ব্রিটেনে স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে মে মাসের ৫ তারিখ। দেশটার বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মূলধারার রাজনীতিতে জড়িত অনেকেই এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সে হিসেবে ব্রিটেনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা চোখে পড়ছে।
Advertisement
লন্ডনের বাইরে বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, ওল্ডামে লেবার-কনজারভেটিভ-লিবারেল ডেমোক্রেটের প্রার্থীরা আছেন। তবে এসব এলাকায় তুলনামূলকভাবে লেবার দলের প্রার্থীরা জনসমর্থনে এগিয়ে। ওল্ডামে বাংলাদেশের দুটো অঞ্চলের বাংলাদেশি মানুষের আধিক্য আছে, তাই সে নির্বাচনী এলাকায় লেবার দলের পাশাপাশি বাংলাদেশি মানুষের মূল এলাকাও (কোনো কোনো ক্ষেত্রে থানা-গ্রাম) অনেক সময় প্রভাব বিস্তার করে।
তাই দেখা গেছে কোনো কোনো সময় লেবার দলের বাইরেও কেউ কেউ নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। গত বছর স্থানীয় নির্বাচনে একজন লেবার প্রার্থী দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে লেবার দলের হয়ে হাজারো ভোটের ব্যবধানে প্রতিবারই জনপ্রতিনিধি হয়েছেন এবং কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও মাত্র ৭১ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। কারণ এর আগে লেবার দল থেকে বহিষ্কার হওয়া একজন সাবেক কাউন্সিলর স্বতন্ত্র পদে দাঁড়িয়েছিলেন তার আসনে এবং তিনি জয়ের প্রান্তসীমায় এসেছিলেন।
এ নির্বাচনেও লেবার দলের একজন বাংলাদেশি প্রার্থীর (যিনি ওই আসনের নির্বাচিত কাউন্সিলর) বিপরীতে তিনিও এ আসনের জন্য একটা শক্তিশালী প্রার্থী, তা-ও স্বতন্ত্র থেকেই। যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হ্যামলেটস হল এবারের নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন, বিশেষত বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য। এ নির্বাচনে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন টাওয়ার হ্যামলেটসের দুবার নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান। বহু আলোচনা-সমালোচনা আছে তাকে ঘিরে। বলতে গেলে দলের সাথে চ্যালেঞ্জ করে ২০১০ সালে লুৎফুর রহমান প্রথম নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হন।
Advertisement
নির্বাচনের পর তিনি ২০১৩ সালে গঠন করেন ‘টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট’ নামের একটা দল। তার নিজস্ব ইমেজের কারণে এবং কমিউনিটির একটা ভিন্ন আবেগ নিয়ে ২০১৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে লুৎফুরের দল কাউন্সিলের ৪০টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসন পায় এবং কাউন্সিলে দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের মর্যাদায় উঠে আসে।
এদিকে ২০১৫ সালে নির্বাচনী আদালতে (ইলেকশন কোর্ট) লুৎফুর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ওই বছরের ২৯ এপ্রিল তার দলটিও রাজনৈতিক দলের মর্যাদা হারায়। এরপর তার দলের কাউন্সিলরদের টানাপোড়েন চলে কাউন্সিলে। নির্বাচিত কাউন্সিলররাও বিভক্তিতে পড়েন। নেতৃত্ব নিয়েও চলে টানাহেঁচড়া। এভাবেই টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট নামক রাজনৈতিক চেতনা কিংবা একজন লুৎফুর রহমানের রাজনীতির একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি হয় এখানে। নির্বাহী মেয়র হিসেবে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন অভিযোগে তিনি বরখাস্ত হয়েছিলেন এবং ররখাস্ত হওয়ার পর কোর্টের নির্দেশনায়ই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতাও হারান। পরে লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডন হওয়ায় এবং কোর্ট নির্দেশনা শেষ হওয়ার পর তিনি এবার আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন।
