একুশ শতকে সাংবাদিকতার প্রথাগত ধারণার বাইরে গিয়ে প্রযুক্তিকে মাধ্যম করে এক যুগান্তকারী ঘটনার জন্ম দেয় উইকিলিক্স। একজন সাংবাদিকের সারাজীবনের আরাধ্য যে সব তথ্য; তার বলতে গেলে ইনসাইক্লোপিডিয়া নিয়ে হাজির হয় সাড়া জাগানো এই মাধ্যম। মার্কিন মহাফেজখানা থেকে ৪০-৫০ বছর পর সংক্ষেপিত ও কাটছাঁট করা যে সব তথ্য দেয়ার আশা করা যায়, তার আসল ও পূর্ণাঙ্গ রূপ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে হাজির করে উইকিলিক্স।
Advertisement
সালটা ২০১০। তথ্যের এই বিশাল ভাণ্ডার থেকে দু’হাত ভরে নেয় বিশ্বের ছোট-বড় প্রায় সব গণমাধ্যম। নিজেদের মতো করে প্রকাশ করতে থাকে একের পর এক স্পর্শকাতর ও রাষ্ট্রীয় ভয়ংকর সব অপরাধের খবর। যা মানুষকে আলোকিত করে। অনৈতিক সব কর্মাকাণ্ড আর হঠকারিতার কারণে মুখ পোড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের প্রশাসন ও সরকারের।
স্বভাবতই এর দাম দিতে হয় উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও তার সহযোগী মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক অ্যানালিস্ট চেলসি ম্যানিংকে। টানা সাত বছর জেল খাটেন ম্যানিং। আর লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসের ভেতরে টানা আট বছর বন্দি জীবন কাটান অ্যাসাঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুবিধা ইকুয়েডর সরকার তুলে নিলে তাকে জেলে পুরে যুক্তরাজ্য।
তিন বছর ধরে দক্ষিণ পূর্ব লন্ডনের বেলমার্শ কারাগারে আছেন তিনি। এই সময়ে নয় বছর লড়তে হয়েছে সুইডেনের আনা দুই নারীকে যৌন নিপীড়ন মামলার বিরুদ্ধে। সেখান থেকে মুক্তি মিললে নতুন মামলা নিয়ে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় করা গুপ্তচরবৃত্তির আইনে এই মামলা ঠুকে অ্যাসাঞ্জকে প্রত্যর্পণের আবেদন জানায় তারা। ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি জেলা বিচারকের আদালত মার্কিন আবেদন খারিজ করলেও, ১০ ডিসেম্বর আপিল আদালত তা অনুমোদন করে। যাতে অ্যাসাঞ্জকে প্রত্যর্পণে গেল বুধবার আদেশ দেন লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
Advertisement
অ্যাসাঞ্জ কি আসলেই দোষী?যুক্তরাষ্ট্রের কথিত জাতীয় নিরাপত্তা তথ্য ফাঁসের যে অভিযোগে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে অ্যাসাঞ্জকে তা যুক্তির বিচারে টেকে না। এমনকি মার্কিন সংবিধানেরও পরিপন্থি। ইরাক ও আফগানিস্তানে বীভৎসতার যে বয়ান সেনাদের গোপন তথ্য ভাণ্ডারে ছিল, সেটি প্রকাশ হওয়ার পর এই দুটি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়ানোর বিতর্কটা আরও উসকে দিয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সিরিয়া ও ইয়েমেনে মার্কিন ভূমিকাকে। ভেনেজুয়েলার মতো দেশে নির্বাচিত সরকার উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টা এবং কাশ্মীরে ভারতের দমন অভিযানের তথ্যও বিশ্ব জানতে পেয়েছে উইকিলিক্সের মাধ্যমে।
রাশিয়ার এমন লাখো নথি প্রকাশ করেছে যার মাধ্যমে দেশটির মানুষ তাদের অধিকারের ব্যাপারে জানতে ও সচেতন হতে পেরেছে। এমনকি মানুষের বাসা-বাড়ির আপাত সাধারণ টিভি ও মোবাইল ফোনও অজান্তে গোয়েন্দাদের তথ্য দিয়ে দিচ্ছে সেটিও জানিয়ে ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে উইকিলিক্স। মোটকথা প্রথাগত গণমাধ্যম যেখানে পৌঁছানোর স্বপ্নও কখনও দেখেনি, উইকিলিক্স শুধু সেখানে পৌঁছায়নি; তার সবটুকু খবরা-খবর কোনো ধরনের কাটছাঁট ছাড়াই সবার সামনে তুলে ধরেছে।
জনস্বার্থে ও নৈতিকতার নিরিখে অ্যাসাঞ্জ যে সব তথ্য প্রকাশ করেছেন তাকে বিপ্লব বলছেন অনেকে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদন করেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। নিন্দা জানিয়ে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন বলছে, সত্য প্রকাশের কারণে মার্কিন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন প্রকাশক গুপ্তচরবৃত্তি আইনে ফৌজদারি মামলার আসামি। অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের চেষ্টাকে সাংবাদিকতার জন্য ভয়ংকর হামলা বলছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস- সিপিজে। অভিযোগ প্রত্যাহার চেয়ে বাইডেন প্রশাসনের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন ও আইনজীবীদের জোট।
