মতামত

শৃঙ্খলিত উৎসব শৃঙ্খলিত মন

বর্ষবরণ উৎসবে যেদিন পুলিশ আধা কারফিউ জারি করলো সেদিন মনে হলো বর্ষবরণকে শৃঙ্খলিত করা হলো। এ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে তিন বছর আগে। ধীরে ধীরে আরও উৎসবে শৃঙ্খল পরানো হবে। কারণ কুসংস্কারচ্ছন্ন ধর্ম ব্যবসায়ীরা এ সবের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছেন। পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের পক্ষে। বাংলাদেশের পুলিশ ধারাবাহিকভাবে এ কাজ করে আসছেন বললে মনে হবে বাড়াবাড়ি উক্তি। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন আইনে ভিকটিমদের [ধর্মের অজুহাতে] গ্রেফতার করা হয়েছে।

Advertisement

যারা ধর্ম বিরুদ্ধ কাজ করছে তাদের নয়। হয়তো প্রশাসন, পুলিশ, রাজনীতিবিদ আমাদের পেশাদারদের মনে এ ধারণা হয়েছে, মন শৃঙ্খলিত করতে পারলে শাসনে সুবিধা। এভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশ আমলে যখন সংস্কৃতিকে শৃঙ্খলিত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল তখন থেকে সমাজের প্রগতিশীল অংশ এর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। পরে রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্ব সে লড়াই এগিয়ে নেয়, সাধারণ তাতে অংশ গ্রহণ করে। সেদিক থেকে বিচার করলে মুক্তিযুদ্ধ একটি সাংস্কৃতিক লড়াইও বটে। এখন কিন্তু সে লড়াইর মাঠে প্রায় কাউকে পাওয়া যায় না।

এ দেশে লোকায়ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধর্মের ধ্বজাধারী বলে চিহ্নিত একদল লোক সব সময় অবস্থান নিয়েছিল। আমরা যে হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়ের কথা বলি সেটি কখনও এ দেশে ছিল না। মুসলমানের সৃষ্টিকর্তা এক। হিন্দু বহু দেবতায় বিশ্বাসী। মিল হয়েছিল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেটি দুই সম্প্রদায়েরই কট্টর অংশ পছন্দ করেনি। ধর্মকে ব্যবহার করেছে, যদিও ধর্মও সংস্কৃতির অঙ্গ।

বঙ্গবন্ধু এটি বুঝেছিলেন দেখে রাজনীতিতে ধর্ম নিষিদ্ধ করেছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ ধরনের কাজ সমাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়া পৃথিবীতে কোনো রাজনীতিবিদ করতে পারেননি। এবং তিনি তার সাংবিধানিক রূপও দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে আর কেউ কখনও কোনো রাজনীতিবিদ ওরকম অসম সাহসী কাজ করতে পারবেন না। এখনকার রাজনীতিবিদরা জন্মেছেন বামন হয়ে, মৃত্যুও বামন হয়ে।

Advertisement

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর এ কথাগুলো লেখার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। বরং এক ধরনের বিষাদ মনকে আচ্ছন্ন করে। গত ৭০ বছরের লড়াই কি বিফলে গেলো? হ্যাঁ, এর দায় অনেকাংশে বর্তমান রাজনীতিবিদদের ওপর বর্তায়। আমাদের ওপরও বর্তায়।

বাংলাদেশের অন্তত ৫-৬শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করুন। মোগল আমলে শাসকরা মুসলমান ছিলেন। কিন্তু সে আমলেও শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছে। ফৈজি, তানসেন, খসরু, আবুল ফজল সব তো ওই আমলেরই। আরও আগে বাংলার সুলতানী আমলেও তো একই অবস্থা। কিন্তু, ওই সময়ই তো [আরাকান ধরে] আলাওল, ভারতচন্দ্র সবাই কল্কে পেয়েছেন, বাংলা সাহিত্য পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে।

