মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির শব্দে যেন কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। পথ ঘাট প্রায় সবই পানিতে ডুবে গেছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নীরা দেখলো একবার। আবারো পথের দিকেই তাকিয়ে থাকে নীরা। একটা রিকশাও চেখে পড়ছে না অথচ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো বলে। রাস্তার নিয়ন আলো জ্বলে উঠেছে বেশ অনেকক্ষণ আগেই। বৃষ্টির অবিরতা আর কালো মেঘের ঘনঘটায় আজ সন্ধ্যা নেমেছে আগেই। নীরা হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলো পথও জনমানব শূন্য হতে শুরু করেছে। এক মুহূর্ত ভেবেই রাস্তায় নামলো নীরা। হাতের হাল্কা ছাতা কোনোভাবেই আড়াল করতে পারছে না নীরাকে। কেবলই বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে নীরার গায়ে। কিন্তু থেমে গেলে তো চলবে না। আজ যে সন্ধ্যায় নীরাকে বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তাকে দ্রুত বাড়ি ফিরতেই হবে। আজ অবধি আমাদের সমাজে বিয়ের কনেকে ঘটা করে পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থাপন করা হয়। আর পাত্র পক্ষতো নয় বরং কোনো রাজা-মহারাজা বাড়িতে পদধুলি দেবেন ভেবে আয়োজন চলে ব্যাপক। জীবনাচরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী পুরুষের বৈষম্য রেখা টানার জন্য উদগ্রীব সমাজ, যেন রীতিমত শাসক শাসিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে পাত্রপক্ষ আর কনেপক্ষকে।ভেজা কাক হয়ে নীরা যখন বাড়ি ফিরলো তখন ঘড়ির কাটা প্রায় সাতটা ছুই ছুই। ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা না করেই মা বলে উঠলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে জলদি তৈরি হয়ে নে। ছেলেপক্ষ এল বলে। নীরা তাকিয়ে দেখে ঘরের সবকিছু খুব পরিপাটিভাবে সাজানো। বসার ঘরে ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে ঠেকতেই চোখ পড়লো ফুলদানিতে সাজানো এক গুচ্ছ দোলনচাপার দিকে। ঘরে পা দিবে অমনি মেঝবোন চেঁচিয়ে বললো, আরে করছিস কী? তোর কাপড় থেকেতো পানি ঝরছে। ঘর নোংরা হয়ে যাবে। এদিকে নয়। অগত্যা পেছনের দরজা দিয়ে নিজ রুমের দিকে এগিয়ে গেল নীরা। রুমে ঢুকেই চক্ষু চড়কগাছ। বড় ভাবী এক বিশাল বিউটি বক্স নিয়ে বসে আছে খাটে। নীরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আর কারা এসেছে ভাবী। ভাবীর সপ্রতিভ উত্তর ‘ও নিয়ে তুমি চিন্তা কর না, সময় মত সবাই চলে আসবে। তোমার বড় ভাইয়াতো খাওয়ার আয়োজনের দায়িত্বে আর খালারা সবাই চলে এসেছেন। মাকে সাহায্য করছেন। তুমি বরং কাপড় বদলে চট জলদি সাজতে বস। মেকআপ করতে কিন্তু যথেষ্ট সময় লাগবে।’ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বলে গোষ্ঠিশুদ্ধ মানুষকে ডেকে আনার বিষয়টি নীরার বোধগম্য হল না। আর কেনইবা এত মানুষের সামনে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে বসানো হবে তাও বুঝতে পারলো না নীরা। অথচ প্রতিনিয়ত এই চর্চা যেন রোজকার ডালভাত চর্চরির মত হয়ে গেছে। এ নাকি সামাজিকতা! সমাজে মিলে মিশে চলতে হলে ভাই ব্রাদার আত্মীয় পরিজনকে ডাকতেই হয়। অবশেষে সেই ক্ষণটি হাজির হল। ঘরভর্তি লোকের সামনে নীরাকে সাজিয়ে গুছিয়ে পেশ করা হল। কিন্তু হায়! এতসব আয়োজন ভেস্তে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ুয়া মেধাবী নীরা ফেল করলো পাত্রপক্ষের অগ্নিপরীক্ষায়। এ কোনো নতুন বা বিস্ময়কর ঘটনা নয়। আবার এ কোনো অন্যায় অপরাধও নয়। পছন্দ অপছন্দের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলেরই থাকা উচিত এবং থাকেতেই হবে। কিন্তু আপত্তি কেবল এই প্রক্রিয়ায়, আর প্রশ্ন ‘সকলের’ অর্থ নিয়ে। এর অর্থ যদি প্রকৃতই হত তবে তো পাত্র-পাত্রী উভয়েরই মতামত প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কিন্তু কেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেবল পাত্রপক্ষের মত জানার জন্য অপেক্ষা করা হয়? তবে নারীটির মতের মূল্য কোথায়?