সবার শক্র অ্যাসাঞ্জবিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসক ও মার্কিন দোসরদের অনেক কুকীর্তি ফাঁস করে তাদের চির শত্রুর তালিকায় নাম লিখিয়েছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কিছুদিন আগে হিলারির নির্বাচনি প্রচারের প্রধান জন পডেস্টারের বেশ কিছু স্পর্শকাতর মেইল প্রকাশ করে ডেমোক্রেটদেরও গণশত্রুতে পরিণত হন অ্যাসাঞ্জ। যাতে রয়েছে অলাভজনক সংস্থার নামে তোলা অর্থে হিলারির স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়া।
Advertisement
পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ব্যক্তিগত সার্ভার দিয়ে সরকারি মেইল ব্যবহারের অভিযোগে এমনিতেই তখন বিপর্যস্ত ছিলেন ওই নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। তারওপর জন পডেস্টারের মেইল বিতর্ক সেই আগুনে ঘি ঢালে। ধারণ করা হয়, নির্বাচনে হিলারির হারের পেছনে এটিও ভূমিকা রেখেছে। তাই বাইডেন প্রশাসনের কাছে অ্যাসাঞ্জের প্রতি সহানুভূতির আশা করাটা একটি অতি উচ্চাশা। বরং আগামীতে এমন কোনো গোপন বিষয় যেন কারো হাতে না পৌঁছায় সেটিই নিশ্চিতের জোর চেষ্টা করতে পারে বাইডেন প্রশাসন।
উইকিলিক্সের লাখো তথ্যের সুবিধা নিয়ে একের পর এক দুর্দান্ত সব প্রতিবেদন তৈরি করেছে গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যম। বিচারের কাঠগড়ায় অ্যাসাঞ্জকে দাঁড় করানো হলেও এ সব গণামাধ্যমের দিকে আঙুলও উঁচু করা হয়নি। অ্যাসাঞ্জের সুবিচার চেয়ে সামান্য আহ্বান আর মায়া কান্নাই যেন সার হয়েছে তাদের। যদিও উইকিলিক্স সমর্থক গোষ্ঠীর কাছে অ্যাসাঞ্জ একটি বিপ্লবের নাম। তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজের জীবন বাজি রেখেছেন তিনি। যা আগামী প্রজন্মের জন্য ভালো উদাহরণ হয়ে থাকবে। বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে হয়তো কেউ আবারও উদ্যোগী হবে।
অ্যাসাঞ্জের দুর্ভাগ্যের সঙ্গী সাংবাদিকরা?বিশ্বে গেল পেশাগত দায়িত্ব পালনে কারাগারে অন্তরীণ ও কারাবাস করা সাংবাদিকের সংখ্যা ৪৮৮ জন। এ তথ্য রিপোর্টার্স উইথাউট বর্ডার্সের। তাদের গেল ২৫ বছরের তথ্য মতে এটিই সর্বাধিক। একইসাথে গেল বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। ওই বছর কর্মক্ষেত্রে প্রাণ গেছে ৪৬ সাংবাদিকের। বিশ্বের এই করুণ চিত্রের বাইরে নয় যুক্তরাষ্ট্রও। বরং সাংবাদিক নির্যাতনে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়েও পরিস্থিতি অনেক খারাপ এখানে।
ইউএস প্রেস ফ্রিডম ট্রেকার বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে গেল ৫ বছরে হামলার শিকার হয়েছেন ৮৯০ জন গণমাধ্যমকর্মী। যার অর্ধেকই ছিল ট্রাম্পের মেয়াদের শেষ বছর। চলতি বছর প্রায় দেড়শো সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন। গেল ৫ বছরে গ্রেপ্তার ও কারাগারে গেছেন আইশোর বেশি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২০২০ সালে ১৪২ জন। গেল ৫ বছরে বিভিন্ন মামলায় ১২৪ সাংবাদিককে তলব করেছে মার্কিন প্রশাসন।
অ্যাসাঞ্জের এখন কী হবে?উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে প্রত্যর্পণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্র্যাটেল। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ থাকলেও, তা বদলানোর সম্ভাবনা কম। তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হলে, ভার্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে গুপ্তচরবৃত্তি আইনে করা ১৮টি ফৌজদারি অভিযোগের বিচার হবে অ্যাসাঞ্জের। নির্দোষ প্রমাণে ব্যর্থ হলে অন্তত ১৭৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে তার। যুক্তরাষ্ট্রের এখন যে পরিস্থিতি তাতে অলীক আশাবাদী কেউ ছাড়া, অ্যাসাঞ্জের মুক্তির আশা কেউ করতে পারে না। গেল এক যুগ ধরে যে মানসিক নির্যাতনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেন উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা। এ কথা বলছেন বিশ্বখ্যাত স্নায়ুবিক মনোরাগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাইকেল কপেলম্যান।
নৈতিকতার অবক্ষয়, নেতাদের জনতুষ্টিবাদের চর্চা আর স্বার্থবাদী বিভীষিকা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আধুনিক সভ্যতাকে। যা এই মুহূর্তে বড় সংকট হয়ে ধরা দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিলুপ্ত সভ্যতাগুলোর মতো আমাদের পরিণতিও খুব ভালো হওয়ার কথা নয়। বিশ্বনেতারা বিষয়টা যে জানে না, তা নয়। কিন্তু মানার আগ্রহ নেই কারও।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল 24।
এইচআর/জিকেএস