আজ ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভার উপজেলার রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডি। ২০১৩ সালের এ দিনে রানাপ্লাজার ভবন ধসে নিহত হন ১ হাজার ১৭৫ জন নারী-পুরুষ। আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। এসব হতাহতদের ৪৫ ছেলে-মেয়ের ঠাঁই হয়েছে গাইবান্ধার ‘অরকা হোমস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এ হোমস তৈরি করেছে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন (অরকা)। শুরু থেকে তাদের সহায়তা করে আসছে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালে ছয় শিশু নিয়ে চট্টগ্রামে শুরু হয় অরকা হোমসের কার্যক্রম। পরে একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে অরকা হোমসের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে একটি তিনতলা ভবন, খেলার মাঠ, লাইব্রেরি ও বিনোদনের ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যসম্মত ও ঘরোয়া পরিবেশেই এখানে বেড়েছে উঠছে রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডিতে হতাহতদের ৪৫ ছেলে-মেয়ে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই সাত বছর ধরে রয়েছে এ হোমসে।
এদের কেউ মাকে হারিয়েছে, কেউ হারিয়েছে বাবাকে। আবার কেউ বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে। আছে আহতদের সন্তানও। বাবা-মা হারানো ও কষ্টের স্মৃতি এখনো তাদের চোখে জল এনে দেয়। এখানে শুধু আশ্রয় নয়, তারা পেয়েছে নতুন করে জীবন শুরু করার প্রেরণা। তাদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে হোমসের সহযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোসেনপুর মুসলিম একাডেমিতে। এছাড়া আরও ২১ শিশু অরকা হোমসের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠছে।
'
Advertisement
রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডিতে বেতন আনতে গিয়ে লাশ হন আলামিনের মা। এ সময় তার পাশে দাঁড়ায় রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্রদের সংগঠন অরকা। সুন্দর পরিবেশে থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে সে। এখন এসএসসিতে পড়ছে আলামিন।
আলামিন জানায়, ‘সেদিনের কথা মনে হলে আজও বুকটা কেঁপে ওঠে। ২৪ এপ্রিল মা রানাপ্লাজায় যান বেতন আনার জন্য। কিন্তু আর ফিরে এলেন না। ১২ দিন পর মায়ের মরদেহ শনাক্ত হয়। পরে রংপুরে গ্রামের বাড়িতে মাকে সমাহিত করা হয়। আরকা হোমসে আমি এখন ভালো আছি। তবে মায়ের কথা মনে পড়লে কান্না আসে।’
শিশু মুক্তা আক্তার জানায়, ‘বাবা-মার কথা মনে পড়লে চোখে পানি চলে আসে। নিজের মা-বাবা হারালেও আরকা হোমসে মা-বাবার আদর পেয়ে বেশ ভালো আছি।’
শিশু অলি হাসান জানায়, ‘এখানে শুধু আশ্রয় নয়, পেয়েছি নতুন জীবন। পড়াশোনা শেষ করে আমি পুলিশ অফিসার হবো।’
Advertisement
মিম আক্তার জানায়, ‘রানাপ্লাজা ধসে মা বুকে আঘাত পেয়ে ভীষণ আহত হন। সেই আঘাত এখন ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। দিনমজুর শ্রমিক বাবাও অসুস্থ্। কাজ হারিয়ে আমাদের লালন-পালনে অক্ষম তিনি। অরকা হোমস আমার থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে। আমার ছোটবোন সোনালী আক্তার বিথীও এখানে থাকে। সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আমি দশম শ্রেণিতে পড়ছি। আমরা ভালো আছি।’
গাইবান্ধার স্থানীয় বাসিন্দা আল-আমিন ইসলাম বলেন, ‘রানাপ্লাজার ভবন ধসে মাকে হারিয়েছি। এখন মায়ের কথা মনে হলে চোখে জল চলে আসে। আমার সামনে কেউ কারো মাকে ডাকলে খুব কষ্ট হয়। বিজিএমইএর মাধ্যমে অরকা হোমসে এসেছি। খুব ভালো আছি। পড়াশোনা করে মানুষের মত মানুষ হতে চাই।’
বৃষ্টি আক্তার জানায়, ‘রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডিতে মাকে হারিয়েছি। এখন মায়ের কথা বার বার মনে পড়ে। মাকে হারানোর পর এখানে এসে মায়ের মতো আদর যত্ন পেয়েছি। আমি পড়াশোনা করে চাকরি করতে চাই।’
অরকা হোমসের কার্যক্রম ২০১৪ সালে ৬ জন শিশু নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে শুরু পরে গাইবান্ধায় এ সংগঠনের কাযক্রম শুরু করে। এখনে ৪৫ জন রানা প্লাজা দুর্ঘটনা মা-বাবা হাড়ানোসহ মোট ৬৬ জন ছেলে মেয়ের যাবতীয় ভরণ থেকে শুরু করে সমস্থ্য দায়িত্ব পালন করছে এই প্রতিষ্ঠানটি। আর তাদের নিজের সন্তানের মত তাদের দেখাশোনা করছেন এখানকার দায়িত্বে থাকা তত্বাবধায়করা।
অরকা হোমসের তত্ত্বাবধায়ক মিল্লাত মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, দেশ-বিদেশে থাকা আমাদের সদস্যদের আর্থিক সহায়তার ভিত্তিতেই মূলত অরকা হোমসের ব্যয় মেটানো হয়। এছাড়া রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এখানে প্রতিমাসে লক্ষাধিক টাকা দিয়ে থাকে।
আরকা হোমসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হোসেনপুর মুসলিম একাডেমির উপাধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, অরকা হোমসে বসবাসকারী এতিম ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি মেয়েরা বড় হলে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। শিশুরা যেন বাবা-মায়ের মতো স্নেহ পায় এ জন্য খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে।
ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, আরকা হোমস আমাদের একটি প্রাণের প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে রানাপ্লাজায় হতাহত অনেকের সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিকে সার্বিক সহযোগিতা করতে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।
এসজে/জিকেএস