২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে আহত পোশাকশ্রমিকদের অনেকের শারীরিক অবস্থা দিন দিনই খারাপের দিকে। তাদের অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করার পর বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছেন। সংসারে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আহত শ্রমিকদের অনেকে পেশা বদলে অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সর্বোপরি দেশের ভয়াবহ এ শিল্প ট্রাজেডির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের উপার্জনের পথ এখন অনেকাংশেই সংকুচিত।
Advertisement
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্যই জানিয়েছে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ।
সোমবার (১৮ এপ্রিল) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ জরিপ প্রকাশ করে সংস্থাটি। যেখানে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ২০০ জন শ্রমিকদের ওপর এ জরিপ চালানো হয়।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ বলছে, রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে যেসব শ্রমিক আহত হয়েছিলেন, এ বছর তাদের মধ্যে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ শ্রমিকেরই শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। যা গত বছর ছিলো ১৪ শতাংশ।
Advertisement
জরিপের তথ্য বলছে, শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান জরিপে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে যারা তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে বলে জানিয়েছেন। তারা কোমর ব্যথা, মাথা ব্যথা, হাত-পা এবং পিঠে ব্যথাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। আগের বছরগুলোর জরিপে রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে আহত শ্রমিকদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পর্যায়ক্রমে উন্নতি দেখা গেলেও এ বছরের চিত্র বিপরীত।
সংস্থাটি আরও বলছে, আহত শ্রমিকদের ৩৩ শতাংশের অবস্থা প্রায় স্থিতিশীল এবং ১০ দশমিক ৫ শতাংশের অবস্থা সম্পূর্ণ স্থিতিশীল। গত বছর যেখানে মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত ছিলেন ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, এ বছর তা বেড়ে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আহত শ্রমিকদের ৩১ শতাংশই বলেছেন, তাদের মানসিক অবস্থা প্রায় স্থিতিশীল এবং ২০ দশমিক ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ স্থিতিশীল।
শারীরিক সমস্যা বাড়ার কারণে শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে উল্লেখ করে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে আহত শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৩ শতাংশ এবং ৪৭ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থানে নিযুক্ত রয়েছেন। এদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ বলছেন, শারীরিক অক্ষমতার কারণে তারা কাজ করতে পারেন না এবং ১০ শতাংশ এখনো মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। আহত শ্রমিকদের মধ্যে ঘন ঘন কাজ পরিবর্তন করার প্রবণতা দেখা গেছে। কারণ, শারীরিক সীমাবদ্ধতার জন্য দীর্ঘ সময় একই ধরনের কাজ করার সক্ষমতা হারাচ্ছেন তারা।
জরিপ অনুসারে, ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ শ্রমিক তাদের আদি পেশা পোশাক কারখানায় ফিরে গেছেন এবং আরও ৮ শতাংশ টেইলারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। অনেকেই তাদের পেশা বদলে গৃহকর্ম, দিনমজুরি, কৃষিকাজ, বিক্রয় এবং গাড়ি চালানোর মতো পেশায় যুক্ত হয়েছেন ৷
Advertisement
জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিকের আয় করোনা মহামারির প্রভাবে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ শ্রমিক বলছেন, মহামারি চলাকালীন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ তাদের কাছে ছিল না। ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ বলছেন, তারা নিয়মিত বাসাভাড়া পরিশোধ করতে পারেননি, এবং ২২ দশমিক ৫ শতাংশ বলেছেন তারা সন্তানের সঠিক যত্ন নিতে পারেননি। ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশকে মহামারি চলাকালীন তাদের পরিবারের খাবার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য ঋণ করতে হয়েছে।
জরিপে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ৩৬ শতাংশ শ্রমিকের পারিবারিক আয় ৫ হাজার টাকার কম এবং ৩৪ শতাংশের ১০ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। আহত শ্রমিকদের ৩৫ শতাংশ বলছেন, তাদের মাসিক খরচ ১০ হাজার টাকার বেশি এবং ৩০ শতাংশের ১৫ হাজার টাকারও বেশি, যার অধিকাংশই খরচ হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা, বাসা ভাড়া, সন্তানের পড়ালেখা ও পরিবারের চিকিৎসা বাবদ।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে ৯টার দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবনটি ধসে পড়ে। এতে এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিক আহত হন। খোঁজ মেলেনি হাজারখানেকের মতো শ্রমিকের। বিশ্বের ইতিহাসে রানা প্লাজা ধস তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।
এমআইএস/এমকেআর/এমএস