নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাতে রাষ্ট্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন তাদের জন্য কোটা অনেক পুরনো একটি ব্যবস্থা। কোটা ব্যবস্থা পৃথিবীর সব দেশে আছে। কোটামুক্ত দেশ বলতে আসলে কোনো দেশ নেই। যারা এই কোটার বিরোধিতা করেন বা বলেন সব কিছু মেধার ভিত্তিতে হওয়া উচিত তাদের বক্তব্য সব সময় গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ কোটার বিরুদ্ধে বলে কিন্তু তারপরও বিশ্বব্যাংকের সর্বোচ্চ পদে আমেরিকান ছাড়া কেউ বসতে পারে না। অনুরূপভাবে আইএমএফ এর শীর্ষ পদে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে কেউ নিয়োগ পায় না। যে যাই বলুক না কেন বিশ্বব্যাপীই কোটা সিস্টেম আছে। আমাদের সংবিধানের ২৯ এর ৩ এর (ক) ধারা অনুযায়ী, যারা অনগ্রসর এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সমান হতে পারেনি তাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে যে বিষয়টি নিয়ে সবাই কথা বলে তা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা। ১৯৭২ সালে যখন প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটার কথা বলা হয় তখন ৪০ শতাংশ কোটার কথা বলা হয়েছিল। কেন এটা করা হয়েছিল তা সবাই জানেন। স্বাধীন দেশে নতুন প্রশাসন যখন চলবে তখন এ ধরনের একটি কোটা ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। নতুন দেশে প্রশাসন চালানোর জন্য দু’টো জিনিস দরকার। একটি হচ্ছে মাইন্ড এবং অন্যটি হার্ট। প্রশাসনে মেধাবীদের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি অন্তর থেকে দেশের সেবা করার মানসিকতা থাকা দরকার। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি দেশ সেবার জন্য একটি অঙ্গীকার দরকার। যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তাদের দেশ প্রেম নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। তারা দেশকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে বলেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। তারা দেশের প্রতি অনেক বেশি কমিটেড হবে এটাই স্বাভাবিক। এসব বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৪০ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এখন কাগজে-কলমে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত আছে। মেধাবীদের জন্য ৪৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য ৩০, অন্যান্য ১০ শতাংশ। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি ২৭ থেকে ৩০ তম বিসিএস এর রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখেছি, কোটা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এর ব্যতিক্রম ঘটছে। কোনো সময়ই এই কোটা পূরণ হয়নি।২৭ তম হতে ৩০ তম বিসিএস এর এই কোটা পূরণ হয়েছে গড়ে ১২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ১৯৮২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৯৮৩ সালে ১৩ শতাংশ, ১৯৮৪ সালে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৯৮৫ সালে ৫ শতাংশ, ১৯৮৬ সালে ১ শতাংশ, ১৯৮৭ সালে ১ শতাংশের সামান্য বেশি, ১৯৮৮ সালে শূন্য শতাংশ, ১৯৮৯ সালে ১ শতাংশের কিছু বেশি এবং ১৯৯০ সালে ১ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা থাকলেও সেটা কোটা পূরণ হয়নি কোনো বছরই। অপরদিকে মেধা কোটায় ৪৫ শতাংশ চাকরি পাবার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে প্রতিবছরই বেশি পরিমাণে চাকুরি পেয়েছে। ২৭ তম থেকে ৩০ তম বিসিএস এর মেধা কোটায় চাকরি পেয়েছে ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রায় ৭০ শতাংশ চাকরি এখন মেধার ভিত্তিতেই হচ্ছে। মহিলা কোটা পূরণ করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, উপজাতিদের জন্য যে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত