দেশের বহুল প্রত্যাশিত চার মেগা প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও কর্ণফুলী টানেল। আগামী জুনে উদ্বোধন হওয়ার কথা স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন হবে আগামী অক্টোবরে। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে চালু হবে ঢাকাবাসীর কাঙ্ক্ষিত মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যেই জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে চার মেগা প্রকল্প। চার মেগা প্রকল্পের মধ্যে দুটি প্রকল্পে নতুন এডিপিতে বরাদ্দের চাপ কমছে, তবে বাড়ছে অন্য দুটিতে।
Advertisement
চলতি বছরেই জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে পদ্মা বহুমুখী সেতু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল। এজন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পদ্মাসেতু প্রকল্পে বরাদ্দের চাপ কমছে, তবে বাড়ছে বঙ্গবন্ধু বা কর্ণফুলী টানেলে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে পদ্মা সেতুতে ৪২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ কমছে। তবে বঙ্গবন্ধু টানেলের জন্য একই সময়ে ৬৬৬ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছর শেষ হবে জুন মাসে। ফলে চলতি অর্থবছরের জন্য হাতে সময় আছে মাত্র আড়াই মাস। এ কারণে পরিকল্পনা কমিশন আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) কাজ শুরু করেছে। নতুন এডিপিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও গৃহায়ণ খাতে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা কমিশনে বরাদ্দ দাবি করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কৃষি, শিল্প ও সমন্বয় উইং) মো. ছায়েদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, নতুন এডিপির কাজ শুরু করেছি। মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো প্রকল্পের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বরাদ্দের প্রস্তাব করছে। আমরা প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করে এডিপিতে অনুমোদন দেবো।
Advertisement
প্রকল্পের শেষ সময়ে বরাদ্দের চাপ কমে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্প যদি চলমান থাকে তবে বরাদ্দ থাকবে। প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হলে বরাদ্দ থাকে না। তবে প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখে উদ্বোধন করা যায়। সেই হিসেবে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেও বরাদ্দ থাকবে। কারণ সেতু বিভাগের আরও অন্য কাজ থাকতে পারে। একই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্পের টাকা অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর হতে পারে। তবে প্রকল্প সমাপ্তের শেষ সময়ে এডিপিতে চাপ কমে।
৪২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ কমছে পদ্মা সেতুতে: দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব কমাতে উদ্বোধনের অপেক্ষায় পদ্মা বহুমুখী সেতু। এই সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে, নিচতলা দিয়ে যাবে ট্রেন। মূল সেতুর (শুধু নদীর অংশ) দৈর্ঘ্য ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার। মূল সেতু থেকে মাটি পর্যন্ত সংযোগ ঘটাতে তৈরি হয়েছে উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট)। দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার।
পদ্মা নদীর ওপর দীর্ঘ এ স্বপ্নের সেতু নির্মাণ প্রকল্পে এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল দুই হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে নতুন এডিপি অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে দুই হাজার ২০২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ফলে বরাদ্দের চাপ কমছে ৪২৭ কোটি টাকা।
পদ্মাসেতু প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের এটাই শেষ বরাদ্দ।
Advertisement
পদ্মা সেতু প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিপিতে এটাই শেষ বরাদ্দ। সেতুর কাজও শেষ, বরাদ্দও শেষ।
বঙ্গবন্ধু টানেল: কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের টিউব স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৯৯৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল এক হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। ফলে নতুন এডিপিতে বরাদ্দের চাপ বাড়ছে ৬৬৬ কোটি টাকা।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের টিউব স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে
সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। টানেলের মোট দৈর্ঘ্য তিন দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। নির্মাণ সম্পন্ন হলে এটিই হবে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পটি চলতি বছরই উদ্বোধন করা হবে।
মেট্রোরেলে বরাদ্দ কমছে: রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইনের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে বেশিরভাগ উড়ালপথ নির্মিত হয়েছে। এ পথে মোট ১৬টি স্টেশন থাকবে। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) এই ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি থাকবে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার।
গত ১২ ডিসেম্বর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও রুটে মেট্রোরেলের পারফরম্যান্স পরীক্ষা শুরু হয়
প্রকল্প সূত্র বলছে, মেট্রোরেল চালু হলে মাত্র ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিলে পৌঁছানো যাবে। চলতি অর্থবছরে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে (মেট্রোরেল) চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সবশেষ এডিপিতে মেট্রোরেলে বরাদ্দ ছিল চার হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের নতুন এডিপিতে দুই হাজার ৮৮২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হচ্ছে। ফলে নতুন করে বরাদ্দ কমছে এক হাজার ১১৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত উত্তরা তৃতীয় পর্ব হতে আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি ৯১ দশমিক ৪১ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের অগ্রগতি ৭৭ দশমিক ২২ শতাংশ।
বরাদ্দ বাড়ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে: ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে নতুন এডিপিতে ২১ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। নগরীর যানজট নিরসনে জাদুর কাঠি হিসেবে কাজ করবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়াল সড়ক)। দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে প্রকল্পের কাজ। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল লেনের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সাড়ে ১১ কিলোমিটার। এ অংশটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
কাওলা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত অংশ আগামী ডিসেম্বরে খুলে দেওয়া হতে পারে
প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যাবে যাত্রাবাড়ী। চলতি অর্থবছর এ প্রকল্পের আওতায় মোট এডিপি বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪০০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। তবে নতুন এডিপিতে ৪২১ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। ফলে নতুন এডিপিতে প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ছে প্রায় ২১ কোটি টাকা।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার জাগো নিউজকে বলেন, চলতি বছরই এক্সপ্রেসওয়ের সাড়ে ১১ কিলোমিটার খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। নতুন এডিপিতে ৪২১ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। প্রকল্পের কাজ যতই শেষ হতে থাকবে ততই বরাদ্দ কমবে। কাজ না থাকলে তো বরাদ্দ থাকবে না।
এমওএস/কেএসআর/এসএইচএস/জিকেএস