দেশে গত ৫০ বছরে দুই হাজার ৫৭২টি নৌ দুর্ঘটনায় সাড়ে ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা আরো বলছে, ৫৬৫টি নৌ দুর্ঘটনার বিপরীতে ৮৬৩টি তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ জমা দিলেও তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। দুর্ঘটনা রোধে নেয়া হয়নি কার্যকর কোন ব্যবস্থাও। সেইসঙ্গে দুর্ঘটনার সঠিক তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন আছে।
Advertisement
একের পর এক নৌ দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবে, তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে অথচ প্রতিকার মিলবে না? এটা তো হতে পারে না। প্রাকৃতিক কারণে দেশের নৌ খাত বিশাল। যেখানে লাখ লাখ নৌযান প্রতিনিয়ত চলাচল করে, সেখানে এই খাতটি নিয়ন্ত্রণে একটি শক্তিশালি সংস্থা প্রয়োজন। একইভাবে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার তদন্ত ও দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে একটি আলাদা সংস্থা গঠনের বিকল্প নেই।
বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের সংস্থা আছে, যাকে বলা হয় ‘মেরিটাইম অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ (এমএআইবি)। এ ধরনের সংস্থা অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। আমাদের উচিত এ ধরনের একটি সংস্থা গঠন করে দুর্ঘটনার তদন্ত এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। অন্যথায় নৌ খাতকে নিরাপদ রাখা চ্যালেঞ্জ হবে।
এখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক নতুন সংস্থা করলেই কি সবকিছু ঠিক ঠাক হয়ে যাবে? প্রতিটি নৌ দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ তুলে ধরে সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যেত তাহলে তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। নতুন সংস্থা যে নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে সে নিশ্চয়তা কোথায়? তেমনি সংস্থার সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে এর নিশ্চয়তা কে দিবে? এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কেন বিশেষ সংস্থার প্রয়োজন তার বিশ্লেষণ জরুরি।
Advertisement
সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষা নদীতে ফের নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কার্গো জাহাজ এমভি রুপসীর ধাক্কায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে মুন্সিগঞ্জগামী ট্রলার এম এল আফসার উদ্দিন ডুবে যায়। জাহাজটি পেছন থেকে ট্রলারটিতে ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত এ দুর্ঘটনায় কত মায়ের বুক খালি হবে কে জানে?
কিন্তু নৌ পথে এটাই তো শেষ দুর্ঘটনা নয়। সামনে আরো ঘটবে। এই দুর্ঘটনাটি যেসব কারণে ঘটেছে হয়ত তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে কিছু বেরিয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত হয়ত প্রতিকারের কোন ব্যবস্থাই নেয়া হবে না। ফলে একই কারণে আবারো মর্মান্তিক নৌ দুর্ঘটনা হয়ত দেখতে হবে। তাই সঠিক তদন্ত ও দুর্ঘটনা রোধে শক্তিশালী নিরপেক্ষ সংস্থা গঠনের যৌক্তিকতা রয়েছে। যে সংস্থাটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নৌ সেক্টরের উন্নয়নে কাজ করে যাবে।
এর আগে ২০২১ সালের চার এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে রাফিত আল হাসান নামে মুন্সীগঞ্জগামী একটি লঞ্চ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় এসকে ৩ কোস্টার জাহাজের ধাক্কায়। এই দুর্ঘটনায় ৩৫ জনের লাশ উদ্ধার হয়। এর আগের বছর বছর ২৯ জুন ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে এমভি ময়ূর-২-এর ধাক্কায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি যাত্রীবাহী ছোট লঞ্চ মর্নিং বার্ড ডুবে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে তখন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রীও বলেছিলেন, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এ ঘটনায় ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল এবং ১ জুন ২০২০ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা করা হয়। কিন্তু সুষ্ঠু বিচার পাওয়া যায়নি।
Advertisement
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বলছে, ৫০ বছরে দেশে নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ২০ হাজার ৫০৮ জন। ওই ৫০ বছরে দেশে অন্তত ২ হাজার ৫৭২টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪১৭ কোটি ২০ লাখ টাকার। দীর্ঘ এ সময়ে দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭২। এর মধ্যে ৯০১টি নৌযান কোনোদিনই উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
নৌ-পরিবহন পরিচালনা ও চলাচলসংক্রান্ত বিষয়ে এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত ও বিচার দ্য ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ (আইএসও ১৯৭৬) অনুযায়ী চলছে। ওই আইনের ৪৭ ধারা অনুযায়ী, সরকার কর্তৃক নৌ-পরিবহন সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য এক বা একাধিক মেরিন কোর্ট (নৌ-আদালত) প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে।
