যে মাঠে খেলতে আসতে শুনতে হয়েছে সমাজের নানান নিরুৎসাহীত কথা, বিশ্বমঞ্চে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে জন্মস্থান শেরপুরের সেই মাঠে ফিরেছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি। নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে পবিত্র মাহে রমজান মাসে রোজা রেখে উত্তপ্ত রোদে অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন উইকেটরক্ষক ব্যাটার।
Advertisement
কেমন ছিল জ্যোতির সেই পুরোনো দিনগুলো, বাঁধা পেরিয়ে কিভাবে পেলেন সফলতা? তিনি নিজের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পুরো গল্প জানিয়েছেন জাগো নিউজের ফিচার কন্ট্রিবিউটর মোশারফ হোসাইনকে।
ক্রিকেটটা পরিবার থেকেই পাওয়া, ভাইয়েরা উঠানে ক্রিকেট খেলতেন। আমি যখন হাঁটতে শিখি, আমার বয়স যখন ২ বছর তখন থেকে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে যাই। ধীরে ধীরে যখন বড় হলাম, বড় ভাইয়ের সঙ্গে স্টেডিয়ামে যেতাম। আমাকে খেলায় নিতো না। ভাবতো মেয়ে মানুষ ব্যথা পেতে পারে। তবে একটা সময় আমাকে খেলায় নিতে থাকে, আমিও ভালো খেলতে থাকি তখন শেরপুরের মধ্যে একটা পরিচিতি হয়ে যায় যে, একটা মেয়ে ক্রিকেট খেলে- জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমনটিই জানাচ্ছিলেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি।
জাগো নিউজ: আপনি যখন ক্রিকেট শুরু করলেন তখন আশেপাশের মানুষের কোনো নিরুৎসাহী মন্তব্যের শিকার হয়েছেন? ক্রিকেট খেলার বিষয়টি পবিরারের বাকি সদস্যরা কীভাবে নিতেন?
Advertisement
নিগার সুলতানা জ্যোতি: প্রথম প্রথম আত্মীয়-স্বজনরা আমার ক্রিকেট খেলাটা পছন্দ করতেন না। আমি ভালো শিক্ষার্থী ছিলাম। তাই তাদের ধারণা ছিল আমি অন্য কোনো জায়গাতে ভালো করতে পারবো। আমার আশেপাশের মানুষ অনেক নিরুৎসাহিত মন্তব্য করতো, বলতো মেয়েরা কেন ক্রিকেট খেলবে? এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
এই বিষয়গুলো মানসিকভাবে দ্বিধার সৃষ্টি করতো যে, আমি একটা কাজ করে যাচ্ছি কোনো সাপোর্ট পাচ্ছি না। পরিবার আমার ক্রিকেটের শুরু থেকেই সমর্থন দিতো, উৎসাহ দিতো। আমার ভাইয়া যেহেতু ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার একটা স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে খেলার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার স্বপ্নটা পূরণ হয়নি। এর জন্য তিনিই আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি বলতেন, আমি পারিনি। তুমি আমার স্বপ্নটা পূরণ করো। আমার আম্মু বলতেন, তুমি ক্রিকেটকে ভালোবেসে পেশা হিসেবে নিয়েছো, তুমি এটা চালিয়ে যাও। আমরা আছি তোমার সাথে।
জাগো নিউজ: অন্যান্য ক্রিকেটারদের তুলনায় আপনি সাবলীলভাবে ইংরেজিতে কথা বলেন। শোনা যায়, আপনার বাবা আপনাকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে ছোটবেলায় ইংরেজি শেখাতেন। সেই স্মৃতি যদি শেয়ার করতেন।
নিগার সুলতানা জ্যোতি: ছোটবেলায় বাবা আমাকে ইংরেজির ওয়ার্ড মিনিংয়ের বই এনে দিতেন। সত্যি কথা বলতে বাবা চকলেটের লোভ দেখিয়েই আমাকে ইংরেজি শেখাতেন। তিনি বলতেন তুমি যদি প্রতিদিন দুই পাতা করে শিখতে পারো তোমাকে দুই টাকার নোট দেবো আর চকলেট দেবো। দোয়েল পাখির ঐ দুই টাকার নোট ও চকলেটের লোভে সেসময় অনেক ইংরেজি শব্দ শিখি। ছোটবেলা থেকে এতো বেশি ইংরেজি শব্দ আমি শিখেছি যার কারণে পরবর্তীতে ইংরেজিতে সাবলীল কথা বলা আমার জন্য সহজ হয়েছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: ছোটবেলায় অনেকের অনেক কিছু হওয়ার স্বপ্ন থাকে। কারও ডাক্তার কেউ বা শিক্ষক হতে চায়। আপনার স্বপ্ন কী ছিল?