আর প্রক্রিয়াতো ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। এমন ঘটনায় একটিবারও চিন্তা করা হয় না মেয়েটির সম্মান মর্যাদা ব্যক্তিত্ব কতটা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। অথবা মেয়েটির মাঝে যে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয় তা ব্যক্তির সারাজীবনকে প্রভাবিত করতে কিংবা নিজের মূল্যায়নের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সাধারণত একটি মেয়েকে যখন পাত্রপক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়, তখন প্রথমেই মেয়েটি নিজেকে অযোগ্য বলে ভাবতে শুরু করে এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি পরিবারের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবার গ্লানি ব্যক্তিকে আরো বেশি কাবু করে ফেলে এবং নিজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস কমে যায়। সর্বোপরি সামাজিকভাবে অসন্মানিত হবার কারণে মেয়েটি অন্তর্মুখি হয়ে যেতে পারে। অথচ এমন ঘটনার পরবতী সময়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে ইতিবাচক আচরণের পরিবর্তে মেয়েটির কপালো জোটে হয় তাচ্ছিল্য নতুবা অনুকম্পা। যার কোনোটিই ব্যক্তির মানসিক স্থিতির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিটি মেয়েই এক একাধিকবার এ ঘটনার শিকার হয়। আর এ সমাজ নারীকে তার শিশুকাল থেকে পুরুষের অধীনস্ততা, বশ্যতা শিকারের শিক্ষা দেয়। পুরুষতান্ত্রিকতার অমোঘ আঁধারে নারীর কণ্ঠ জাগানো কেবল অন্যায় নয় বরং পাপসম। কিন্তু সময় এসেছে এ প্রক্রিয়া বদলে দেবার। নারী একা কখনোই এর পরিবর্তন আনতে পারবে না। যদি না পরিবার ও আপনজনের সঙ্গ সমর্থন থাকে। এক্ষেত্রে মেয়ে শিশুকে শৈশব থেকেই মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে তার সকল অধিকার সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়া প্রয়োজন। শিশুর মানসিকতার চৌহদ্দি যেন কোনোভাবেই লিঙ্গ বৈষম্য দ্বারা প্রভাবিত না হয়। পাশাপাশি পরিবারের অনন্য সদস্য হিসেবে মেয়েটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং তার প্রকাশিত মতের মূল্যায়ন করতে হবে। বিয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই উপযু্ক্ত বয়সে পর্যাপ্ত শিক্ষালাভের পর মেয়ের স্বীকৃতি নিয়ে এগুতে হবে এবং জানতে হবে বিয়ের জন্য মেয়েটি মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা। পারিবারিকভাবে আয়োজিত বিয়ের কথাবার্তার ক্ষেত্রে খুব বেশি মানুষকে সম্পৃক্ত না করাই ভালো। কারণ সিদ্ধান্ত নেতিবাচক হলে নানাজনের নানা কথা মেয়েটির জন্য অপমানের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সর্বোপরি পছন্দের মাপকাঠি যদি বাহ্যিক সৌন্দর্য নির্ভর হয়ে পড়ে অথবা বৈষয়িকতার নিক্তিতে মেয়েটির যোগ্যতা বিচারের প্রয়াস চলে তবে সেই সম্মন্ধ বাদ দেয়াই ভাল। কারণ এমন পরিমাপ যন্ত্রের ফলাফল ইতিবাচক হলেও জীবনের দীর্ঘপথে তা প্রকৃত অর্থে কার্যকর ও সম্পর্কবান্ধব নাও হতে পারে। সমাজ ও পরিবারের সমর্থনই পারে সুস্থ-সুন্দর মানসিকতার দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে। লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/এমএস
Advertisement