পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মনে করে তারা দেশকে স্থিতিশীল রাখতে পারবে। কিন্তু এটাই তাদের সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা। দেশটিতে গত ৭৫ বছরে কোনো বেসামরিক সরকার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বার বার সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণে দেশটি শাসনের অযোগ্য হয়ে পড়ছে, একের পর এক সংকট বাড়ছেই।
Advertisement
২০১৮ সালে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইমরান খান। বলা হয়ে থাকে সেনাবাহিনীর সহায়তার কারণেই তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। সে সময় সাবেক এই ক্রিকেটারকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন যোগ্য মানুষ হিসেবেই মনে করা হয়েছিল।
ক্রিকেট অঙ্গনে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। ক্ষমতায় আসার পরই ইমরান খান দেশে ব্যাপক পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। দেশের সম্পদ লুটপাটের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের জবাবদিহি করতে হবে বলে ঘোষণা দেন। তবে অনেকেই বলেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল এবং এই প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত ছিল।
পাকিস্তানের শাসনে থাকা আগের দলগুলো থেকেও তার দলের কার্যক্রম অনেকটাই ভিন্ন ছিল। এছাড়া চীন এবং ধনী আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা হোক বা আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসার বিষয়ে সমর্থন করা হোক, সামরিক বাহিনী যা চেয়েছিলেন তা খুশি মনেই করেছিলেন ইমরান খান। তার বিরুদ্ধে এমনটাই শোনা যায়।
Advertisement
ধারণা করা হয়, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এমন কাউকে ক্ষমতায় রাখতে চেয়েছিল যে তাদের ইশারায় চলবে। প্রথম দিকে ইমরান খান হয়তো তেমনটাই ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে হয়তো ইমরানের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। তিনি তার নিজের গুরুত্ব প্রচেষ্টায় জোর দিয়েছেন।
গত শরৎকালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নতুন একজনকে নিয়োগে দেশটির শীর্ষ জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে বাধা দিয়েছিলেন ইমরান। তিনি লেফটেন্যান্ট-জেনারেল ফয়েজ হামিদকে গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে বহাল রাখার চেষ্টা করেন। যা নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। যদিও পরে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার মনোনীত ব্যক্তিই নিয়োগ পায়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির কথা জনান ইমরান। এর অংশ হিসেবে বাণিজ্য চুক্তির জন্য রাশিয়ায় সফর করেন তিনি। তার এই সফরের পরই ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। যা নিয়ে পশ্চিমারা ইমরান খানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল।
ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করেও ইমরান খান ও সেনাবাহিনীর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়। দুই পক্ষ থেকেই পাল্টা বক্তব্য আসে। যুদ্ধ ইস্যুতে ইমরান খান যেখানে পশ্চিমাদের সমালোচনা করেন সেখানে সেনাপ্রধান রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন।
Advertisement
নানা কারণে হয়তো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। এছাড়া তিনি দেশের জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার সবগুলোও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে দেশজুড়ে তার জনপ্রিয়তাও কিছুটা কমতে শুরু করে।
ইমরান খানের সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তার সরকার জনসমর্থন হারিয়েছে দেশের অভ্যন্তরে চড়া মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়তে থাকার কারণে। পাকিস্তানে ব্যাপক হারে রুপির দরপতন হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক দ্রুত বেড়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ শতাংশ। সেখানে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৩ শতাংশ।
পাকিস্তানে গ্যাস সংকটও অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক বছর ধরে স্থানীয় ভাবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির উৎপাদন কমেছে। বৈশ্বিক ঘাটতির কারণে সম্প্রতি সেখানে এলএনজির দাম এমন পর্যায়ে গেছে যে, তা পাকিস্তানের পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। সাধারণ মানুষও গ্যাস নিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে।
কিছু রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল ইমরান খান সরকারের বিরুদ্ধে। তার মন্ত্রিসভাকে অনেক বিশ্লেষকই দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। অনেকের ধারণা, সেনাবাহিনীর মদতে তিনি ক্ষমতায় আসায় মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রেও তাকে সমঝোতা করতে হয়েছে।
