউ বলতে পারেন, এতে আর সমস্যা কী? সমস্যা আছে। চিকিৎসকরা বলছেন, স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৩৫.৬ শতাংশ, জুনিয়র উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৭১.১ শতাংশ, এবং সিনিয়র উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৮০.৫ শতাংশ চোখের সমস্যায় (মায়োপিয়া) ভুগছে। বলা বাহুল্য, এর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্মার্টফোন ও কম্পিউটারের অতিরিক্ত ব্যবহার দায়ী। তা ছাড়া, ইন্টারনেটে শিশু-কিশোররা কী দেখছে, সেখান থেকে কী শিখছে—সেটাও একটি চিন্তার বিষয়। কারণ, ইন্টারনেটে শেখার জন্য যেমন ভালো কনটেন্টের কমতি নেই, তেমনি ক্ষতিকর বাজে কনন্টেরও অভাব নেই। আর কথায় বলে, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে।
এই সমস্যা সমাধানে চীনা সরকার কিছু কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। এতে বলা হয়: প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে স্মার্টফোনসহ কোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস আনতে পারবে না। আর যদি বিশেষ কারণে তাদেরকে এ ধরনের কোনো ডিভাইস আনতেও হয়, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে এসে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে।
এর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আরেকটি আইন জারি করে। সেই আইন অনুসারে, অনলাইন গেমিং কম্পানিগুলো শিশু-কিশোরদেরকে শুধু শুক্রবার, শনিবার, রবিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে সেবা দিতে পারবে, তা-ও আবার দৈনিক মাত্র এক ঘন্টা করে। এর বেশি সময় কোনো মাইনরকে গেইম খেলার সুযোগ দিলে সংশ্লিষ্ট কম্পানির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি, শিশু-কিশোরদের জন্য তৈরি গেমস সহিংসতা, কুসংস্কার ও অশ্লীলতামুক্তও হতে হবে।
চীনে কোনো আইন হলে, তা কঠোরভাবে প্রয়োগও করা হয়। এ আইনও যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে অভিভাবকমহল এ আইনকে স্বাগত জানিয়েছে। আইনের পর শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইন্টারনেট-আসক্তি কমার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তবে খাং পিংয়ের মতো বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারনেটে যেসব রিডিং ম্যাটেরিয়াল পাওয়া যায়, সেগুলোর মান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভালো না। এগুলো পড়ে অনেক সময় শিশু-কিশোররা জীবন সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক ধারণাও পাচ্ছে। তাই, কর্তৃপক্ষের উচিত ইন্টারনেটের রিডিং কনটেন্টের মান নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করা। এর জন্য যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষ করে, অনলাইন রিডিং প্লাটফর্মে যেসব বই পাওয়া যায়, সেগুলোর মান নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com
এইচআর/জেআইএম