এখন কেন শুধু ধর্ম প্রশ্রয় পাচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবটা খোঁজা জরুরি। এর প্রধান কারণ, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অনেক দেশে রাজনীতিতে ধর্ম নিয়ে আসা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘিষ্টের জীবনচর্যার ওপর আঘাত হানছে। ভারতের কথা ধরুন। কী ভারত ছিল! কী ভারত হচ্ছে! তার অভিঘাত পড়ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে।

শুধু তাই নয়, বাইরে যে মানুষটির ভাবমূর্তি অসাম্প্রদায়িক, কার্যক্ষেত্রে তার ভিন্ন রূপ। আগেও ছিল, এখনও তাই। আমরা তো বিশ্বাস করি বিএনপি-জামায়াতপন্থি হলেই তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে। আওয়ামী লীগ করলে আর যাই থাকুক একটা পর্যায় পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক হবে। এখন দেখি, যত সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সরকারি প্রশাসন বা সরকারি দলের সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। গতকালেরই উদাহরণ দিই- নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্রলীগের উপ-সংস্কৃতি সম্পাদক সরোয়ার হোসাইন জীবন হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘আগামীকাল যদি কলেজে কোনো ধরনের বৈশাখ উদযাপন করা হয় এই পবিত্র মাসে, তাহলে কলেজ প্রশাসনকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে বলে দিলাম।’ [সমকাল, ৩ বৈশাখ, ১৪২৯]

Advertisement

আওয়ামী লীগ বহুজনের প্ল্যাটফর্ম কিন্তু মূল নেতৃত্ব সব সময় মধ্য বা মধ্যবাম পন্থায় থাকায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা বজায় থেকেছে। খন্দকার মোশতাক গংরা সুবিধা করতে পারেনি। এখন কি লীগ নেতৃত্ব ডান পন্থার কবলে? নাকি বিএনপি-জামায়াতপন্থিরা জায়গাগুলো দখল করে নিচ্ছে? এর জবাব দেবেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এখন না হলেও ইতিহাসের কাছে ভবিষ্যতে এ জবাব দিতেই হবে।

২ বৈশাখ হৃদয় মণ্ডলকে নিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী, শাহরিয়ার কবীর, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, মফিদুল হক প্রমুখ মুন্সিগঞ্জ গিয়েছিলাম। সেখানে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল দল/সংগঠনের প্রতিনিধিরা ছিলেন। তৃণমূলে তারা কাজ করেন। আমরা মতবিনিময় করেছিলাম। সাংসদ মৃণাল দাসও ছিলেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই মনে এ প্রশ্নগুলো জেগেছে।

তারা বলছেন, গত কয়েক বছর এবং সম্প্রতি হৃদয় মণ্ডল থেকে আমোদিনী পাল বা লতা সমাদ্দার থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ শিক্ষক-অধ্যক্ষদের একশ্রেণির ছাত্ররা অবমাননা করছে। একজন বলছিলেন, শিক্ষক দ্বিতীয় পিতা, তার যখন অবমাননা হয় তখন ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়ায়। এখানে দেখা যাচ্ছে, স্রেফ স্বার্থের কারণে এগুলো ঘটানো হচ্ছে, এখানে অনেক মতবাদের ছাত্র আছে, সরকারি লীগেরও, এবং এরা প্রশ্রয় পাচ্ছে স্থানীয় সরকারি নেতা ও প্রশাসনের।

আমার মনে হয়েছে, শিক্ষকদের যেহেতু পেশি বা অর্থ শক্তি নেই সেজন্য তাদের বেছে নেয়া হচ্ছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে জামায়াত-হেফাজত এবং বিভিন্ন এক পয়সা দুই পয়সা ধর্মভিত্তিক দল/ পির/ এরা এসবে মদত দিচ্ছে। কারণ আর কিছু নয়, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা এবং অন্তিমে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা। এ ক’বছরে যাদের টাকা করার তারা করে নিয়েছে, শেখ হাসিনার উৎখাত হলে তাদের কিছু আসে যায় না। আমাদের যায় আসে, কারণ, আমাদের এখনও এ বিশ্বাস অটুট যে রাজনৈতিকভাবে এখনও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক তিনি।