আছে; ২৭ তম হতে ৩০ তম বিসিএস-এ তা মাত্র দশমিক ৬৪ শতাংশ এ কোটা পূরণ হয়েছে। এই যে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র এর মূলে ছিল একটি বিশেষ কারণ তাহলো, মুক্তিযোদ্ধা এবং উপজাতি কোটায় লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে ইচ্ছে থাকলেও এসব কোটা পূরণ করা যাচ্ছিল না। তখন যেটা করা হয়েছিল তাহলো, সবার কোটা ঠিক রেখে উপজাতিদের জন্য পাশের নম্বর কিছুটা কমিয়ে আনা হয়। যাতে তারা কোটা পূরণ করতে পারে। বিষয়টি আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমেই হওয়া উচিত ছিল। যেহেতু সিস্টেম চালু করার আগে তেমন কোনো আলোচনা-পর্যালোচনা হয়নি। তাই এ নিয়ে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়। অনেকেই বিধি সম্মত নয়। কিন্তু আমি বলি, প্রাথমিক বাছাই পর্বে কোটা পদ্ধতি বাংলাদেশেই আছে। সামরিক বাহিনীতে এই পদ্ধতি চালু আছে। সামরিক বাহিনীতে পুরুষদের উচ্চতা প্রয়োজন হয় ৫ফুট ৪ ইঞ্চি। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা ৪ ফুট ২ ইঞ্চি। যেহেতু মহিলাদের উচ্চতা সাধারণত ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি হয় না তাই তাদের ক্ষেত্রে এটা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি করা হয়েছে। একইভাবে সারা দেশের উন্নয়ন এবং শিক্ষা ব্যবস্থা একই রকম নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে স্কুলে যেতে হলে অনেকটা পথ পেরিয়ে যেতে হয়। তাদের উন্নয়নও সমতল ভূমির মতো নয়। কাজেই তাদের কিছুটা বাড়তি সুযোগ দেয়া হলে অসুবিধা কেথায়? জেলা কোটা নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে। তারা বলছেন, এখন রাস্তা-ঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নের ফলে জেলাগুলো এখন উন্নয়নের ধারায় সামিল হয়েছে। কাজেই জেলা কোটা থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। জেলা কোটা থাকবে কিনা সেটা হয়তো অন্যভাবে চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু উপজাতি কোটা এবং মহিলা কোটা থাকার যৌক্তিকতা এখনো আছে। একটি ক্যাবিনেট কমিটি করা হয়েছিল যে কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছিল, ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩৮টি উপজেলা খুবই অনুন্নত। বাংলাদেশের যে অবস্থা এই সব উপজেলা তার চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে আছে। জেলা কোটা সেখানে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। জেলা কোটার মধ্যেও বড় ধরনের অসংগতি আছে। জনসংখ্যা অনুপাতে জেলা কোটা ভাগ করা হয়। ধরা যাক পদের সংখ্যা ১৮টি। তাহলে মেধায় চলে যাবে ৮টি পদ। ঢাকা পাবে তিনটি, রাজশাহী ২টি, চট্টগ্রাম ২টি এবং খুলনা পাবে ১টি। বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলা কোন পদ পাবে না। এর মধ্যে অনেক জটিলতা আছে। আমাদের দেখতে হবে কোটা পদ্ধতির রেজাল্ট যেন ইতিবাচক হয়। ১৯৮৯ সালে ভারতে যখন মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় তাতে ৪৯.৫০ শতাংশ কোটা রাখার কথা বলা হয়। সেখানে মুসলমান এবং দলিত সম্প্রদায়ের জন্য এই কোটা রাখা হয়। তখন ভারতের এই কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। তখন আমাদের দেশের অনেকেই বলেছেন, যারা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তারা হলো বর্ণবাদী। এই কথা কিন্তু আমাদের দেশের সুশীল সমাজই বলেছেন। কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের নিকট এসব তথ্য নেই। তারা মনে করছে, কোটার কারণে আমাদের চাকরি হচ্ছে না। কিন্তু তাদের এই ধারণা কোনভাবেই ঠিক নয়। কারণ আমি হিসেব করে দেখেছি কিভাবে কোটা ব্যবহৃত হচ্ছে। আমি দেখলাম, ৬৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ চাকরি মেধার ভিত্তিতেই হচ্ছে। কোটা বিরোধী আন্দোলন যখন হলো তখন আমাদের