মতামত

বছর বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন ফি বাড়ছে কেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আবেদন শুরু হয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষে আবেদনকারীকে ফি হিসেবে গুণতে হচ্ছে ১০০০ টাকা। যা গত শিক্ষাবর্ষেও ছিল ৬৫০ টাকা, তার আগের শিক্ষাবর্ষে ছিল ৪৫০ টাকা। প্রশ্ন হলো, বছর বছর লাফিয়ে লাফিয়ে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি বাড়ছে? কেন ভর্তির আবেদন করতেই ১০০০ টাকা গুণতে হবে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের?

Advertisement

অনেকেই বলতে পারেন, এক হাজার টাকা কোনো বিষয় হলো। আপনার কাছে বিষয় না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসে, তাদের অধিকাংশের জন্যই এই টাকাটা আসলেই বিষয়। বিশেষ করে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে যাচাই করতে চায়। গণমাধ্যমে প্রায়ই খবর হয়, কত শিক্ষার্থী চান্স পাওয়ার পর ভর্তির টাকা সংগ্রহ করতে পারে না। আবার অনেকের পক্ষে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আবেদন ফি সংগ্রহ করাই মুশকিল।

এখনও দেশের অনেক পরিবারে খাবার চাহিদা মেটাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে পুড়ে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার কিনতে হয়। আবার সারাদিন দাঁড়িয়েও খাবার না পেয়ে ফেরত যাওয়ার খবর নিয়মিত গণমাধ্যমে উঠে আসছে। অনেকেই মাছ-মাংস খেতে পারে না মাসের পর মাস। অনেকে তিন বেলার জায়গায় খাবার খায় দুই বেলা। খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে খরচ কমাতে। সেসব পরিবারেও অনেকের স্বপ্ন থাকে উচ্চ শিক্ষার। তার চেয়েও যেসব পরিবার আরও নিম্ন আয়ের, সেসব পরিবারের অনেক ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন থাকে উচ্চ শিক্ষার।

কিন্তু দিন দিন এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে সব, অনেকেই এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির স্বপ্ন অনেকে দেখে না- এই খরচের কথা চিন্তা করে। সরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে যখন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে, তখন সত্যিই পড়াশোনার ইচ্ছে অনেকের হারিয়ে যায়।

Advertisement

তবে কেউ কেউ আবার ভাবে, পড়াশোনা না হোক, পরীক্ষাটা দিয়ে দেখি! চান্স তো পাব না! সেই পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে থেকেই অনেকে কষ্ট করে ৩০০/৫০০ টাকা সংগ্রহ করে বা জমিয়ে ভর্তির আবেদন করে থাকে। অতীতে দেখা গেছে, সারাবছর ঠিকমতো পড়াশোনা করতে না পারলেও, ঝা চকচকে কোচিংয়ে যেতে না পারলেও অনেকেই ভর্তি পরীক্ষায় প্রত্যাশার চেয়েও ভালো ফলাফল করছে। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে পাশের বাড়ির ‘আলালের ঘরের দুলালে’র চেয়েও এগিয়ে আছে। যদিও চান্স পাওয়ার পর ধারে-চেয়ে যেকোনোভাবেই হোক তার ভর্তির টাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ভর্তি হয় স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু সেই স্বপ্নগুলোকে মেরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গরিবের আবার কিসের উচ্চ শিক্ষা, ওরা খাটবে - এই চিন্তাতেই যেন বিভোর যথাযথ কর্তৃপক্ষ। কারণ যেভাবে ভর্তি আবেদনের ফি বাড়ছে, তাতে মনে হয়, ইচ্ছেকৃত ও পরিকল্পিতভাবে গরিবের উচ্চ শিক্ষা বা ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যেন ওরা ভর্তির আবেদনই করতে না পারে।

সত্যিই মাঝে মাঝে মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কত টাকা লাগে? বাজেটে যা থাকে, তার ৮০ শতাংশই তো বেতন-ভাতায় যায়। স্বল্প পরিসরে যা গবেষণা হয়, তাকে গবেষণা বলা যায় না বললেই চলে। পড়াশোনার মান নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। শিক্ষকরাও দলাদলি, নানান প্রকল্প, নানান কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সেখান থেকেও তাদের উপরি আয় হয়। যদিও সব শিক্ষকই এমন নয়। কিন্তু এই যে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অটুট থাকা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি বাড়ছে, তার পেছনে রয়েছেন শিক্ষকরাই। কেন?

ভর্তি পরীক্ষার ফি বছর বছর বাড়িয়ে কেন গরিব শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নকে ধূলিস্মাৎ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? কত টাকা দরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে কেন ১০০০ টাকা লাগবে?

Advertisement

গত তিন শিক্ষাবর্ষের আবেদন ফি’র চিত্রটা দেখে নেওয়া যাক। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি ছিল ৩৫০ টাকা। ১০০ টাকা বাড়িয়ে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ফি ৪৫০ টাকা করা হয়। এর পরের শিক্ষাবর্ষে (২০২০-২১) আরও ২০০ টাকা বাড়িয়ে আবেদন ফি করা হয় ৬৫০ টাকা। আসন্ন ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির আবেদন ফি একলাফে ৩৫০ টাকা বাড়িয়ে ১,০০০ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে অর্থাৎ পরপর তিন শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ফি ৬৫০ টাকা বাড়ানো হলো। অথচ অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন ফি মাত্র ৫০০ টাকা। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ টানা এখানে বেমানান, আর সেগুলোর টিউশন ফি নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটটা একটু দেখা যাক- মোট ৮৩১ কোটি ৭৯ লাখ টাকার বাজেটে বেতন, ভাতা ও পেনশন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৭৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গবেষণায় বরাদ্দ (মঞ্জুরি) করা হয়েছে মাত্র ১১ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।

