নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে ভারী যানবাহন চলাচলের সুযোগ দেয়ায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজে ফের ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে ব্যারেজেটির রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা এটিকে সরাসরি ফাটল না বলে ‘হেয়ার লাইন ক্র্যাক” বলেছেন। এর আগেও সেখানে ফাটল দেখা দেয়ায় ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর রাত ১২টা থেকে ব্যারেজের উপর দিয়ে সকল প্রকার ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বর্তমানে ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ব্যারেজের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার ও পুলিশ সদস্যরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মালবোঝাই ট্রাক পারাপার করায় এমন ফাটল দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, রক্ষকই যখন ভক্ষকের ভূমিকায় তখন দেশের এই জাতীয় সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গত ৬ জানুয়ারি ডালিয়ায় অবস্থিত তিস্তা ব্যারেজের মূল কাঠামো পরিদর্শনের সময় পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বীর প্রতীক সংরক্ষিত এলাকার সকল সিসি ক্যামেরা অকেজো দেখতে পেয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করেন। অপরদিকে তিস্তা ব্যারেজে বর্তমানে দায়িত্বে থাকা আনসার ব্যাটালিয়ন দলটির বিভিন্ন অনিয়ম কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তাদের অপসারণ করে নতুন করে আনসার বাহিনী নিয়োগ করার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্ত প্রতিমন্ত্রীর সেই নির্দেশের পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ব্যারেজের দায়িত্বে থাকা আনসার ও পুলিশ সদস্যরা।সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, মোট ৫২টি গেটের উপর দাঁড়িয়ে থাকা তিস্তা ব্যারেজের বেশকিছু স্থানে ফাটলের চিহ্ন। তিস্তা ব্যারেজের ২, ১৬, ১৭, ১৮, ২৩, ২৪, ২৭ ও ২৮ নম্বর পানি প্রবাহ গেটের পার্শ্বে মূল ব্যারেজের উপরিভাগের ফাটলগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বে নিয়োজিত পানি উন্নয়ন বোর্ড ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে তিস্তা ব্যারেজের উপর দিয়ে ১০ চাকা ও ৬ চাকার মালবোঝাই ট্রাক চলাচল করতো। এতে করে ব্যারেজে সামান্য ফাটল দেখা দেয়ায় ২০১৪ সালের শেষের দিকে ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন থেকে সন্ধ্যা নামলেই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মালবোঝাই ট্রাক পারাপার করার সুযোগ দিচ্ছেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। ফলে বর্তমানে মূল ব্যারেজের কয়েকটি স্থানে ফের ফাটল দেখা দিয়েছে বলে জানান তারা। ওই এলাকার আবুল কালাম ও আব্দুল হকসহ এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, সন্ধ্যা নামলেই ভারী যানবহন চলাচল বেড়ে যায়। আর এমন অবৈধ সুযোগের বিনিময়ে ট্রাক প্রতি ৩শ থেকে ৫শ করে টাকা নেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। তিস্তা ব্যারেজের কর্মকর্তারা পাউবো অফিসে বসে সময় কাটায়। ব্যারেজে না আসার কােণে একটি চক্র ব্যারেজটি নষ্টের পায়তারা করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, সন্ধ্যার পর তিস্তা ব্যারেজ এলাকা বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবনকারীদের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিণত হয়। সরকার তিস্তা ব্যারেজের পাহারা ও সিসি ক্যামেরা মেরামত করলে পরিস্কার হতে পারবে রাতের অন্ধকারেও ব্যারাজ এলাকায় কি হচ্ছে।এ সময় ব্যারেজের প্রবেশদ্বারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টানানো সাইনবোর্ড দেখিয়ে দিয়ে স্থানীরা বলেন, ‘ওই দেখেন, ব্যারেজের উপরে দিয়ে সকল প্রকার ট্রাক, বাসসহ ভারী যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ আছে। কিন্তু একটু অপেক্ষা করেন। দেখবেন ব্যারেজ দিয়ে কিভাবে মালবোঝাই ট্রাক চলাচল করে। এই অবস্থায় সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা যায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস নিয়মিতভাবে ব্যারেজের মূল ফটকের পাশে ছোট একটি গেট হয়ে তিস্তা ব্যারেজের উপর দিয়ে নিয়মিতভাবে চলাচল করছে। আর ট্রাক বাস যাতে করে ঢুকতে না পারে, সে কারণেই বন্ধ রাখা হয়েছে মূল গেট দুটি।এমন সময় গরু ও ইটভর্তি কয়েকটি ট্রাক এলে আনসার সদস্যরা টাকার বিনিময়ে মূল গেটটি খুলে দেন। আর অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশ সদস্যকেও ওইসব ট্রাক থেকে টাকা আদায় করতে দেখা যায়। এ সময় ক্যামেরা বের করলে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ ফেরিয়ে নেন ওই পুলিশ সদস্যরা। পরে তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে টাকা নেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন তিনি। এমনকি পুলিশের পোশাক পরিহিত ওই সদস্য মুহূর্তের মধ্যে তার নামের ব্যাজটি খুলে পকেটে রেখে দেন।এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিস্তা ব্যারেজ দোয়ানী পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজান বলেন, আমরা ট্রাক থেকে টাকা নেই না। এটি আনসাররা দেখা শোনা করেন। একইভাবে টাকার বিনিময়ে মালবোঝাই ট্রাক পারাপারে বিষয়টি অস্বীকার করেন তিস্তা ব্যারেজে আনসার ক্যাম্পের ইনচার্জ জোনাব আলী।এদিকে ব্যারেজে নতুন করে ফাটল দেখা দেয়ার বিষয়ে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পওর বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী হাফিজুল রহমান জাগো নিউজকে বলেন, তিস্তা ব্যারেজ দেশের একটি জাতীয় সম্পদ। তাই ব্যারেজটিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষায় ভারী যানবহন চলচলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপরও যদি কেউ গোপনে ট্রাক চলাচলের সুযোগ দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যদিকে বর্তমানে ব্যারেজে যে ফাটলের দাগ রয়েছে তা হেয়ার লাইন ক্র্যাক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি মেরামতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিসি ক্যামেরার দায়িত্বে থাকা এসও রহুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, সিসি ক্যামেরা ৪টি অনেক পুরাতন হওয়ায় তা নষ্ট হয়ে গেছে। জাহেদুল ইসলাম/এসএস/আরআইপি
Advertisement