একসময় তিনি ছিলেন লেবার দলের কাউন্সিলর। লেবার দলের টাওয়ার হ্যামলেটসের লিডার থাকাকালীন নির্বাহী মেয়র নিয়ে গণভোটে লেবার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে লেবার পার্টির সাথে তার দ্বন্দ্বের কারণে দল থেকে সরে আসতে হয় তাকে কিংবা দলই তাকে সরিয়ে দেয়। ‘লেবার দলে বঞ্চিত হয়েছে’- কমিউনিটির এরকম একটা স্পিরিট ছিল তাকে নিয়ে সেসময়। সে কারণেই তিনি ১০ হাজারেরও অধিক ভোটে টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু যেখানেই বাংলাদেশি রাজনীতি ছায়া ফেলেছে, সেখানেই কোনো না কোনোভাবে সেই ছায়া অনেক ভালো কাজকেই ঝাপসা করে দিয়েছে, ঢেকে দিয়েছে আলোর নিচে। নির্বাচনের আগে কিংবা পরে লুৎফুর কি করেছেন, কি করেননি তার ফিরিস্তি আমি গাইবো না কিংবা বলবো না তার পরের নির্বাহী মেয়র জন বিগসের কার্যক্রমের কথাগুলো।
যে কথাটি বলতে হয়, তাহলো বাংলাদেশি কমিউনিটি কীভাবে পথ হারায় তারই প্রমাণ লুৎফুর রহমানের সেই বরখাস্ত হওয়া, ‘টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট’র দলীয় মর্যাদা হারানো এবং একে একে দল থেকে বের হয়ে নতুন নতুন প্লাটফর্মে একেকজন নেতার একীভূত হওয়া। আর সেরকমই টাওয়ার হ্যামলেটসের আরেক প্রতিশ্রুতিশীল নেত্রী রাবিনা খান (একসময়ের টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্টের নির্বাচিত কাউন্সিলর) লিবারেল ডেমোক্রেটের হয়ে নির্বাহী মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবার। যেহেতু লুৎফুরও তার দল (টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট) নিয়ে টিকে থাকতে পারেননি, সে কারণেই হয়তো শুধু রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য তার নেতৃত্বে সাবেক সতীর্থরা মিলে একটা দল গঠন করেন।
Advertisement
‘অ্যাস্প্যায়ার’ নামের এই দলটি ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত হয়। যে দলটি থেকে এবার তিনি মেয়র পদে নির্বাচন করছেন। এর আগেও লুৎফুর রহমান একজন একক নেতা হিসেবে নিজেকে বলতে গেলে ব্রান্ডিং করতে পেরেছিলেন। এবারও তিনি সেই ইমেজকেই ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নির্বাচন করছেন।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু প্রশ্ন আসতেই পারে। সাধারণত টাওয়ার হ্যামলেটস নির্বাচনে থাকে একটা ভিন্ন আমেজ। এবারের আমেজটা আরও প্রস্ফুটিত হওয়ার কথা। বিশেষত বাংলা সংবাদ মাধ্যমে এগুলো ফলাও হওয়ার কথা ছিল। যেখানে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের দুজন নির্বাচিত সাংবাদিকের স্ত্রী লেবার দলের হয়ে এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এটা আমাদের জন্য একটা ভালো সংবাদ। কিন্তু এ নির্বাচন কেন জানি বাংলা গণমাধ্যমে বাঙালিপাড়ার অন্যান্য নির্বাচনের মতো উত্তাপ ছড়াতে পারছে না। হয়তো এর কিছু কারণও থাকতে পারে, নির্বাচনে প্রচারণা একদম ধীর-শীতল। লুৎফুর সমর্থকরা দেরিতে হলেও তার মেয়র থাকাকালীন কার্যক্রম এবং আগামীর ইশতেহার তুলে ধরছেন বিভিন্ন প্রচারপত্রে। যেখানে বর্তমান মেয়রের দুর্বল দিকগুলোও তুলে আনা হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলা গণমাধ্যমেও দায়সারা গোছের রিপোর্ট ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ ধরনের রিপের্টিং দেখা যাচ্ছে। মেয়র প্রার্থী (মেয়র হিসেবে দায়িত্বে আছেন) জন বিগ্সের সমর্থনে তার দলের সমর্থনের পাশাপাশি একটা পত্রিকাও মোটামুটি প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। এ পত্রিকায় লুৎফুর রহমানের অতীত নিয়ে বেশ কিছু সমালোচনামূলক লেখা আসছে। বিজ্ঞাপনের মতো প্রতিবেদন ছাপিয়ে ‘লুৎফুর রহমানকে আপনি আবারও ভোট দেবেন?’
