ধর্ম

যে ১২ কারণে রোজার মহিমা ক্ষুণ্ন হয়

মহিমান্বিত মাস রমজান। এতে যেমন সংযমের ব্যাপার রয়েছে, তেমনি আছে অনেক সতর্কতা ও বর্জনীয় দিক। সেসব পালন না করলে সারাদিন উপবাস থাকলেও রোজার সঠিক মহিমা পূর্ণ হবে না। এমনই কয়েকটি বর্জনীয় দিক নিয়ে লিখেছেন উমামা তাসনিম

Advertisement

হারাম খাওয়ারমজানের সেহরি ও ইফতারে ব্যবহৃত জিনিসপত্রসহ যাবতীয় খরচ নিখুঁত, পবিত্র ও সৎ অর্থের মাধ্যমে উপার্জিত হতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমাদের আমি যেসব পবিত্র রিজিক দিয়েছি, তা থেকে আহার করো। পাশাপাশি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করো, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করে থাকো। ’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযোগী। ’ (তিরমিজি : ৬১৪)।

টিভি দেখে সময় পারযেসব কাজ রমজানের বাইরে পাপ ও গোনাহ হিসেবে গণ্য, সেসব কাজ রমজানে করা আরও বেশি মারাত্মক পাপ ও গোনাহ। টিভি দেখা, গান শোনা, মেয়েদের ছবি দেখা প্রতিটি গোনাহের কাজ। তাই এসব থেকে প্রত্যেক মোমিন-মুসলমানের বিরত থাকা উচিত। রমজানের দিনে বা রাতে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া আরও অধিক গোনাহের কাজ। এগুলোর কারণে রোজার অন্তর্নিহিত শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। যদিও এসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় না, তবে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ সওম পালন করলে সে যেন পাপাচারে লিপ্ত না হয় এবং মূর্খের মতো আচরণ না করে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৩৬৩)।

মিথ্যা কথা বলারমজানে অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকা যেমন জরুরি, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকাও জরুরি। কারণ, রোজা থেকে মিথ্যা কথা বলা রোজাকে ধ্বংস করে দেবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার করে না, আল্লাহর কাছে তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি : ৬০৫৭)।

Advertisement

গিবত ও পরনিন্দাগিবত (পরনিন্দা) ও অপরের দোষচর্চা নিকৃষ্টতম অভ্যাস। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস। ’ (সুরা হুমাজাহ : ১)। রোজা রেখে অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানোও অনুচিত। পবিত্র কোরআনে মানুষের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা একে অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ কোরো না এবং পরস্পর গিবত কোরো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা ঘৃণাই করে থাকো। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।

রাত জেগে গল্প করাআমরা অনেকেই রমজানের রাতে না ঘুমিয়ে গল্প করে রাত কাটাতে পছন্দ করি। কেউ আবার শপিং করে, রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিয়ে, অনলাইনে সেহরি পর্যন্ত সময় পার করি। যা একেবারেই ঠিক নয়। রমজান মাস ইবাদতের মাস। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ মাসে যথাসাধ্য ইবাদত করা জরুরি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রোজা ও কোরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে। ’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৬২৬)।

সেলফি ও আত্মপ্রদর্শনঅনেকে রমজান মাসে সেহরি ও ইফতারের সময় সেলফি ও আত্মপ্রদর্শন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অথচ সেহরি ও ইফতারের পূর্বমুহূর্ত দোয়া কবুলের সময়। ইফতারের সময়টি রোজাদারের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত। এ দুটি সময় বান্দা তার মহান মনিবের নৈকট্যের আশায় বসে থাকে। এ দুটি সময় আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দার গোনাহ মাফ করে দেন। তাকে পুরস্কৃত করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ ঘোষণা করেন, রোজা আমার জন্যই; আর আমিই এর প্রতিদান দেব।’ (বোখারি : ৭৪৯২)।

স্মার্টফোন আসক্তিস্মার্টফোন মানুষের দৈনন্দিন কাজকে সহজ করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার অপকারিতাও কম নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এর সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি হয়। অনেকেই স্মার্টফোনের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করে। যা তার কাজকর্ম, ঘুম, ইবাদত সবকিছুতেই বিরূপ প্রভাব ফেলে। আর যদি রমজানে স্মার্টফোনে রাতভর হারাম ভিডিও দেখা হয়, তাহলে তার পরিণাম হবে আরও ভয়াবহ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘চোখের জিনা হলো, হারাম দৃষ্টিপাত। কর্ণদ্বয়ের জিনা হলো, গায়রে মাহরামের যৌন উদ্দীপক কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শোনা। জিহ্বার জিনা হলো, গায়রে মাহরামের সঙ্গে সুড়সুড়িমূলক কথোপকথন। হাতের জিনা হলো, গায়রে মাহরামকে ধরা বা স্পর্শকরণ। পায়ের জিনা হলো, খারাপ উদ্দেশ্যে চলা। অন্তর চায় ও কামনা করে; আর লজ্জাস্থান তাকে বাস্তবে রূপ দেয়।’ (মুসলিম : ২৬৫৭)।

Advertisement

অহেতুক কথাবার্তা বলারমজানে রোজা রেখে অশালীন কথা বলা, গালি দেওয়া নিষেধ। তাই রোজা রেখে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে, তখন সে যেন অশালীন কথাবার্তা না বলে ও হৈচৈ না করে।’ (বোখারি : ১৯০৪)।

অপচয় ও অপব্যয়পবিত্র মাহে রমজানে একদম ব্যয়কুণ্ঠতা অবলম্বন করা যেমন উচিত নয়, তেমনি অপব্যয় করাও উচিত নয়। রমজানে ব্যয় ও খাবারেও সংযম পালন করা জরুরি। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করা চাই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা অপব্যয়ও করে না, আবার কৃপণতাও করে না। তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।’ (সুরা ফোরকান : ৬৭)।

অশালীনভাবে চলাফেরা করারমজান ও রমজানের বাইরে মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য পর্দার বিধানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য। তবে রমজানে এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কারণে-অকারণে ঘরের বাইরে যেতে হয়, সে ক্ষেত্রে চোখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করা জরুরি। অযথা মার্কেটে ও শপিং মলে সময় ব্যয় করা অনুচিত। নারী-পুরুষ উভয়ের পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায় হলো, ইসলামের পর্দা বা হিজাব বিধান। এ বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই হৃদয়-মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। পর্দার এ সুফল স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’ (সুরা আহজাব : ৫৩)।

রোজা রেখে নামাজ না পড়াঅনেকে এমন রয়েছেন, আল্লাহ তাদের রোজা রাখার তৌফিক দিয়েছেন; কিন্তু তারা নামাজের ব্যাপারে উদাসীন। অথচ নামাজও আল্লাহর ফরজ বিধান এবং ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ পড়া জরুরি। আর রমজান মাসে ফরজ নামাজের বাইরে তারাবি ও তাহাজ্জুদ নামাজের বিধান দেওয়া হয়েছে। সুতরাং রমজান মাসে নামাজ না পড়া রমজানের মহিমা ক্ষুণ্ন করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মুসলমানদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফরজ।’ (সুরা নিসা : ১০৩)।

মাতাপিতার সঙ্গে অসদাচরণশুধু রমজান নয়, কখনও কোনো বিষয়ে মাতাপিতার সঙ্গে অসদাচরণ করা যাবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত কোরো না এবং মাতাপিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কোনো একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের উফ শব্দটিও বোলো না এবং ধমক দিয়ো না। তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩)।

মুনশি/এসইউ/এমএস