মতামত

এখন 'ছোট পাকিস্তানের' আগ্রাসনে আফগানিস্তান

রাশিয়ার ১০ বছরের আগ্রাসনের পরে ২০ বছরের আমেরিকান হামলা। তবে অবশেষে পালিয়েছে সবাই। কিন্তু এবার দেশটি পাকিস্তানের হামলার শিকার। কথা বলছিলাম আমাদের এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানকে নিয়ে। সম্প্রতি পাকিস্তানের কুনার, খোস্ত ও পাকটিকা সীমান্ত থেকে ছোঁড়া রকেট হামলায় ১৪ আফগান নিহত হন।

Advertisement

সম্প্রতি পাকিস্তানের কার্যক্রমের কারণে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, পাকিস্তান আফগানিস্তানকে যে 'ভ্রাতৃত্বপূর্ণ' প্রতিবেশী বলে আখ্যা দিয়েছিল তা শুধুই ছিল লোকদেখানো।

এমনটাই বলেছেন তালেবানদের বিরুদ্ধে আফগান প্রতিরোধ যোদ্ধা জেনারেল সাইদ সামি সাদাত। এক টুইটে তিনি বলেন, পাকিস্তানি বিমান বাহিনী খোস্ত এএফজিতে ওয়াজিরিস্তানি অভিবাসী শিবিরে হামলা চালিয়েছে। এতে কুনার, খোস্ত, পাকতিকা এবং নিমরুজ প্রদেশে অন্তত ১০০ শিশু, নারী ও পুরুষ নিহত হয়েছেন। আফগান মাটিতে এমন হামলা থামাতে হবে।

শুরুতে এসব হামলার পরে পাকিস্তান চুপ থাকলেও কুনার প্রদেশের স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে রকেট ছুড়তে দেখার কথা দাবি করার পরে ইসলামাবাদ মাত্র ছয়জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করে।

Advertisement

তবে পাকিস্তানের দাবি, আফগান মাটি ব্যবহার করে তাদের দেশে হামলা চালাচ্ছে সন্ত্রাসীরা।

সম্প্রতি আফগানিস্তানের মসজিদে বোমা হামলার ঘটনায় প্রায় ৪৩ জন নিহত হন। এ ঘটনায় দেশটিতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় তালেবানদের সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশটিতে তালেবান সরকারের দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার মতই ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএল) ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে।

আফগানিস্তানের সীমান্ত ঘেঁসে রয়েছে পাকিস্তান। জঙ্গিবাদের অর্থায়নকারীদের উপর নজর রাখা আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)-ও জঙ্গিদের অর্থায়নে পাকিস্তানের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। সুতরাং আফগানিস্তানের দুর্বল তালেবান সরকারকে সর্বসম্মুখে সমর্থন দিয়ে তারা যে দেশটিতে জঙ্গিবাদের আখড়া গড়ে তুলবে না, এমন কথাও বলা যাচ্ছে না।

২০১৫ সালে জঙ্গি অর্থায়নের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ঢাকায় পাকিস্তান হাই কমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) পদে কর্মরত ফারিনা আরশাদকে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়। একই অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয় পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা মাযহার খানকে।

Advertisement

এদিকে পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের নতুন সরকারের কাছে আফগানিস্তানের সঙ্গে এ ধরণের সংঘর্ষ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া অনাস্থা ভোটের আগে ইমরান খান সরকার নিজেই পররাষ্ট্র দপ্তরকে একটি বিতর্কে ফেলে দিয়েছিলেন আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের এক মুখপাত্র বলেন, সীমান্ত অঞ্চলে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে। তারা পাকিস্তানের সীমান্ত নিরাপত্তা চৌকিতে আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছে। গত ১৪ এপ্রিল আফগানিস্তান থেকে চালানো হামলায় উত্তর ওয়াজিরিস্তান জেলায় অন্তত ৭ পাকিস্তানি সৈনিক নিহত হন। তবে এরপরেও পাকিস্তান সব ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে আফগান সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাবে বলে মন্তব্য ওই পাকিস্তানি মুখপাত্রের।