বাংলাদেশে গত ৭০ বছরে ডান পন্থা কেন প্রবল এবং এখন আরও প্রবল তার গবেষণা করে [ইতিহাস হত্যা, পাঠক্রম ও পাঠ্যবই, মাওলা ব্রাদার্স] দেখেছি, ৭০ বছর আগে প্রথম বাঙালি ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষার ইসলামীকরণ বা পাকিস্তানীকরণ শুরু করেন। এর বিরুদ্ধে তখন প্রবল প্রতিবাদ হলে তার ইসলামীকরণের নির্দেশ স্থগিত হয়। কিন্তু সেই যে ধারা শুরু হলো তা এখনও অক্ষুণ্ন। সব সময় ইতিহাসকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস হচ্ছে এদের কাছে ধর্মীয় ইতিহাস। মুসলিম লীগের এ ধারা আমাদের মানস জগতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।

এবছরও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্য ধর্মকে হেয় করা হয়েছে। মেয়ে শিশুদের হিজাব পরানো হয়েছে [বিচারপতি মানিকের মন্তব্য]। এগুলো বিএনপি-জামায়াত আমলে মেনে নেয়া যেত। শেখ হাসিনার আমলেও যদি তা হয় তাহলে পার্থক্যটা কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? যেদিন হেজাবিদের সঙ্গে পাঠ্যবইয়ে সমঝোতা হয়েছে সেদিনই বলা যেতে পারে প্রগতিশীলরা পরাজিত হয়েছে। সেই পরাজয়কে ভিত্তি করে আজ আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার উদাহরণ সাম্প্রতিক ঘটনাবলি।

ধর্মে আমাদের জীবন। বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছেন, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। বঙ্গবন্ধুর ১০০ বছর দু’বছর ধরে পালিত হলো কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই সেরা বক্তব্যের ওপর কী কাজ হলো? শেখ হাসিনা বলছেন ধর্ম ধর্মের জায়গায় উৎসব উৎসবের জায়গায়। কিন্তু আমরা কি উৎসব পালন করতে পারছি? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

স্থানীয় তৃণমূলের একজন নেতা সুন্দর একটি কথা বলেছেন, শিক্ষা কার্যক্রমে সংস্কৃতির কোনো স্থান নেই, কিন্তু ধর্মের স্থান প্রবল। ধর্মকে কেন শিক্ষায় টেনে আনতে হবে? ওই যে বললাম মানস জগতে পাকিস্তানি ছিটমহল। প্রথম শ্রেণি থেকে সৃজনশীল চর্চার জন্য যদি জায়গা দেওয়া হয় তাহলে ধর্মান্ধতা, অলীক সংস্কারের স্থান সংকুচিত হবে।

এ বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া শুধু জরুরি নয় সৃজনশীল বিষয়ের শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা প্রায় প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষক আছে। এজন্য থাকলে অসুবিধা কী? বন্ধু নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন। ৫০ বছর পরও শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন করা গেলো না।

ধরা যাক, তিন ভাইকে পাঁচ বছর বয়স থেকে বাংলা, ইংরেজি স্কুল ও মাদরাসায় পাঠানো হলো। ১৫ বছর পর দেখা যাবে তিনজন আগুন্তকের সৃষ্টি হয়েছে। তিনজনের দৃষ্টিভঙ্গি তিন রকম। ঠিকই তো। ভেবে দেখলাম, যে ইংরেজি মিডিয়াম থেকে বেরুবে সে আধা বাংলায় কথা বলবে, বাংলা তেমন পড়তে পারবে না এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানবে না। যে মাদরাসা থেকে বেরুবে সে দেশের সংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। যে বাংলা থেকে বেরুবে সে সার্টিফিকেট নিয়ে বেরুবে কিছু না জেনে। যেমন- একদিন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা সেরে বেরুচ্ছি। সেখানে একমাত্র ভিড় সার্টিফিকেট সংগ্রহ এজন্য। তিনি বললেন, বসেন।

এক তরুণ এসেছে। জানাচ্ছে যে, তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার তাদের। মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে কিছু বলো তো। সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তিনি আমাকে বললেন, দেখেন আমাদের অবস্থা! আমরা কী দেখব, আমরা তো কয়েক যুগ ধরে এসব কথা বলে আসছি। টিভিতে নতুন বর্ষে বয়স্ক ও শিশুদের প্রশ্ন করা হলো বাংলা নতুন বছর কততে পড়ল?

