২০০২ সালে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর রেলব্রিজ এলাকায় আশ্রয়ণের একটি ঘর পেয়েছিলেন সরিফউদ্দিন। তখন তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল তিনজন। ছেলে বড় হয়ে বিয়ে করে দুই সন্তানের জনক। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়। এখন এই ঘরে তাদের বসবাস করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
Advertisement
সরিফউদ্দিনের ছেলের বউ জমিলা খাতুন বলেন, আমাদের পরিবারে লোকসংখ্যা বেশি। আমাদের যে ঘরটি দিয়েছে ওই ঘরের টিনগুলো পুরাতন হয়ে ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে। খুব ঝড়-বাতাস হলে তো ভয়ে থাকি। টিনের ঘর, আর সেই ঘরে বৃষ্টি পড়লে কারেন্ট হয়ে যায়। এভাবে কারেন্ট লেগে একজন মারাও গেছে। সরকার যদি আমাদের একটি ঘর দিতো। এখানে তো অনেকগুলো ঘর হচ্ছে। একটা ঘর পেলে অনেক ভালো হতো।
এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, আমাদের পরিবারে পাঁচজন লোক। দুটো মেয়ে আছে, শাশুড়ি আছে। বৃষ্টি আসলে এ ঘরগুলোয় থাকা যায় না। ঝড় এলে তো আরও সমস্যা। কখন যে টিন উড়ে যায় এই চিন্তাই করি। গতবার ভয়ে ভয়ে কাটাইছি। এবার আর থাকা যাবে বলে মনে হয় না।
শুধু জমিলা কিংবা রহিমাই নন, চিরিরবন্দর রেলওয়ে ব্রিজ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ওই এলাকার পদবানু, সখিনাসহ ৩০টি পরিবারের সবারই অবস্থা এখন নাজুক।
Advertisement
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে সরকারি অর্থায়নে আব্দুলপুর ইউনিয়নের চিরিরবন্দর গ্রামে ২ একর ৮৫ শতক খাস জমিতে রেলব্রিজ আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে এখানে ৩০টি পরিবারের জন্য তিনটি ব্যারাক নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ব্যারাকে ১০টি করে ঘর আছে। প্রতিটি ঘরের জন্য ৪ শতাংশ করে জমি দেওয়া হয়। আর ১০টি পরিবারের জন্য যৌথভাবে চারটি শৌচাগার, দুটি করে গোসলখানা ও একটি করে নলকূপ দেওয়া হয়। কিন্তু গত ২৩ বছর ধরে ওই প্রকল্পের কোনো ধরনের সংস্কার না করায় সেসব ঘর থাকার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে।
ঘরের টিনে জং ধরেছে, অনেকগুলো ফুটো হয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। শৌচাগারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে নলকূপও। ভেঙে গেছে ঘরের দরজা-জানালা। ব্যারাকের বেশিরভাগ টিন আলগা হয়ে গেছে। ভেঙে যাওয়া দরজা-জানালা পলিথিন দিয়ে কোনোরকমে ঢেকে রেখেছেন অনেকেই। গত ২৩ বছরে পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা বাড়লেও সুবিধা বাড়েনি, জায়গাও বাড়েনি। বরং পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অসুবিধা, যাতে করে অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা।
দীর্ঘদিন ধরে এমন অসুবিধার মধ্যে থাকা এসব বাড়ির পাশেই চিরিরবন্দর মৌজায় নির্মাণ করা হচ্ছে মুজিববর্ষের উপহারের ঘর আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩ এর অধীনে ৫০টি বাড়ি। সেসব বাড়ি এখানে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থাকা ওই ৩০টি পরিবারকে অগ্রাধিকার ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের।
গত ৪ এপ্রিল এসব বাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু করে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু সেখানে বাধা দেন স্থানীয় ৫নং আব্দুলপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম সরকার। তার দাবি- ওই সম্পত্তির মধ্যে তিন একর তার বাবা ১৯৬৬ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে কবলা দলিল মূলে কেনেন। সেই জমিতে সরকার মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে গৃহহীনদের জন্য বাড়ি নির্মাণ করছে। এই ঘটনায় আদালতে মামলাও করেছেন তিনি।
Advertisement
তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে- যে মামলাটি হয়েছে সেই মামলার রায় সরকারের পক্ষে এসেছে। কারণ ওইখানে মোট খাসজমির পরিমাণ ১৩ একর ৭০ শতক। যার মধ্যে সিরাজুল ভোগ দখল করছেন তিন একর জমি। বাকি জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে সিরাজুল সরকারের কাজে যে বাধা দিচ্ছেন তা সম্পূর্ণ বেআইনি। এই ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আব্দুলপুর ইউনিয়নের তহশিলদার নির্মল কুমার রায় বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় সিরাজুলের ছেলে সেলিম সরকারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এ বিষয়ে শুক্রবার (৮ এপ্রিল) দুপুরে সিরাজুল ইসলাম সরকার দিনাজপুর প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এসময় তিনি বলেন, ১৯৬৬ সালে প্রথম শ্রেণির কবলা দলিল মুলে তিন একর জমি কেনেন আমার বাবা মরহুম মকসেদ আলী সরকার। সেই হিসেবেই আমরা ওই জমি ভোগ-দখল করে আসছি। কিন্তু প্রশাসন আমাদেরকে না জানিয়েই ওই জমিতে ঘর নির্মাণ করছেন, যাতে করে আমরা আর্থিক ক্ষতির আশংকা করছি। আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
আব্দুলপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার নির্মল কুমার রায় বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করতে গিয়ে কিছু লোক তাদের জমি বলে দাবি করছে। কিন্তু এই জমি সম্পূর্ণভাবে সরকারের। যাদের নামে বন্দোবস্ত আছে তাদের জমিতে কোনোকিছু করা হচ্ছে না। তারপরেও আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণ কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এই কাজে যারা বাধা দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছি।
এ বিষয়ে চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, রেলব্রিজ এলাকায় ২০০২ সাল থেকে একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প আছে। কিন্তু সেগুলো বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। তারই সামনে আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩ এর অধীনে ৫০টি বাড়ি নির্মাণ করা হবে। সিরাজুল ইসলাম নামে যে ব্যক্তি ওই জমিতে কাজ করতে বাধা দিচ্ছেন তিনি ১৯৬৬ সালে তিন একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। আমরা সেই জমিতে কাজ করছি না। কিন্তু ওই ব্যক্তি তিন একর ছাড়াও অতিরিক্ত জমি দখল করে আছেন। আবার উনি বন্দোবস্ত গ্রহণ করে অনেক জমিই স্ট্যাম্পের মাধ্যমে হাতবদল করেছেন, যা আইন সমৃদ্ধ না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই আমরা এই কাজটি করার উপর গুরুত্বারোপ করছি। যদি তারা আদালতের কোনো আদেশ নিয়ে আসেন তাহলে আমরা সেই হিসেবেই পদক্ষেপ নেবো।
এমদাদুল হক মিলন/এমআরআর/জেআইএম