আমেরিকানরা চলে যাওয়াতেই আফগানিস্তানের মাটিতে পাকিস্তান বিমান বাহিনী হামলা চালাতে পেরেছে বলে মত অনেকের। হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে কাবুল। যদিও নানা স্বার্থগত কারণে কঠোর প্রতিবাদ জানাতে পারেনি তালেবান সরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সমস্যা সহজে সমাধানযোগ্য নয়। এ ছাড়া তালেবান শাসনের স্বীকৃতির জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে ইসলামাবাদের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে।

পাকিস্তানে শাসন বদলের দোলাচালে আফগানিস্তান কিছুটা সংকটে পড়েছিল বলে শুরুতে দাবি করেছিলেন অনেকেই। এ কারণে গত ৭ মার্চ ইসলামাবাদে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকেও আসেননি আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি।

আফগানিস্তানে দুই দশক লড়াইয়ের পর গত ৮ মাস আগে দেশটি ছেড়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। তবে সাম্প্রতিক পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের অবনতিতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ সন্তুষ্টই বলে মনে করা হচ্ছে। একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানালেও দুই পক্ষের পার্থক্যও কমে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউক্রেন ইস্যুতে ব্যস্ত রয়েছে।

পাক অঞ্চল ও পশ্চিম এশিয়ার উপর দৃষ্টি রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি দ্বৈত খেলা খেলে কাবুলে মার্কিন সরকারকে ধ্বংস ও তালেবানদের সঙ্গে আপোষ করে পাকিস্তান। ফলে কাগজে-কলমে আপত্তি করলেও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সীমান্তের উভয় পাশে আমেরিকান ড্রোন হামলায় জঙ্গিদের হত্যার ঘটনায় সমর্থন জানিয়েছে তারা।

ওই একই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের সহায়তায় কাবুলে তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে সীমান্তে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে প্রায়ই সেনাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত ডিসেম্বরে এমনই একটি সংঘর্ষে তালেবান রক্ষীরা পাকিস্তানের সীমানা দেয়াল ভেঙ্গে দুই পাক সেনাকে হত্যা করে।

রুশদের পর আমেরিকানরা ২০০১ সালে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগেই ইসলামাবাদ, ভারতে (বিশেষ করে কাশ্মীর), আফগানিস্তান ও ইরানে ব্যবহারের জন্য 'সম্পদ' হিসাবে বেশ কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠীকে লালন-পালন করেছিল। এদের মধ্যে অনেকে আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও কাজ করেছে।

তেহরিক তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) অন্তর্ভুক্ত, তালেবানের পাকিস্তানের নিজস্ব সংস্করণ জানায়, গত ১৫ বছরে তাদের অন্তত ৮০ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাড়া করলেই টিটিপি আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয়। এই যোদ্ধারা কাবুল পুনরুদ্ধারে তালেবানদের সাহায্য করেছিল। তালেবান আদর্শের দুইটি দল হলেও দুই দেশে থেকে তারা একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। একই কারণে পাকিস্তানে থাকা আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে নিরাপত্তাও দিত তারা। এই গোষ্ঠই পাকিস্তান বাহিনীকে সম্প্রতি হয়রান করে রেখেছে।

সম্প্রতি টিটিপিকে বের করে দিতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স (পিএএফ) যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে পোষা সন্ত্রাসীদের নিয়ে নিজেরা যে বিপদে রয়েছে পাকিস্তান সেটাই প্রকাশ পেল।

সেই হতাশা থেকেই গত রবিবার পাকিস্তানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে আফগান মাটি ব্যবহারের কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। এমনকি দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের শান্তি ও অগ্রগতির স্বার্থে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইসলামাবাদ।

পাকিস্তানের দাবি সত্য হতে পারে। তবে দুর্বল প্রতিবেশীর সাথে কঠোর আচরণে নিজের অক্ষমতাই প্রকাশ পাবে। যা পাকিস্তানকে নৈতিকভাবে আরো পিছিয়ে রেখেছে।

এইচআর/এএসএম