এখন কী মাস? অনেকে পারেনি। মানলাম, সবখানে খ্রিস্টীয় দিনপঞ্জির চর্চা। কিন্তু কোনো কিশোরই ছয় ঋতুর কথা বলতে পারেনি। এমন কেন হচ্ছে? বইয়ে কি এসব নেই? আছে, শিক্ষক পড়ান কি না জানি না। পরিবারে বাঙালিত্ব চর্চা যে নেই তাতো বোঝাই যাচ্ছে। এভাবে আমরা দেশে মানসিক উদ্বাস্তুর সৃষ্টি করছি। আমাদের বিচিত্র শিক্ষাব্যবস্থায় তিন ধরনের মানসিক উদ্বাস্তু সৃষ্টি করছি, যাদের বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায় কারণ সে উদ্বাস্তু।

মাদরাসা অংশ দেশ দখল করতে চায়, পৃথিবীর কোন দেশে এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আছে? আমরা ৫০ বছরেও শিক্ষা কাঠামো পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা করিনি। মুজিববর্ষ বা বাংলাদেশের ৫০ বছর কি তরুণদের মানস জগতে কোনো অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, করেনি। খালি ধর্মের পুরুৎপাদন করলে এরকমই হবে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন, ‘একথা অনস্বীকার্য যে এবং প্রমাণিত যে টেক্সট বুক বোর্ডে বহু ধর্মান্ধ মৌলবাদী কর্মকর্তা জাকিয়ে বসে থেকে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের জন্য এসব ঘৃণ্য কাজ করে যাচ্ছেন।’ [বাংলাদেশ প্রতিদিন]

শুধু ধর্ম মানুষকে আধুনিক করে না। বিজ্ঞান মনষ্কতা মানুষকে আধুনিক করে। পাঠ্যসূচির অন্যতম উপাদান হওয়া উচিত বিজ্ঞানমনষ্কতা ও সৃজনশীলতা। হৃদয় মণ্ডলের ঘটনাটা কী হলো। মুন্সিগঞ্জে গিয়ে জানা গেলো, যারা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে, রেকর্ড করেছে তারা ওই শ্রেণির নয়। পাশেই হেফাজতের মাদরাসা। সেখান থেকে ছাত্ররা টুপি খুলে মিছিল শুরু করে। হৃদয়ের বাড়ি ঘেরাও করে। অশোভন স্লোগান দেয়। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন, তারপর পুলিশ আসে। এক কাঠমিস্ত্রিকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে এজাহার তৈরি করে হৃদয়কে গ্রেফতার করে। বিচারক মামলা আমলে নিয়ে তাকে জেলে পাঠান। পরে তাকে জামিন দেওয়া হয়।

এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। গত কয়েক বছরে আকছার ঘটছে। এখন নির্বাচন সামনে, এগুলো ঘটতেই থাকবে। মুন্সিগঞ্জে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। ওসি এভাবে কারও সই নিতে পারেন কি না যিনি কিছুই জানেন না। এই মিথ্যা এজাহারের জন্য ওসির শাস্তি হওয়া দরকার। যে বিচারক যে ধারায় এটি আমলে নিয়েছেন তা তিনি পারেন না। তিনি বিচারকাজ জানেন না এটি প্রমাণিত। হাইকোর্টে তাকে ডাকা উচিত। যে বেআইনিভাবে রেকর্ড করে ফেৎনা সৃষ্টি করেছে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। যে প্রধান শিক্ষক হৃদয়কে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন তাকেও আইনের আওতায় আনা হয়নি।