শিরোনাম দিয়ে কিংবা শুধু তৎকালীন বিভিন্ন বাংলা পত্রিকার নিউজ শিরোনামগুলো দিয়ে একধরনের বিজ্ঞাপননির্ভর করা হয়েছে পত্রিকাটিতে। যাতে লুৎফুর রহমানের ব্যাপারে তার ভোট রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব চিত্রায়িত করার প্রয়াস আছে। উল্লেখ্য, কয়েক বছর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ থাকার পর এ পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে মাত্র দু-তিন সপ্তাহ আগে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হচ্ছে লুৎফুর রহমানই এবারও লেবার পার্টির বিপরীতে একমাত্র শক্তিশালী প্রার্থী। যদিও কনজারভেটিভ কিংবা লিবারেল ডেমোক্রেটের কিছু নিজস্ব ভোট আছে। এবং এ ভোটগুলো টোরির প্রার্থী এলিয়ট ওয়েভার্স কিংবা লিবারেল ডেমোক্রেটের রাবিনা খানের ভোট ব্যাংকে জমা হবে বলে অনেকেই মতামত দিয়েছেন।
বাংলা গণমাধ্যমে গোটা নির্বাচন খুব একটা কাভারেজ না আসলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে আছে বিস্তর আলোচনা। অনেকেই অনেক কিছু বলছেন, লিখছেন। কাদা ছোড়াছুড়িও আছে। লক্ষ্য করা গেছে, একজন ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট খুবই দক্ষতার সাথে লুৎফুর রহমানের মেয়রকাল নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছেন। লেখাগুলো খুবই ধারালো, একজন দক্ষ সাংবাদিকের ছোয়া আছে সেখানে। কিন্তু তিনি নিজেই তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন তিনি ‘ভূত তাড়াতে ভূত’ হয়েছেন।
যদিও এ ফেসবুক আইডির নিয়ন্ত্রককে কেউ চেনে না। লুৎফুর রহমানের সময় কারা বিভিন্নভাবে সুযোগ নিয়েছেন, তাদের প্রতি ঈঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। আমি জানি না, থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে এই ভেবে কি অনেকেই নীরব বসে আছেন। তবে আরেকটা বিস্ময় আমাকে ভাবাচ্ছে- নিঃসন্দেহে একজন ভালো সাংবাদিক, যিনি এই ফেসবুক আইডি নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনি কেনইবা বেনামে তার চরিত্রটা বিকিয়ে দিচ্ছেন এখানে।
একজন ভালো সাংবাদিকের কাছে আমরা এটা আশা করতে পারি না, যা কিছু বলার, পরিচয় দিয়ে বলাটাই নৈতিকতা। নৈতিকতার বাইরে কারও এজেন্ডা বাস্তবায়ন হলুদ সাংবাদিকতায়ই পড়ে। কারণ, একটা স্বাধীন মুক্তচর্চার দেশে যে কারও ব্যক্তিগত পছন্দ-সমর্থন-পক্ষপাত থাকা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। বিগত দিনগুলোতে বর্তমান মেয়র জন বিগ্সেরও কার্যক্রমের ফিরিস্তি আছে তার ফলোয়ারদের কাছে। তার প্রতি আছে লেবার পার্টির দলীয় সমর্থন।
অন্যদিকে লেবার দল হল টাওয়ার হ্যামলেটসের ঐতিহ্যবাহী ‘সবসময়ের জয়ী’ দল, কিন্তু এই আসনকে কেন্দ্র করেই জর্জ গ্যালওয়ে স্কটল্যান্ডে থেকে এসে রেসপেক্ট পার্টির হয়ে এমপি হয়েছিলেন। বঞ্চিত হওয়ার দাবি-দাওয়া সেই লেবারের ঐতিহ্য ম্লান করে দিয়ে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় এমপি বানিয়েছিল তাকে। সেভাবেই লুৎফুরও ওঠে এসেছিলেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনের সমীকরণ কি আলাদা? ফেক আইডি বলেন আর অগত্যা আসা গণমাধ্যম কিন্তু বুমেরাং হয়ে যেতে পারে! নীরব ভোটাররা যদি আবারও ঘটিয়ে দেয় কিছু- এরকম সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কারণ টাওয়ার হ্যালটসের ইতিহাস এরকমই।
লেখক: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস