মতামত

যত দোষ বিএনপি ঘোষ!

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও কর্মচারিদের টানা তিনদিনের সংঘর্ষে দুটি তাজা প্রাণ গেছে, শতাধিক লোক আহত হয়েছে, সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তাই এই ঘটনায় যারাই দায়ী হোক, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি এখন সব মানুষের। শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতেই পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। কিন্তু সমঝোতার আড়ালে যেন অপরাধীরা পার পেয়ে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ খুনের কোনো সমঝোতা হয় না। আসলে কোনো ফৌজদারি অপরাধেরই সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। এখন পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব সংঘর্ষস্থলে থাকা অসংখ্য টিভি ক্যামেরা আর শত শত সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করে অপরাধীদের শনাক্ত করা এবং আইনের আওতায় আনা। 

Advertisement

বাংলাদেশের পুলিশের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তারা চাইলে যে কোনো অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারে এবং গ্রেপ্তারও করতে পারে। সম্প্রতি শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার ঘটনায় মোটর সাইকেলে আসা হেলমেটধারী খুনিকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। খুন করে নির্বিঘ্নে খুনি পালিয়েও গিয়েছিল। ঘটনাস্থলে খুনি কোনো চিহ্নও রেখে যায়নি।

সবাই ভেবেছিল, এই খুনিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পুলিশ দ্রুততম সময়ে সেই খুনিকে শনাক্ত করে এবং গ্রেপ্তার করে। টিপু হত্যা রহস্য এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ নেতা খুন হয়েছেন বলে না হয়, এই মামলা নিয়ে রাজনৈতিক চাপ ছিল, তাই পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, প্রযুক্তির সহায়তায় রহস্য উন্মোচন করেছে। কিন্তু কয়েকবছর আগে মধ্যরাতে ইস্কাটনে দুই খুনের ঘটনায় পুলিশের পারফরম্যান্স আমাকে মুগ্ধ করেছে।

মধ্যরাতে এক মাতালের ছোড়া গুলিতে আহত হয় এক রিকশাচালক এবং এক সিএনজিচালক। কোনো কোনো পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছোট করে নিউজটি ছাপা হয়েছিল। সব পত্রিকা ছাপেওনি। দুদিন পর আহত দুজন হাসপাতালে মারা যান। তাদের মৃত্যুর খবরও কোনো কোনো পত্রিকার ভেতরের পাতায় ঠাঁই পেয়েছিল। তারপর সবাই ভুলে গিয়েছিল। ভোলেনি শুধু পুলিশ।

Advertisement

এই দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় মিডিয়ার চাপ ছিল না, রাজনৈতিক চাপ ছিল না, তাদের পরিবারেরও চাপ দেয়ার মত শক্তি ছিল না। সাধারণ হিসেবে এই মামলা চিরদিনের জন্য ডিপ ফ্রিজে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু নীরবে অনুসন্ধান চালিয়ে গেছে। জনকণ্ঠ ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে একটি ধাবমান গাড়ি ছাড়া আর কোনো ক্লু ছিল না। খড়ের গাদায় সুই খোঁজার মত সেই অসম্ভবকে পুলিশ সম্ভব করেছে অসাধারণ পেশাদারিত্বে।

কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসে অজগর সাপ। ইস্কাটনে মধ্যরাতে সেই জোড়া খুনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয় সরকারি দলের তখনকার সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনিকে। সেই ঘটনার পর বাংলাদেশের পুলিশের সামর্থ্যের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, পুলিশ চাইলে সবই পারে। তবে সবসময় পুলিশ চাইতে পারে না। নানা চাপে তাদের হাত পা বাঁধা থাকে।

ইস্কাটনের জোড়া খুন যদি রহস্য উপন্যাস হয়, ঢাকা কলেজের সামনের জোড়া খুন একদম জলবৎ তরলং। শত শত আলামত ছড়িয়ে আছে পত্রিকার পাকায়, টেলিভিশনের পর্দায়, ইউটিউবে আর সিসিটিভিতে। ঘটনা যেহেতু দিনেদুপুরে হয়েছে তাই প্রত্যক্ষদর্শীরও অভাব হবে না। তবে তিনদিনের সংঘর্ষে যেহেতু অনেক মানুষ অংশ নিয়েছে, তাই পুলিশকে অনুসন্ধানটা করতে হবে সাবধানে। অপরাধী কেউ যাতে পার না পায়, এটা যেমন নিশ্চিত করতে হবে।

আবার নিরপরাধ কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়, সেটা আরো বেশি করে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের আইনের মূল কথাই হলো, দশ জন অপরাধ ছাড়া পাক, কোনো নিরপরাধ যেন সাজা না পায়। তাই যারা সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছে, যারা অস্ত্র হাতে অংশ নিয়েছে, যারা মানুষ হত্যা করেছে, যারা সম্পদ ধ্বংস করেছে; খুঁজে খুঁজে তাদের আগে গ্রেপ্তার করতে হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেকের নাম এসেছে। নিউ মার্কেটের দুই খাবারের দোকানের কোন দুই কর্মচারির মধ্যে বাগবিতন্ডা হয়েছিল।

Advertisement

ঢাকা কলেজের কোন ছাত্ররা এক কর্মচারির হয়ে মাস্তানি করতে এসেছিলেন, অস্ত্র হাতে কারা সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিলেন, কারা হেলমেট পড়ে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন; সবই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। কিছুটা গণমাধ্যমের নিজস্ব অনুসন্ধান, কিছুটা পুলিশের অনুসন্ধানকে উদ্ধৃত করে। তার মানে পুলিশের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। এখন কাজ শুধু চিহ্নিতদের আইনের আওতায়।