এগুলো খুবই যৌক্তিক কথা। কিন্তু কিছুই হবে না। পুলিশের তিনটি স্তোক বাক্য আছে- এক. ক্লোজ করা, দুই. বদলি করা, তিন. প্রত্যাহার করা। শাস্তি দেওয়া নয়। বিনা কারণে ১১ দিন যে জেলে ছিলেন হৃদয় তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? অবশ্যই যে বিচারকের দেওয়া উচিত যিনি জেলে পুরেছিলেন। অধঃস্তন আদালতে আমাকেও হারতে হয়েছে। মুন্নুজান সুফিয়ান আমার বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছিলেন। লিমিটেশন আইন অনুযায়ী তা খারিজ হওয়ার কথা, বিচারক তা করেন নি।

২০০১ সালে, আমাকে রিমান্ডে নেওয়ার কথা নয়। বিচারক রিমান্ডে দিয়েছিলেন। আইন ভেঙে তারা যে কাজ করেছেন তার জন্য তাদের কিছুই হয়নি। বহাল তবিয়তে জজিয়তি করছেন। সামরিক তত্ত্বাবধায়ক আমলে মেজরের নির্দেশে যে জজকে রায় দিতে দেখেছি তিনি উচ্চপদে গেছেন। এই যে দায়হীনতা এসব আমলে নেয়া হচ্ছে না। পুলিশ ভিকটিমকে আসামি করে শাস্তি দেয়। তাদের হেফাজতে মৃত্যু হচ্ছে। বিচারপতি মানিক লিখেছেন, টিপ দেওয়ায় লতা সমাদ্দারদের হেনস্থাকারী পুলিশ নাজমুল ‘বাজারের ব্যাগকে স্ত্রী’ বানিয়েছে। যে একাজ করতে পারে সে কি না করতে পারে [ঐ]। ভয় লাগে, র‌্যাবের মতো না অবস্থা হয় পুলিশের। অথচ, র‌্যাব গত কয়েকদিনে এমন কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে, যা প্রশংসনীয়।

এসবের সঙ্গে যুক্ত বর্ষবরণ ঘটনা। পুলিশ বলল জঙ্গি হামলার সম্ভাবনা আছে। সবকিছু সীমিত করে দিলো। মানুষ যেন উৎসব না করে। এদিকে তথাকথিত মওলানারা বললেন, বর্ষবরণে [শুনেছি] শাড়ি পরা যাবে না, পাঞ্জাবি পরা যাবে না। মঙ্গল শোভাযাত্রা বেদাত। এর আগেও পুলিশ এমনটি করেছে। তথাকথিত মওলানার হুমকিতে, আমাদের পিছু হটতে হবে। যেন দেশটি আমাদের নয়। দেশটি ধর্মান্ধদের। ইসলামের ধারক-বাহক তারা। এতো অন্যায্য কথা। কিন্তু প্রশাসন এ অন্যায্যেরই পক্ষে। এভাবে আমাদের পিছু হটতে হবে খালি। অথচ র‌্যাব বলেছে, জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই।

আসলে গত দুই দশকে মানস জগৎ বদলে গেছে আমাদের। রাজনীতিবিদদেরও এখন যেই মানস জগৎ দেখছি এবং যে আওয়ামী লীগকে আমরা সমর্থন করেছি এ যেন তার থেকে ভিন্ন। এ মানস জগৎ পাকিস্তানি ছিটমহল যা সঠিক ধর্মকে গুরুত্ব দেয় না। বাঙালিত্বকে গুরুত্ব দেয় না। ধর্মীয় জ্ঞানের উৎস এখন ওয়াজ মাহফিল। আওয়ামী নেতারা ওয়াজ মাহফিলে যতটা উৎসাহী। লোকায়ত উৎসব, চিরন্তন উৎসবে ততটা উৎসাহী নয়। প্রযুক্তি সমাজে ফ্যাসাদের সৃষ্টি করছে। সরকার এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।

