মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে জিওলের হাওরে ৮ একর জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন ইটনা নয়াহাটি গ্রামের মো. আবদুর রব (৪৫)। জমির ফসল সবুজ হওয়ার পর থেকেই তার মনে আনন্দের ঢেউ বইছিল। আর ১৫ দিন পরই জমির ধান কাটা শুরু হতো। কিন্তু এরই মধ্যে পাহাড়ি ঢলে ভেসে যায় তার সব আনন্দ। পানিতে তলিয়ে গেছে তার সব জমি। এখন তিনি অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করছেন।
Advertisement
শনিবার জিওলের খালে নৌকায় বসে কথা হয় মো. আব্দুর রবের সঙ্গে। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘বাবার কোনো জমিজমা নেই। নিজের সম্বল বলতে এক চিলতে বসতবাড়ি। আমার অহন কী অইবো। ক্যামনে ঋণ পরিশোধ করবাম। স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণ চলবে ক্যামনে?’
কিশোরগঞ্জের হাওরে থেকে নেমে আসা পানিতে জমির ফসল ডুবে যাওয়ায় এলাকার শত শত কৃষকের অবস্থা এখন আবদুর রবের মতোই।
জিওলের হাওরে ধনু নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে এখন থৈ থৈ পানি। উজানের ঢলে নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। বিভিন্ন হাওরে প্লাবিত হয়েছে কাঁচা-পাকা ধানের জমি। ডুবে যাওয়া জমি থেকে নৌকা নিয়ে কাঁচা-পাকা ধান কাটার চেষ্টা করছেন কৃষক।
Advertisement
ইটনার জিওলসহ বেশকিছু বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। ফসল রক্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছে এলাকাবাসী।
কথা হয় ইটনা সদর উপজেলার পূর্বগ্রাম এলাকার কৃষক পিপলু মিয়া, মো. হাবিব মিয়া ও আব্দুল কাদিরের সঙ্গে।
তারা জানান, জিওলের হাওরের বেশিরভাগ কৃষকই প্রান্তিক চাষি। ধার-দেনা করে তারা ধানের আবাদ করেছিলেন। এখন তাদের চিন্তার অন্ত নেই। ফসল ডুবে গেলেও তাগাদা শুনতে হচ্ছে এনজিওর ঋণের কিস্তি পরিশোধের।
ভারতের আসামের চেরাপুঞ্জিতে অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় গত সপ্তাহে পাহাড়ি ঢলে হঠাৎ করেই নদীর পানি বাড়তে থাকে। প্রবল বেগে পানি ঢুকতে থাকে কিশোরগঞ্জের ইটনার ধনু নদীর তীরবর্তী নিচু জমিতে।
Advertisement
এদিকে ইটনার জিওলের বাঁধের পাশে নতুন করে আরও একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কৃষকরা বলছেন, বাঁধগুলো রক্ষা করা না গেলে পানিতে তলিয়ে যাবে পুরো হাওর।
কৃষি বিভাগের হিসাবে, গত এক সপ্তাহে ইটনা ও নিকলীর নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের প্রায় ৩শ হেক্টর ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় ৮০ ভাগ ধান পাকলেই কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ।
তবে অবশিষ্ট ধান রক্ষা হবে কিনা এ নিয়েও রয়েছে শংকা। ভারতের আসামে আবারও বৃষ্টির আভাস রয়েছে। আবারও বাড়তে পারে কিশোরগঞ্জের ধনু, ঘোড়াউড়া, বাওলা ও কালনি-কুশিয়ারার পানি। প্লাবিত হতে পারে ফসলের মাঠ।
বছরের একটি মাত্র ফসল দিয়ে চলে হাওরের মানুষের সারা বছরের জীবন-যাপন। ভালোয় ভালোয় ফসল ঘরে না উঠলে তাদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। আগাম বন্যার হাত থেকে ফসল বাঁচাতে জেলার ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে ৭৩টি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে সময় মতো বাঁধগুলো মেরামত না করায় বেশকটি বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে এগুলো মেরামতের কাজ চলছে।
কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান জানান, কয়েকটি বাঁধ সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এগুলো মেরামত করা হয়েছে। বাকিগুলো ঠিক আছে। তিনি কৃষকদের বাঁধ নিয়ে আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ দেন।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল আলম জানান, জেলার ইটনা, নিকলীসহ কয়েকটি এলাকার উজানের পানিতে প্রায় সাড়ে ৩শ হেক্টর জমির ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। তবে আমরা আশা করছি আর পানি না বাড়লে খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি হবে না। তারপরও জমির ধান ৮০ ভাগ পাকলেই দ্রুত কেটে ফেলতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
চলতি মৌসুমে কিশোরগঞ্জে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৮৫ হেক্টর।
এফএ/জিকেএস