জাতীয় রাজনীতি তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেল। এক পর্যায়ে দেখা গেল যারা আন্দোলনকারী তাদের সঙ্গে যুদ্ধপরাধীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আন্দোলনের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য যে টেপা পুতুলগুলো আছে তা ভাঙা হলো। হেফাজতের ১৩ দফার ৭ নম্বর দফা হচ্ছে টেপা পুতুল এবং সোলার পুতুল ভাঙা। কোটা বিরোধী আন্দোলনকে যখন রাজনীতিকরণ করা হলো তখন স্বাভাবিকভাবেই সরকারকে এ্যাকশনে যেতে হলো। আমরা এটা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। আন্দোলন হতে পারে কিন্তু তাকে নিয়ে অপরাজনীতি করা হল কেনো? কোটা পদ্ধতির বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ইস্যু। বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় ছিল তারাও এটা বাতিল করার উদ্যোগ নেয় নি। কোটা সুবিধা আমাদের রাখতে হবে। কারণ এটা বাতিল করা হলে তা সংবিধানের ২৯(৩) ‘ক’ ধারার বরখেলাপ। এখনো সবাই সমপর্যায়ে আসতে পারেনি। তবে বাস্তবতার নিরিখে কোটা সিস্টেমকে পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে। কেউ একজন হাটকোর্টে এই কোটা পদ্ধাতির বিরুদ্ধে একটি রিট করেছে। মহামান্য হাইকোর্ট বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রেরণ করতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে যদি এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা আনা হয় সেটাই হবে সবচেয়ে উপযুক্ত একটি কাজ। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে এ ব্যাপারে তেমন কোনো কিছু করার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আছে। কাজেই মাননীয় আদালত এ বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন। প্রায় সবাই মনে করেন যে, কোটা ব্যবস্থা সংশোধন করা দরকার কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই এতে হাত দেবে না। কারণ বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। পণ্য রপ্তানির জন্য আমরা কোটা সুবিধা চাই। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে কোটার বিরোধিতা করি। কোটা সুবিধা নিয়ে আন্দোলন এবং এক পর্যায়ে ব্যাপক ভাংচুর এটা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। যেহেতু ইস্যুটি এখন কোর্টের এখতিয়ারে চলে গেছে তাই সরকারের উচিত হবে কোর্ট থেকে একটা সমাধান নিয়ে আসা। অনেকেই বলে থাকেন কোটা পদ্ধতি চালু থাকলে প্রশাসন মেধাশূন্য হয়ে যাবে। আমি মনে করি এ ধারণাও ঠিক নয়। শুধু প্রশাসনেরই মেধাবীদের প্রয়োজন আছে অন্যত্র নেই আমি এটা বিশ্বাস করি না। যারা প্রশাসনের লোক তারা কি করে? তারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। কিন্তু যারা সিদ্ধান্ত দেন তাদের কি মেধাবী হওয়ার দরকার নেই? বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যারা দায়িত্ব পালন করে তাদের দরকার দক্ষতা। কিন্তু সিদ্ধান্ত যারা নেবেন তারা তো রাজনীতিবিদ। আমাদের পুরো রাজনীতি যদি মেধাশূন্য হয়, যাদের আর কোনো কাজ নেই তারাই রাজনীতি করবে তাহলে কিভাবে চলবে? আমরা যদি মনে করি বিসিএস দিয়ে যিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন তিনি মেধাবী হবে আর উপজেলা চেয়ারম্যান হবে মেধাশূন্য তাহলে কোনোভাবেই ভালো কিছু আশা করা যায় না। আমরা কেনো এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে পারছি না যেখানে দেশের সেবায় মেধাবীরা রাজনীতিতে আসবে? আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মেধাবীদের রাজনীতিতে আসার সুযোগ কমে আসছে। চাকরিতে অনগ্রসরদের জন্য যেমন কোটা ব্যবস্থা আছে, রাজনীতিতে যাতে মেধাবীরা আসতে পারে তেমন একটি কোটা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করার সময় এসেছে। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/এমএস
Advertisement