করোনার প্রভাব কাটিয়ে এবারের ঈদ সামনে রেখে আবার কর্মমুখর হয়ে উঠেছে সিরাজগঞ্জের তাঁত পল্লীগুলো। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁত কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। জেলার বিভিন্ন তাঁত পল্লীতে তৈরি হচ্ছে আধুনিক মানের জামদানি, সুতি জামদানি, সুতি কাতান, বেনারসি ও বিভিন্ন ধরনের লুঙ্গি।
Advertisement
এ অঞ্চলের তৈরি কাপড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন রপ্তানি হচ্ছে ভারত, ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। জেলার বেলকুচি, শাহজাদপুর ও এনায়েতপুরের খুকনী এলাকার তৈরি বেনারসি এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁত কারখানার মালিকরা।
কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহলে সরব হয়ে উঠেছে তাঁতপল্লী। সেখানে এখন দিনরাত তাঁতের খট খট ঝুম ঝুম শব্দ। এই শব্দই বার্তা দিচ্ছে করোনার কারণে যে ক্ষতি হয়েছিল তা কাটিয়ে ওঠার।
বাজারে কাপড়ের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও অনেকটা বেড়েছে। এই মূল্যবদ্ধির কারণ হিসেবে করোনার প্রভাব, রঙ-সুতাসহ তাঁত উপকরণের মূল্য বদ্ধিকেই দায়ী করছেন তাঁত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
Advertisement
সরেজমিনে তাঁতপ্রধান এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, তাঁত পল্লীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারখানা মালিক ও শ্রমিকরা। বসে নেই নারীরাও। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নলী ভরা, সুতা পারি করা, মাড় দেওয়াসহ কাপড় বুননের কাজে সহযোগিতা করছেন নারী শ্রমিকরা।
সিরাজগঞ্জ তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ এমএ বাকী জাগো নিউজকে বলেন, কারোনার কারণে আমাদের অনেক তাঁতী লোকসানে পড়ে ব্যবসা ছেড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে সুতা, রং ও তাঁত উপকরণের অব্যাহত মূল্যবদ্ধির ফলে আর ভারতীয় শাড়ির কারণে তাঁত শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। অনেক তাঁতিই পুঁজি সঙ্কটে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় লাক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। তবে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় এই তাঁতশিল্পে আধুনিক মানের ডিজাইন আসায় আবার প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে। এখন আর তাঁতিরা এ শিল্পকে অলাভজনক পেশা হিসেবে দেখছে না।
বেলকুচির সোহাগপুর হাটের পাইকারি কাপড় বিক্রেতা বাবু সরকার জানান, করোনার প্রভাব অনেকটা কেটে যাওয়ায় বড় বড় কাপড়ের কোম্পানিগুলো সোহাগপুর, এনায়েতপুর ও শাহজাদপুর হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের তাঁতশিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। তবে সুতার দাম যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তার তুলনায় কাপড়ের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
জ্যোতি শাড়ির মালিক ও বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম অ্যাসোসিয়েশনের উপজেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ্রী বৈদ্যনাথ রায় বলেন, ঈদ সামনে রেখে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলের সিরিয়ালের নাম অনুযায়ী কাপড়ের নাম রাখা হচ্ছে। এ বছর মন ফাগুন, অনুরাগের ছায়া, কনক, লালপরী, স্বর্ণলতা ইত্যাদি নামে নতুন শাড়ি বাজারে এনেছেন বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুরের তাঁতিরা।
Advertisement
জেলার জামান টেক্সটাইলের আলহাজ অপু জানান, বাজারে কাপড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সঙ্কটের কারণে তারা কাপড় উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না।
তিনি আরো জানান, দফায় দফায় সুতা, রং ও অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ার কারণেই কাপড়ের দাম বেড়েছে।
সুতা ব্যবসায়ী হাজী হাসেম বলেন, তুলার সঙ্কটের কারণে বাজারে সুতার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া সুতার দাম নির্ধারণ করে দেন মিল মালিকেরা। আমাদের বেশি দাম দিয়ে মিল থেকে সুতা কিনতে হয়। সে কারণে স্থানীয় বাজারে সুতার দাম বৃদ্ধি পায়।
তাঁত শ্রমিক রজব, শাজাহান ও হোসেন আলী বলেন, আমরা যে পরিমাণ পরিশ্রম করে তাঁতের কাপড় বুনাই সে অনুযায়ী মজুরি পাচ্ছি না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে ৭ দিনে ১৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকা মজুরি পাই। বাজারে কাপড়ের দাম বাড়লেও আমাদের মজুরি বাড়েনি। আগের তুলনায় এখন কাপড় তৈরিতে সময় ও পরিশ্রম বেশি হলেও মালিকরা নামমাত্র মজুরি বাড়িয়েছেন। ঈদ সামনে রেখে বাড়তি রোজগারের আশায় রাতদিন কাজ করছি।
জেলা তাঁতি লীগের সভাপতি হাজী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সুতার দাম কিছুতেই কমছে না। দফায় দফায় কারণ ছাড়াই মিল মালিকরা দাম বৃদ্ধি করছেন। শ্রমিকদের মজুরিসহ তাঁত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিতে কাপড় উৎপাদন খচর বেড়ে গেছে। ফলে তাঁতিদের বেশি দামে কাপড় বিক্রি করতে হয়।
এফএ/জেআইএম