ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওজন স্কেলকে ব্যবসার জন্য ‘বিষফোঁড়া’ বলে উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এ স্কেল বন্ধের দাবি জানিয়ে আসলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে উষ্মা প্রকাশ করেন তারা।
Advertisement
রমজানের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে চট্টগ্রাম চেম্বারে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওজন স্কেলের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, দেশের অন্য কোনো মহাসড়কে ওজন স্কেল না থাকলেও এ মহাসড়কে কেন স্কেল বসানো হয়েছে তা বোধগম্য নয়। তবে ওজন স্কেল বসানো কিংবা বন্ধে তার অধিদপ্তরের কোনো হাত নেই বলে জানান মহাপরিচালক।
তিনি জানান, ওজন স্কেলের বিষয়টি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর দেখে। এ ওজন স্কেল নিয়ে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেন।
Advertisement
অপরদিকে কিছু পণ্যের উৎপাদন থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত অনিয়ম হয়েছে বলে উল্লেখ করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, আগামীতে যাতে কোনো অনিয়ম হতে না পারে এবং মনিটরিং করার জন্য একটি অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, বিশ্বর ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য আসে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। সেখানে যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে এর প্রভাব পড়েছে। গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের মূল্য বেড়েছে। সবমিলিয়ে প্রভাব পড়েছে পণ্যের দামে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে রোজা শুরু হয়েছে এপ্রিল মাসে। কিন্তু ব্রাজিল-কানাডায় ছোলা উৎপাদন হচ্ছে সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে। আমাদের দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য ওই দেশের ফলন মৌসুমে বুকিং দিতে হচ্ছে, আগেভাগে করতে হচ্ছে আমদানি। এখন দেশে এনে রমজান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে মজুত করতে হচ্ছে। কিন্তু মজুত নীতিমালা বাস্তবতার আলোকে হালনাগাদ করা হয়নি। তিনি মজুত নীতিমালা সংশোধন করে যুগোপযোগী করার দাবি জানান।
চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আকতার হোসেন বলেন, সরকার আমদানি করা খাদ্যশস্য দ্রুত খালাসে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সে অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসও হচ্ছে। কিন্তু কোনো একটি আমদানির চালান নির্ধারিত সময়ের পর এলে আইপি (আমদানি আদেশ) সংশোধন করে আনতে হয়। তা না হলে সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে না প্রত্যয়নপত্র। আবার আইপি সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করলেও নির্ধারিত সময়ে অনুমোদন মিলছে না। এতে লালফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে আমদানি করা খাদ্যশস্য বন্দরে এসে পৌঁছালেও খালাস করতে ৫-৭ দিন দেরি হয়ে যাচ্ছে। এতে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে আমদানিকারককে। যার প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে।
Advertisement
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি সালেহ আহমদ সুলেমান বলেন, গত বছর করোনার সময় হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ে ধস নামে। করোনা কিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো খুললেও তেমন ব্যবসা হচ্ছে না। এখন রমজানে শুধু ইফতার বিক্রি হচ্ছে। সেখানে সরকারি একাধিক এজেন্সি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বড় অঙ্কের জরিমানা করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ বলেন, বাংলাদেশ ৩৫টি মহাসড়ক রয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বসানো হয়েছে ওজন স্কেল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চট্টগ্রামের ব্যবসা। এক কেজি ভোগ্যপণ্য চট্টগ্রামের বাইরের জেলায় নিতে কেজিতে দুই-তিন টাকা বেশি খরচ পড়ছে। শুধু ওজন স্কেল থাকায় চট্টগ্রামের বাইরের জেলায় ভোগ্যপণ্য পরিবহনের ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। পেলেও বেশি ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। যা পণ্য মূল্যকে প্রভাবিত করছে। তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে ওজন স্কেল প্রত্যাহারের দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ওজন স্কেলের ১৩টন ওজন বাধ্যবাধকতার কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। রমজানের আগে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর সুফল পৌঁছেনি ভোক্তা পর্যায়ে। কারণ ভ্যাট কমানোর পর মধ্য পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা তেলের ডিও কিনে নেওয়ার পর পরের দিন হুট করে তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এতে একেকটি ডিওতে দিতে হয়েছে হাজার হাজার টাকা লোকসান। তিনি রমজানের অন্তত তিনমাস আগে ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি দাবি জানান। পাশাপাশি এ সংক্রান্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকগুলোতে চট্টগ্রাম চেম্বারকে সম্পৃক্ত করার দাবি জানান।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম। এতে বক্তব্য রাখেন- বাণিজ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ মাসুকুর রহমান সিকদার, চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অ্যাডমিন অ্যান্ড ফাইন্যান্স) মো. ইকবাল হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আবু রায়হান দোলন, সিএমপির উপ-কমিশনার মো. আবদুল ওয়ারিশ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ, চট্টগ্রামের চেম্বারের সহ-সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, ব্যবসায়ী নেতা অঞ্জন শেখর দাশ, আমদানিকারক ব্যবসায়ী আবুল বশর চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আকতার হোসেন, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি সালেহ আহমদ সুলেমান, মীর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস ছালাম, চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, রিয়াজ উদ্দিন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ছালামত আলী, খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ, চেম্বারের পরিচালক রাকিবুর রহমান টুটুল, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রামের সাধারণ ইকবার বাহার ছাবেরি, আখতারুজ্জামান সেন্টার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইকবাল বক্তব্য রাখেন।
অন্যান্যদের মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ মাসুকুর রহমান সিকদার, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ, বিভিন্ন মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন, দোকান মালিক সমিতি ও উৎপাদক প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
ইকবাল হোসেন/জেডএইচ/এএসএম