বৈদেশিক নীতিতেও ইমরান খান সরকারের ভুল ছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। শেষের দিকে কখনও সৌদি আরব নারাজ হয়েছে আবার কখনও চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও গত তিন বছরে ইমরান খান সরকারের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে ইমরান খান সরকারের বিরুদ্ধে। করাচির সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজমের পরিচালক আমবার শাসমি বলেন, আগের যে কোনো সরকারের চেয়ে গণমাধ্যমের প্রতি বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে ইমরান খান সরকার। গণমাধ্যমে বিরোধীদের বক্তব্য প্রচার বন্ধ, সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের খবর তার সরকারের সময় সামনে এসেছে।
ইমরান খানের পতনের পেছনে তার দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও বড় ভূমিকা পালন করেছে। তার দলের নেতারা, যারা তাকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় এনেছেন তারাই পরে বিরোধী দলের প্রতি সমর্থন জানাতে শুরু করেন। গত ১০ এপ্রিল ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় এবং সাড়ে তিন বছরেই তার সরকারের ইতি ঘটে। বহু নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারান ইমরান খান। অপরদিকে ১১ এপ্রিল নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ।
ইমরান খানের ক্ষমতা হারানোর ঘটনায় বেশ খুশিই হয়েছেন দেশটির শীর্ষ জেনারেলরা। কারণে এতদিনে তাদের মনমানসিকতায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। ইমরান খানের পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব থেকে পাকিস্তানকে দূরে রাখতে এবং চীনের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কমাতে চাইছিলেন। নানা ক্ষেত্রেই হয়তো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইমরানের খানের নীতি-নৈতিকতায় বৈষম্য চলে এসেছিল।
ইমরান খানকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে আপাতত দৃষ্টিতে সেনাবাহিনীর সফলতা মনে হলেও সেটা আসলে একটি পরাজয়ই বলা যায়। তারা যে শাসন ব্যবস্থা তৈরি করেছে তা স্বাভাবিকভাবেই অস্থির। তবে পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়া যতটা সহজ ক্ষমতা ধরে রাখা ততটাই কঠিন। অবশ্য শুধু ইমরান খানই নয়, এখন পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রীই এতে সফল হননি।
তবে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা একেবারেই কমে যায়নি। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বহু মানুষ এর বিপক্ষে রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করেছে এবং ইমরানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তবে ইমরান সরকারের পতনে আবারও ভয়াবহ সংকটে পড়ল পাকিস্তান। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটির বিভিন্ন সমস্যা আরও বাড়াবে বলেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
২০২৩ সালে দেশটির পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানে নতুন নির্বাচন আসলে কতটা গুরুত্ব বহন করে? কয়েক দশক ধরে দেশের চিত্রতো একই রকম। পাকিস্তানকে পূর্ণ মেয়াদে শাসন করার সুযোগ কী সামনের দিনেও আর ঘটবে বা কোনো প্রধানমন্ত্রী কী পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন? সেই আশা খুবই ক্ষীণ কারণ দেশটা পাকিস্তান। সেখানে এমনটা গত ৭৫ বছরে দেখা যায়নি।
দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরেই পর্দার আড়াল থেকে রাজনীতি পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী। আর কতদিন এমনটা ঘটবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসামরিক সরকার চাইলেও দেশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকে না। কিন্তু অন্তত একবারের জন্য হলেও সামরিক বাহিনীর উচিত দেশের পুরো নিয়ন্ত্রণ বেসামরিক সরকারের হাতেই তুলে দেওয়া এবং রাজনীতিতে তাদের নাক না গলানো।
সামরিক জেনারেলরা হয়তো মনে করেন যে, তারা শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাতে হস্তক্ষেপ করে থাকেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশের রাজনীতি তাদের হাতেই নষ্ট হচ্ছে। পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক গতিতে তখনই ফিরতে পারবে যখন রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতে পারবেন এবং সেনাবাহিনী তাদের নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবেন। যার যার কাজ তারই করা উচিত এটা যতদিন দেশটির সামরিক বাহিনী না বুঝতে ততদিন পাকিস্তানে কোনো পরিবর্তন আসবে না। প্রতিবেশী দেশগুলো যখন নানা দিক থেকে উন্নতি করছে তখন সেনাবাহিনীর এসব খামখেয়ালিপনায় পাকিস্তান দিনের পর দিন শুধু পিছিয়েই পড়ছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
টিটিএন/এএসএম