বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং ডি-নেট যৌথভাবে একটি গবেষণা করে দেখিয়েছে, ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হওয়ার কারণে নারীর প্রতি পুরুষের অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহিংসতা বাড়ছে। গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ৮৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন অনলাইনে নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এসব কনটেন্ট তৈরিতে নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অংশগ্রহণকারী ৮২ শতাংশ নারী ও পুরুষ মনে করছে সমাজে মেয়েদের প্রতি সহিংস ও নির্যাতনমূলক আচরণ বেড়েছে।
Advertisement
নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির নানা ধরন এবং কারণ আছে। পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা তার মধ্যে একটি বিষয়। নারিকে যৌন পুতুল হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ছে ইন্টারনেটে অবাধে পর্নোগ্রাফি দেখার সুযোগ থাকায়। একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহিংসতার প্রবণতা ইন্টারনেট বিস্তারের আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু এখন যে তা আরও প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে।
আসলে অর্থনৈতিকভাবে আমাদের অনেক উন্নয়ন হলেও সামাজিক চিন্তাচেতনায় অগ্রগতি হয়নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, সম্প্রতি উদযাপিত পহেলা বৈশাখের নানা অনুষ্ঠানে নারীর অংশ গ্রহণ, তাদের পোশাক নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীল মন্তব্যের ছড়াছড়ি দেখে। যারা এসব কথা বলছে তাদের প্রোফাইল ঘেটে দেখা যায় ধর্ম চর্চার ফিরিস্তি তাদের টাইমলাইন জুড়ে। ইউটিউবে কিছু ওয়াজির সারা বছরের অশ্লীল বয়ান তো আছেই। নারীর পক্ষে অনেক আইন থাকলেও তার প্রয়োগ দেখতে পাইনা আমরা। আইন বেশি বেশি উপেক্ষিত মেয়েদের উপর সংঘটিত পুরুষদের যৌন অপরাধ ও সহিংসতার ঘটনায়।
ধর্ষণকাণ্ডের প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনে এখন একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে রাজনীতি ও ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই ধর্ষককে ধিক্কার জানাতেন এবং তার কঠোর শাস্তির দাবি করতেন। কিন্তু আজকাল রাজনীতি ও ধর্ম বিষয়ে বয়ানকারীরা ধর্ষণের ঘটনা ও ধর্ষককে আড়াল করার চেষ্টা করছেন এবং সেটা ইন্টারনেটে তথা ফেসবুকে হচ্ছে বেশি। একটা বড় গোষ্ঠী প্রথমেই বলার চেষ্টা করবে পর্দার কথা। এরপর শুরু করে নারীর চরিত্রের বর্ণনা দেয়া এবং সব ঘটনার জন্য নারীই দায়ী– এমন একটা রেটোরিক দাঁড় করাতে। ধর্ষকদের রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সব ক্ষেত্রে। আবার ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার ভিন্ন ধর্মের মানুষ হলে সেটিকে সাম্প্রদায়িক আকার দেওয়ার চেষ্টাও আছে।
Advertisement
এই আধুনিক যুগে এসেও নির্যাতিতার পোশাক-পরিচ্ছদ ও চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকেই দোষারোপ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ‘রাতে একা বেরোনো ঠিক হয়নি’ কিংবা আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল ইত্যাদি। এতে শ্লীলতাহানি অথবা ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীরা পরোক্ষে প্রশ্রয় পায়। তাদের যতটা তিরস্কৃত, ধিক্কৃত ও দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া দরকার ততটা হয় না। এ জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত ধর্ষণকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশে নারী, নাবালিকা ও শিশুদের ওপর যৌন আক্রমণ বাড়ছে একটা সংগঠিত আকারে।
মেয়েরাই মন্দ– এমন একটা ধারণা থেকে প্রজন্মকে বের করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন প্রতিটি পরিবারে ছেলে সন্তানকে মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া। নারীকে মানুষের দৃষ্টিতে দেখার চোখ ও মনন তৈরি করার কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও। পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও নারীর পোশাক নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করেন, টিপ পরা নিয়ে নাজেহাল করতেও তাদের বাধে না। নারী কী পোশাক পরবেন, কী কাজ করবেন রাষ্ট্র বা পুরুষ তা নির্ধারণ করে দিতে পারে না। দেশে সংস্কৃতি চর্চার পরিসর বাড়াতে হবে।
এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে আইনের প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। দেশে নারী ও কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নেই বলে একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এটি কোনভাবেই আমাদের উন্নয়ন স্পৃহার সাথে যায় না। এর থেকে মুক্তি পেতে, যৌন সহিংসতা বন্ধ করার জন্য কিছু বাস্তব করা দরকার।
সবচেয়ে আগে বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার অবসান ঘটাতে হবে। যৌন অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত না করলে বিলম্বে প্রদান করা কঠোর শাস্তিও সমাজে কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। ধর্ষণ করে খুন করার অপরাধে, দীর্ঘদিন মামলা চলার পর, অপরাধীর প্রাণদণ্ডের দৃষ্টান্তও আমাদের দেশে রয়েছে। কিন্তু শাস্তি প্রদানে অনেক বিলম্ব হওয়ায় তা অপরাধের প্রবণতা কমাতে পারেনি। কিন্তু ব্যাপারটা হওয়া উচিত, সম্ভাব্য শাস্তির কথা স্মরণ করে কেউ যেন যৌন আক্রমণ করতেই সাহস না করে। ইন্টারনেটে কারা কোন উদ্দেশ্যে নারীদের নিয়ে অবমাননাকর কথা লিখছে বা বলছে তাদের নজরদারিতে এনে ব্যবস্থা নেয়ার সিস্টেমও তৈরি করতে হবে।
Advertisement
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং ডি-নেটের গবেষণায় দেখা যায়- পর্নোগ্রাফি দেখার কারণে সমাজে মেয়েদের প্রতি সহিংসতা বেড়েছে বলে মনে করছে মানুষ। জরিপে অংশ নেয়ারা উত্তর দিয়েছেন যে, মেয়েদের ভালো হতে উৎসাহী করা ও মন্দ বিষয়ে বাধা দেওয়া ও তাদের নিরাপদে রাখা পুরুষের দায়িত্ব। অবাক লাগে যে, পুরুষ দায়িত্ব নিতে চায় যারা কিনা নিজেরাই অপকর্মেরর সাথে জড়িত!
নারীকে তার মত করে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়াটাই পরিস্থিতি বদলাতে পারে। অপরাধ, বিচার ও শাস্তি কার্যকর, এই পুরো ব্যাপারটা স্বল্প সময় কালের মধ্যে সম্পন্ন হলেই একটা ইতিবাচক প্রভাব আসবে। নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত আইন চালু থাকলেও তার প্রয়োগ কতখানি হচ্ছে, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস