আমাদের দেশে এখন গণতন্ত্রের কথা বেশি শোনা যায় বিএনপি নেতাদের মুখে। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি কি দেশে বিরোধী দলগুলোর জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করেছিল? এই প্রশ্ন করায় কেউ হয়তো বলবেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ সংকুচিত করেছিল বলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কেন একই ধারা অনুসরণ করবে? বিএনপির খারাপটা সহ্য করা যায়, মেনেও নেওয়া যায় কিন্তু আওয়ামী লীগের খারাপটা অসহ্য।
Advertisement
যাক, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির বা বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা করে আলোচনায় না গিয়ে বিএনপির দিকেই নজর সীমাবদ্ধ রাখা যাক। কারণ বিএনপি মনে করছে, আওয়ামী লীগ এখন অজনপ্রিয় দল। বিএনপির জনপ্রিয়তা নাকি তুঙ্গে। আচ্ছা বিএনপি তো প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। এই সময়ে বিএনপি কি এমন মহৎ কর্ম করেছে কিংবা দেশের মানুষের কোন সমস্যা সমাধানের দাবি নিয়ে আন্দোলন করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে? অথবা সরকারে থাকতেই বা তারা জনকল্যাণে কী এমন করেছে, যার জন্য মানুষের সমর্থন বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে? নাকি বিএনপি খামোখাই জনপ্রিয় দল?
বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশল নিয়ে কিছু বলার আগে দেখা যাক, বিএনপির ঘর কতটুকু গোছানো। দলের নেতাদের কথা শুনে মনে হয় তাদের ক্ষমতায় আসা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কথা বিএনপি বছরের পর বছর ধরে বলছে কিন্তু সরকার পতনের লক্ষণ কেউ দেখতে পারছে না।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং দলের প্রধান দুই নেতার প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় বিএনপির সাংগঠনিক সমস্যা এখন বহুমাত্রিক। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন হয়েছিল। তিন বছর পরপর কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কবে হবে সেটা কেউ বলতে পারবেন বলে মনে হয় না।
Advertisement
১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির পাঁচটি পদ শূন্য।অথচ এটা বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম। বিএনপির অধিকাংশ জেলা, উপজেলা কমিটির সম্মেলন হয় না বছরের পর বছর। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। কেউ কেউ মজা করে বলেন, বিএনপিই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ যেমন রোগ না সারিয়ে জীবন সংশয়ের কারণ হয়, তেমনি বিএনপিও রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক কিনা, তা বুঝি ভাবার সময় হয়েছে।
বহু প্রতীক্ষার পর ছাত্র দলের একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা করা হয়েছে। এই কমিটিও অসম্পূর্ণ, মাত্র পাঁচ সদস্যের। নতুন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যাকে তার ছাত্রত্ব মেয়াদোত্তীর্ণ। কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০০৩-৪ সেশনের ছাত্র। এত বছরেও তার পড়াশোনা শেষ হয়নি।
এটা কি ছাত্র দলের সভাপতি হওয়ার জন্যই? প্রতীক্ষার পুরস্কার পেয়ে তিনি নিশ্চয়ই আহ্লাদিত। কিন্তু দুষ্ট লোকেরা বলছেন, শ্রাবণের পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বাবা, বড় ভাই, মেজ ভাই, সেজ ভাই– শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থক নন, সবাই দায়িত্বশীল পদাধিকারীও। আওয়ামী পরিবারের সদস্য শ্রাবণকে ছাত্র দলের সভাপতির পদ বখশিশ দেওয়ার নেপথ্যে কোনো ‘কাহিনী’ নেই তো?
বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল হলেও দলটি এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত আছে। দলের দুই প্রধান নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের স্বাভাবিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা নেই। খালেদা জিয়া দলের চেয়ারপারসন। এক সময় তাঁর কথাই ছিল দলের নীতি। তবে ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে দলে তাঁর অবস্থান ক্রমাগত দুর্বল ও শিথিল হয়েছে। তিনি দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত।
Advertisement
দুই বছর জেলে কাটিয়ে সরকারের অনুকম্পায় জেলের বাইরে থাকলেও রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় নেই। বিএনপি একসময় স্লোগান দিয়েছে, খালেদা জিয়ার কিছু হলে, সারা বাংলায় আগুন জ্বলবে। তিনি জেলে গেলেও দেশে আগুন জ্বলেনি। এটা মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, বিএনপি যা বলে তা করার ক্ষমতা দলটির বাস্তবে নেই।
খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে। নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। কিন্তু দলের নেতৃত্ব পরিবারের হাতছাড়া করতে চান না। তাই জেলে যাওয়ার আগে পুত্র তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে বসিয়েছেন। কিন্তু তারেকের ভাবমূর্তি ভালো নয়। খালেদা জিয়ার শাসনামলে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র হাওয়া ভবন বানিয়ে তিনি যে বদমান কুড়িয়েছেন তা সহজে মোচন হওয়ার মতো নয়। তাছাড়া গত এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি লন্ডনে আছেন। তারপরও এখন তিনিই দলের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। তিনি দল চালান ‘ডিজিটাল’ পদ্ধতিতে (স্কাইপিতে)। তারেকও আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়েছেন। আইনের চোখে তিনি ‘পলাতক’।
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মতো দুজন দণ্ডিত মানুষের নামে ও গোপন নির্দেশনায় দল চালাতে গিয়ে বিএনপি এখন পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে, ভুল করছে। তারেক তার পছন্দের লোকদের নেতা বানিয়ে দলের শক্তি বাড়ানোর বদলে দলকে নড়বড়ে করছেন বলে অনেকেই মনে করেন। প্রবীণ ও ত্যাগী নেতারা তারেকের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন না। সন্দেহ- সংশয় বিএনপি না এগিয়ে স্থবির হয়ে পড়ছে।
গত সাড়ে তিন বছরে বিএনপিতে তারেক রহমান নিজের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় কাজ করছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে জেলা ও থানার নেতাদের সঙ্গে স্কাইপিতে বৈঠক করছেন তিনি। তরুণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এর মাধ্যমে নিজের পছন্দমতো অনেক জেলা কমিটিসহ ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন করেছেন। তবে ঘোষিত কমিটির একটিতেও সন্তুষ্টি নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলাকার সিনিয়র নেতা, এমনকি সাংসদ পদে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মতামত না নিয়ে জেলা-উপজেলা কমিটি করা হচ্ছে। এতে অধিকাংশ কমিটিতেই মিটছে না তৃণমূলের চাহিদা। হালে পানি পাচ্ছে না স্থানীয় অভিজ্ঞ নেতাদের মতামতও।
টাকার জোরে অনভিজ্ঞ নতুন নেতারা উঠে আসছেন। অন্যদিকে জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকেও শেষ বেলায় পদ হারানোর শঙ্কায় দিন পার করেছেন পুরনো নেতারা। শেষ বয়সে পদ হারানোর ভয়ে চুপ করে থাকা অনেক নেতাই চাপা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, দলে অবশ্যই কমিটি পুনর্গঠন প্রয়োজন। কিন্তু সেটা চাপিয়ে দেয়া নেতৃত্বে নয়। এ সব ক্ষেত্রে দলীয়প্রধান খালেদা জিয়া একটা ‘লেভেল মেনটেইন’ করতেন। তিনি বেঁচে থাকতেই আমরা মূল্যহীন।
বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কী আনবে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কী তা বলে না। এই যে রাজধানী ঢাকা একটি অচল নগরীতে পরিণত হচ্ছে, সময় ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে – এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিএনপির কোনো ভাবনার কথা তো বিএনপি নেতাদের মুখে শোনা যায় না!
দেশে খাদ্যের অভাবে হয়তো মানুষ মারা যাচ্ছে না। কিন্তু পানির অভাবে, চাষের জমিতে সময়মতো পানি না পেয়ে রাজশাহী অঞ্চলের দুই সাঁওতাল কৃষক যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন, সে খবর কি বিএনপি নেতাদের কানে পৌঁছেনি?
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞরা বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। উত্তরবঙ্গে এবার খরা চলছে, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে শুধু সেচ কাজ ব্যাহত হবে না, খাওয়ার পানিরও ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে।
পানি নিয়ে হাহাকার দূর করার কোনো পরিকল্পনা বিএনপি নেতাদের মাথায় আছে কি? এরকম আরও নতুন নতুন অনেক বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে কথা না বললে মানুষ রাজনীতিকদের আস্থায় নেবে না। শুধু অন্ধ আওয়ামী লীগবিরোধিতা, ভারতবিরোধিতা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে রাজনীতিতে অবস্থান ধরে রাখা আগের মতো আর সম্ভব না-ও হতে পারে।
শেখ হাসিনা শাসন ক্ষমতায় থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কিছু মডেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, তাই তার আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে সুধীজনদের বিরূপ সমালোচনার পরও সরকারবিরোধী আন্দোলন হয় না। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শুধু পুরনো গীত গেয়ে মানুষের মন জয় করা যাবে না। শেখ হাসিনা ক্ষমতার রাজনীতির জন্য যে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছেন, তার চেয়ে উন্নত বিকল্পের কথা না বললে আসর মাতবে বলে মনে হয় না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জেআইএম