বাজেট বাস্তবায়নে সরকার দেবে ৬৯৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব খাতগুলো থেকে আয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। যদিও এই বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৭০ কোটি ২৫ লাখ টাকা (বাজেটের ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ)।

এখন এই ঘাটতি মেটাতেই কি ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি বাড়ানো হয়েছে? এক লাফে ৩৫০ টাকা বেড়েছে। একটি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করতে ৬৫০ টাকাও অনেক বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফি ৫০০ টাকার নিচে রাখলে তা দিয়ে কি খরচ যোগানো সম্ভব নয়। সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি এর চেয়ে বেশি রাখার প্রয়োজন কতটা যুক্তিসঙ্গত। যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের অধিকাংশ টাকা জনগণের টাকা, সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পথই কেন গরিবের জন্য রুদ্ধ করে রাখা হবে?

ভর্তির আবেদন থেকে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মুনাফা করতে হবে? কেন এত বেশি ফি নিতে হবে? এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. আখতারুজ্জামানের দাবি, ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি বাড়ানোর পেছনে মুনাফা করার কোনো চিন্তা নেই। তিনি বলেছেন, ‘বিভাগীয় শহরগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র হওয়ায় আমাদের ব্যয়টা অনেক বেশি। গত বছর (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ) অনেক ভর্তুকি দিতে হয়েছে। যে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, খরচ তার চেয়ে বেশি হতে পারে।’ উপাচার্য জানান, গত বছরের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে ডিনরা জানিয়েছেন, এই ফি ১ হাজার ২৫০ বা ১ হাজার ৩০০ টাকা হলে যথাযথ হয়। শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে তাঁরা বলেছেন, এটি কোনোভাবেই এক হাজার টাকার ওপর নেওয়া যায় না। ভর্তুকি যাতে না দিতে হয়, তার জন্য শিক্ষকদের ভর্তি পরীক্ষার অনেক কাজই বিনা পয়সায় করতে হবে। (প্রথম আলো, ৭ জানুয়ারি ২০২২)

শিক্ষকরা ছাত্রদের জন্য বিনা পয়সায়ই তো কাজ করবেন। এজন্য তারা তো বেতন-ভাতা পান। এটা তো খুবই ভালো খবর! এখন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য যে খরচ হচ্ছে, সেটা আয়োজন করতে গিয়ে কত টাকা ভর্তুকি দিতে হয়, উপাচার্য এটা খোলাসা করলে আরও ভালো হতো। আর এই ভর্তুকি কি বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারবে না? বছরে এই একবারই তো ভর্তুকি দিতে হবে।

চলতি অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেট ৮৩১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, সেখানে সরকার দেবে ৬৯৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এই টাকা তো সাধারণ মানুষের পকেট থেকেই যায়। সেখান থেকে অল্প কিছু টাকা দিয়ে কি ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব না? উন্নয়নের নামে কত দিকে ফালতু খরচ করছে বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে-সেখানে প্রাচীর তুলে ঘিঞ্জি পরিবেশে পরিণত করা হচ্ছে।

এ ছাড়াও এক লাখ ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কাছে ৩০০ টাকা করে নিলেও ৩ কোটি টাকা হয়, তা দিয়ে কি পরীক্ষার খরচ যোগানো সম্ভব নয়? আর ৬৫০ টাকা করে নিলে হয় ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সেখানে ১০০০ টাকা করে নিলে হবে ১০ কোটি টাকা। এক লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে কি সত্যিই ১০ কোটি টাকা লাগবে? এটা কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে পাঁচটি ইউনিটে ৭ হাজার ১৪৮টি আসনের বিপরীতে মোট আবেদন করেছিলেন ৩ লাখ ২৪ হাজার ৩৪০ জন। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা কমানো হয়েছে অর্থাৎ আগে জিপিএ বেশি লাগত, এখন কম লাগবে। এর ভালো একটা দিক রয়েছে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় কোনো কারণে জিপিএ কম পেয়েও অনেকে ভর্তি হতে পারবে। আবার যেহেতু জিপিএ কম লাগবে, তাই আবেদন জমাও পড়বে বেশি। টাকাও আয় হবে বেশি।

অবশ্য শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি আবেদন ফি বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে! তাই বছর বছর শুধু লাফিয়ে বাড়াচ্ছে আবেদন ফি’র পরিমাণ। বলা যায়, একপ্রকার জিম্মি করেই শিক্ষার্থীদের কাছে এই টাকা আদায় করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছাত্রদের অধিকার, মানুষের অধিকার, ভূখণ্ডের অধিকার আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনেক। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ— সব জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান রয়েছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন করতে কেন শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে? তিন বছরের ব্যবধানে আবেদন ফি কয়েক ধাপে বেড়ে ১০০০ টাকা হলো, তার প্রতিবাদও চোখে পড়েনি। শিক্ষার্থীরাও এর প্রতিবাদ করেনি, যদিও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কয়েকজনকে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে। অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন এগিয়ে আসেনি। আর বর্তমান শিক্ষকরা তো কোনোকিছুতেই কিছু বলেন না!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি ৫০০ টাকার নিচে করা হোক। গরিব-অসহায় শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখার সুযোগ দেওয়া হোক। অন্তত ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার পথ অবারিত করা হোক।

লেখক: সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক।tanzilremon@gmail.com

এইচআর/এমএস