কিন্তু পুলিশ কাজটা শুরু করেছে উল্টোদিক থেকে। তিনদিনের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ-বিএনপি বা কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা সামনে আসেনি। সংঘর্ষ হয়েছে ঢাকা কলেজের ছাত্র এবং নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও কর্মচারিদের মধ্যে। কিন্তু পুলিশের মামলায় প্রধান আসামী করা হয়েছে মকবুল হোসেন নামে এক বিএনপি নেতাকে। তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। পুলিশের মামলার আগে এই ঘটনায় মকবুল বা কোনো বিএনপি নেতার সম্পৃক্ততার কথা শোনা যায়নি।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, নিউ মার্কেটের যে দুই দোকানের কর্মচারির মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়েছিল, সে দুটি দোকানের মালিক মকবুল হোসেন। তবে তিনি দোকান দুটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। সংঘর্ষের সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেনও না। তবে তাকেই উস্কানিদাতা হিসেবে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় চারটি মামলায় মোট আসামী ১ হাজার ৫৭৪ জন। এরমধ্যে পুলিশের মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি সবাই অজ্ঞাতনামা। কিন্তু যে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা সবাই বিএনপি এলাকার নেতাকর্মী।

বিএনপি নেতাকর্মীরা এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারবে না বা অপরাধ করতে হলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতেই হবে; এমন কোনো কথা নেই। প্রভাব থাকলে বাড়িতে বসেও উস্কানি দেয়া সম্ভব। ঘটনাস্থলে থেকে বা না থেকে কেউ সংঘর্ষে জড়ালে, তিনি বিএনপি করলেও তাকে মামলার আসামী করা যাবে, গ্রেপ্তারও করা যাবে, রিমান্ডেও নেয়া যাবে। তবে যারা সরাসরি সংঘর্ষে জড়ালো, যারা পিটিয়ে-কুপিয়ে মানুষ মারলো, তাদের না ধরে আপনি যখন ঘটনার অনেক দূরে থাকা বিএনপি নেতাকে আসামী করে, তখন বোঝা যায়, এই মামলার ভবিষ্যৎ কী।

পুলিশ যে এখানে নিজেদের পেশাদারিত্ব আর দক্ষতার প্রয়োগ ঘটাতে পারবে না, শুরুতেই সেটা তারা পরিষ্কার করে দিয়েছে। আর কোনো তদন্ত ছাড়া পুলিশ বুঝলো কীভাবে, মকবুল হোসেনই উস্কানি দিয়েছে। বিএনপি সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। সরকার সুযোগ পেলেই বিএনপি ‘সাইজ’ করে। কিন্তু ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির অবস্থা এতটাই সঙ্গীন, তারা আর সাইজ করার পর্যায়েও নেই। বিএনপির থানা পর্যায়ের নেতা যদি এত বড় সংঘর্ষ ঘটিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে সরকারি দল, প্রশাসন, পুলিশ, গোয়েন্দারা কী করে।

১২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে অনেক আগেই। তাদের চেয়ারপারসন দণ্ডিত, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনও দণ্ড নিয়ে পলাতক। বেশির ভাগ নেতাকর্মীর নামেও অসংখ্য মামলা। এতদিন পরও কিছু ঘটলেই তাতে বিএনপির সম্পৃক্ততা খোঁজা সরকারি দলের একটা প্রবণতা। বাস্তবে বিএনপির আর সেই সক্ষমতাই নেই। আসলে আমার মনে হয়, সরকারি দলের নেতারা ভয় পেয়ে বাতাসে তলোয়ার চালানোর মত, কিছু হলেই বিএনপিকে টেনে আনে। বিএনপির কেউ সত্যিই অপরাধ করলে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা যাবে। কিছু হলেই আগে বিএনপির নাম আনলেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না, আইনের শাসন থাকে না।

এ ঘটনায় গণমাধ্যমে বিএনপির কারো নাম না এলেও ছাত্রলীগের অনেকের নাম-পরিচয়-ছবি এসেছে। তবে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই, এই দোহাই দিয়ে ছাত্রলীগ অস্বীকারের পুরোনো কৌশল নেবে। কিন্তু কমিটি না থাকলেও কারা ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ করে সেটা সবাই জানে। তাই দাবি জানাচ্ছি, ছাত্রলীগের যাদের নাম ছবি পত্রিকায় এসেছে, যাদের শনাক্ত করা গেছে; তাদের আগে গ্রেপ্তার করা হোক। এই ক্ষেত্রে ঢাকা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ, পুলিশ আপনার কলেজের কাউকে গ্রেপ্তার করলেই ‘হয়রানি করা হচ্ছে’ রাস্তায় নামবেন না। যারা দোকান কর্মচারির হয়ে মাস্তানি করতে যায়, তারা আসলে কলেজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।

ঢাকা কলেজের অল্পকিছু ছাত্র এই এলাকায় চাঁদাবাজি করে, পণ্য নিয়ে পয়সা দেয় না বা কম দেয়; তাদের জন্য গোটা ঢাকা কলেজের মেধাবী ছাত্রদের ঢালাও চাঁদাবাজ বলাটা অন্যায়। আবার যারা প্রকাশ্যে পিটিয়ে-কুপিয়ে মানুষ হত্যা করে; তারা ঢাকা কলেজের ছাত্র হলেও তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এই ঘটনায় যারাই জড়িত ছাত্রলীগ হোক, বিএনপি হোক, সাধারণ ছাত্র হোক, ব্যবসায়ী হোক, কর্মচারি হোক; সবাইকেই আইনের আওতায় আনতে হবে। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেন প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে চলে না যায়। সংঘর্ষ শুরুর তিন ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ যে অন্যায় করেছে, সঠিক তদন্ত ও পেশাদারিত্বে তার প্রায়শ্চিত্ত করুক।২৪ এপ্রিল, ২০২২

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জিকেএস