নিগার সুলতানা জ্যোতি: যখন ক্রিকেট শুরু করি ভাইয়া বলতেন ক্রিকেটার বানাবেন। তিনি বলতেন জাতীয় দলের হয়ে খেলবে তুমি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় পড়াশোনার সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ক্রিকেটার হওয়ার বিষয়টি মাথায় ছিল না। আবার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে যাই। একটা সময় আমার পুরো পরিবারের ইচ্ছে ছিল, আমি যেহেতু পড়াশোনায় অনেক ভালো আমাকে ডাক্তার বানাবেন। আমার একজন আত্মীয় তখন ডাক্তার হন। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে ইচ্ছেটা পরিবর্তন হয়ে যায়। আমার ওই জায়গার চেয়ে আমি ক্রিকেটে বেশি জড়িয়ে যাই। আমি মনে করি একটা মানুষ যেই কাজটাকে বেশি ভালোবাসে সেটাকেই ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়া উচিত।
জাগো নিউজ: শেরপুর থেকে বিশ্বমঞ্চে কিভাবে গেলেন? সেই এগিয়ে যাওয়ার ধাপগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
নিগার সুলতানা জ্যোতি: আমি অনুশীলন শুরু করি ২০১১ সাল থেকে। পরে ২০১৩ সালে থেকে আমি ঢাকায় অনুশীলন শুরু করি। আমি খেলাঘর সমাজ কল্যাণের হয়ে ঢাকা লিগ খেলি এবং রানের দিক দিয়ে সেরা পাঁচের মধ্যে ছিলাম। ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর, পাকিস্তানের বিপক্ষে আমার ওয়ানডে অভিষেক ঘটে।
জাগো নিউজ: যেসব মেয়ে ক্রিকেটার হতে চায়, তাদের উৎসাহিত করতে এবং পরিবারকে উৎসাহিত করতে কী বলতে চান?
নিগার সুলতানা জ্যোতি: আমি যখন ক্রিকেট শুরু করেছিলাম তখনকার তুলনায় এখন ক্রিকেট খেলা অনেক সহজ হয়ে গেছে। ২০১১ এবং ২০২২ অনেক বড় পার্থক্য আছে। আগে অনেকেই ক্রিকেট খেলাকে সহজভাবে নিতো না। আমি যখন জার্সি পরে বের হতাম, তখন অনেক বাজে মন্তব্যের শিকার হয়েছি। এখন কিন্তু অনেক মানুষ জানে মেয়েরা ক্রিকেট খেলে। তবে যারা ক্রিকেট খেলে এবং ক্রিকেটে আসতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই মেয়েদের ক্রিকেটে সম্ভাবনা আছে, ভালো করার অনেক সুযোগ আছে।
জাগো নিউজ: একটা সময় শেরপুরকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, এখন দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, আপনার ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে কার কার অবদান আছে, আপনি কাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে চান?
নিগার সুলতানা জ্যোতি: কৃতজ্ঞতা আমার পরিবারকে জানাতে চাই। এই পর্যন্ত আসার পেছনে আমার পরিবারেরই ভূমিকা বেশি। আমি জেলার মাঠে অনুশীলন করেছি। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা তখন ছিল না। তবুও ক্রীড়াসংস্থার মানুষজন অনেক সহযোগিতা করেছেন। ২০১৮ সাল থেকে এখানে অনুশীলন করছি। এখানকার কোচ রাজিব ভাই আমাকে অনেক বেশি সহযোগিতা করেন। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই শেরপুরবাসীকে, তারা আমাকে ভালোবাসে, আমার প্রতি আস্থা রেখেছে। তাদের দোয়াতে আমি এতো দূর এসেছি।
জাগো নিউজ: শেরপুরের নারী ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করতে কী ধরণের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন এবং আগামী দিনে আপনার পরিকল্পনা কী?
নিগার সুলতানা জ্যোতি: আমি যেই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছি, আমার পরবর্তী প্রজন্ম যেন সেই সমস্যার মুখে না পড়ে সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। যতটা সহযোগিতা পেলে তারাও এগিয়ে যেতে পারবে, সাধ্যমতো তা করে যাচ্ছি। আমি এখন যেখানে অনুশীলন করি সেখানকার ৮০ ভাগ মেয়েরা কিন্তু ঢাকা লিগে খেলে। তারা কিন্তু এরই মধ্যে এগিয়ে গেছে। শেরপুরের ক্রিকেট দিনদিন এগিয়েই যাচ্ছে, আগামী দিনে এটি আরও বাড়বে। অনেক খেলোয়াড়রা অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও আছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভেতরে শেরপুরের খেলোয়াড় অনেক বেশি। অনেক মেয়েরা দরিদ্র পরিবার থেকে আসে। তাদের আর্থিক হোক বা মানসিক সহযোগিতা হোক, সাধ্যমতো করা হচ্ছে।
জাগো নিউজ: আপনার গানের গলা চমৎকার। আইসিসির অফিসিয়াল পেজে আপনার গাওয়া গানের একটি অংশ শুনেছে পুরো দেশ। ক্রিকেট ব্যস্ততার মাঝে কী কখনও সংস্কৃতি চর্চা করা হয়?
নিগার সুলতানা জ্যোতি: ছোটবেলা থেকে আমার মা আমাকে গান, নাচ, আবৃত্তি ও অভিনয় শিখিয়েছেন। বাকি সব ভুলে গেছি শুধু গানটাই আছে। এই সংস্কৃতির বিষয়গুলো চর্চা না করলে আসলে থাকে না। গানটা আগে অনেক ভালো গাইতে পারতাম। হারমোনিয়াম বাজাতে পারতাম, তবলা বাজাতে পারতাম। ক্রিকেটে এত বেশি জড়িয়ে গেছি যে সেগুলোতে আর সময় দেওয়া হয়নি। তবে এখন টুকটাক তো গান গাওয়াই হয়।
এসএএস/জেআইএম