সরকারের এগুলো মোকাবিলা করা উচিত। মানুষকে এসব রুখে দাঁড়ানোতে সচেষ্ট করা উচিত। প্রায়ই ‘হুজুর’দের সঙ্গে আপস করে আমাদের সংস্কৃতিকে বিপন্ন করার অধিকার কারও নেই। এতে আওয়ামী লীগের ভোট বাড়বে না। বিএনপি-জামায়াতের বাড়বে। এ কথা কেউ বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে বোঝাতে পারবেন না। এসব প্রশ্ন তুললে মন্ত্রীরা তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে বলে খড়্গহস্ত হন। তারা কি জানেন এই যে ভিকটিমদের আসামি করার যে সংস্কৃতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং যা তারা প্রশ্রয় দিচ্ছেন একদিন তা তাদের বিরুদ্ধেই যাবে। শাহরিয়ার কবির সেদিন মুন্সিগঞ্জে বলেছেন, এদের কাউকে জামিন দেওয়া হয় কিন্তু মামলা তুলে নেওয়া হয় না। আজীবন তারা যাতে নাজেহাল হন সে কাজটি করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে বলেছিল, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করবে তা করেনি।

এখানে একটি বিষয় বলে রাখা দরকার, গত কয়েক বছর দেখা যাচ্ছে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু দুপক্ষেই কিছু অসিহষ্ণু মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। সংখ্যালঘুরা যদি অন্তত অসহিষ্ণুতা দেখান সংখ্যাগুরুর ধর্ম সম্পর্কে তাতে সংখ্যাগুরুর ধর্ম ব্যবসায়ীরা সুযোগ পায়। দুপক্ষেরই সহিষ্ণুতা দেখানো কাম্য। কিন্তু ধর্মের কথা কে কবে শুনেছে?

স্বদেশ রায় সপ্তাহ খানেক আগে বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে লিখেছেন-“রাষ্ট্র মানে ইতিহাস রিমান্ডে।রাষ্ট্র মানে বিজ্ঞান কারাগারে।রাষ্ট্র মানে কম জানুক সকলে।রাষ্ট্র মানে মাথা নত করুক সবাই-সকালে ও বিকালে।

এখনও যে সময় নেই তা নয়। শেখ হাসিনা নড়ে চড়ে বসলেই হয়। এখন দেখা যাচ্ছে প্রশাসনের একটি বড় অংশের মন শৃঙ্খলিত ধর্মে, জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মানস জগৎ শৃঙ্খলিত ধর্মে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের একটি অংশ বিসমিল্লাহ বলে ধর্মকে ব্যবহারে উৎসাহী নিজ স্বার্থে। বঙ্গবন্ধু এসব করতেন না। আসলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নয়, বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করা হচ্ছে স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

সংস্কৃতিকে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা বহু করা হয়েছে। ১৯ শতকে ওহাবী মতবাদকে রুখে দিয়েছিলেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, পুঁথির প্রচারের সাহায্যে। এ ভূখণ্ডকে [দেশকে] মৌলবাদী দেশ হিসেবে পরিণত করার প্রজেক্ট গত ২০০ বছরের, যা এখনও সফল হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। মাঝখানে মানসিক উন্নয়নে কয়েক দশক পেছাতে হবে। কিন্তু, এ দেশ কখনও একটি ধর্মের হবে না।

কোনো দেশই একক কোনো ধর্মের হয় না, সৌদি আরব বা এ ধরনের কয়েকটি দেশ ছাড়া। যারা হয় তারা আর ভবিষ্যতের নাগাল পায় না। এটিই ইতিহাসের সত্য। এ সত্য অনুধাবন করে আজ সৌদিরা ওহাবির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসছে আর বাংলাদেশ সেখানে আরও প্রবেশ করতে চাচ্ছে। এই ওহাবীবাদ বা ধর্মীয় জাতীয়বাদ শ্রীলঙ্কাকে ডুবিয়েছে। ডোবাবে ভারতকেও। সংস্কৃতির ধর্মায়নের বিরুদ্ধে তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে, এই শৃঙ্খলিত মনকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষা সংস্কৃতি মনে হবে উৎসবের আরেক নাম। স্লোগান হোক আমরা বাঙালি ছিলাম, বাঙালি আছি, বাঙালি থাকব।

লেখক: লেখক, ইতিহাসবিদ। বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জেআইএম/ফারুক