মেরিন কোর্টের বিচারক প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। বর্তমানে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে এ পদে পদায়ন করা হয়। এ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ৭০ নং ধারায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থকাণ্ডের বিধান আছে। আইনের ৫২ (২) ধারা অনুযায়ী মেরিন কোর্টের অতিরিক্ত হিসাবে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ আদেশ দেয়ার ক্ষমতা আছে।
এছাড়া নৌযান চলাচলের অনুমোদন, নদীদূষণ, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, অন্য নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষসহ নৌ-দুর্ঘটনা হতে পারে এ রকম অন্যান্য অপরাধের বিষয়ে পৃথকভাবে শাস্তির বর্ণনা আছে। অভিযুক্ত হিসেবে নৌযানের চালক, সহকারী, প্রকৌশলী, মালিক পক্ষ ও কোম্পানিকে শাস্তি দেয়ার বিধান আছে। ১০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে অর্থদণ্ডের ক্ষেত্রে পরিশোধ ব্যর্থতায় কারাদণ্ড প্রদানের বিধান আছে। শাস্তির মাত্রা খুবই লঘু এবং জরিমানার পরিমাণও অনেক কম। এ আইনে ক্ষতিগ্রস্ত নৌযান ও ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের পৃথক কোনো বিধান নেই।
বর্তমান সরকার সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ প্রণয়ন করে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু বা গুরুতর আহত হওয়ার ক্ষেত্রে দ্য পেনাল কোড ১৮৬০-এর ৩০৪-এ ধারার সঙ্গে সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারা যুক্ত করে শাস্তি কঠোর করে এবং ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে হত্যা হিসেবে গণ্য করার বিধান করে। তদ্রূপ ১৯৭৬ সালের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন আইনে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কঠোর সাজা প্রবর্তন করা উচিত।
বর্তমানে ১৯৭৬ সালের আইনের ৭০ ধারা অনুযায়ী কোনো নৌযানকে বিপজ্জনকভাবে আঘাত, জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া, গুরুতর আহত করা বা কোনো নৌযানের গুরুতর ক্ষতি করা এবং ওই ঘটনার ফলে কোনো মানুষের মৃত্যু, আহত অথবা কোনো সম্পদের ক্ষতি হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদÐ বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে। যা অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা অনেক কম।
২০০৯ সালের কোকো-৪ লঞ্চডুবির ঘটনায় ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ ঢাকার মেরিন কোর্টে রায় হয় এবং নয়জন আসামিকে চার বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। দেশে নৌ-দুর্ঘটনাগুলোর অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো ২০০৩ সালের ৮ জুলাই, ভোলাগামী এমভি নাসরিন-১ লঞ্চ চাঁদপুরে এসে নদীতে ডুবে গেলে ৪০২ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। এই মামলা সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালেও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
প্রতিটি দুর্ঘটনার সঠিক কারিগরি অনুসন্ধান প্রয়োজন। দুর্ঘটনা তদন্তের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে প্রথমত, দুর্ঘটনার তদন্ত যারা করেন, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে, এটাই কারিগরি তদন্তের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তা নির্ধারণ করার চেয়ে কিভাবে ঘটল এর প্রতিকার জরুরি।
কেউ যদি জেনেশুনে ভুল করে, সেটা দুর্ঘটনা নয়, সেটা স্যাবোটাজ (আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড)। দুর্ঘটনা ও স্যাবোটাজকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে দেখতে হবে। দুর্ঘটনা এমন একটি বিষয়, যার কারণ আমরা কেউ জানতাম না। এমনকি যিনি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন, তিনি নিজেও জানতেন না, কীভাবে তাঁর ভুলের কারণে এত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই কারিগরি অনুসন্ধানের মাধ্যমে সেই অজানা বিষয়গুলো বের করে এনে সবাইকে জানানো প্রয়োজন।
দেশে কারিগরি তদন্ত না করে সব ক্ষেত্রেই দায়দায়িত্ব নির্ধারণে তদন্ত করা হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিকে শনাক্ত করে তাঁকে শাস্তি দিলেই ভবিষ্যতের সব দুর্ঘটনা বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা ভাবা হয়। এ ধরনের ধারণা একটি বড় ভুল। দায়দায়িত্ব নির্ধারণের তদন্তে কখনো সঠিক তথ্য বের হয়ে আসে না।
সব মিলিয়ে নৌ দুর্ঘটনার পর কেনর তা ঘটেছে তদন্তে সঠিকভাবে কারণ ওঠে আসে না। কারা ঘটিয়েছে এর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে সময় পার হয়। প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে নৌ দুর্ঘটনার কারিগরী দিক থেকে কারণগুলো ওঠে আসে না। ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না। রাজনৈতিক কারণে তেমনি নৌ আদালতকে কেউ পাত্তা দিতে চায় না। সেখানে মামলা হলে কেউ হাজির হতে পর্যন্ত চান না। এই আদালতের বিচারিক সাজাও তেমন নয়।
উচ্চ আদালত পর্যন্ত নৌ দুর্ঘটনার মামলা গড়ালেও সেখানে আছে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা। সব মিলিয়ে একটি শক্তিশালী সংস্থার মাধ্যমে দুর্ঘটনার তদন্ত ও দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে একটি আলাদা সংস্থা গঠনের বিকল্প নেই। এই সংস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকবে বিচারিক কার্যক্রম। এজন্য অবশ্য নৌ আদালতে শাস্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে। সংস্থাটি নৌ খাতের উন্নয়নে যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে তাহলে অবশ্যই অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশেও নৌ সেক্টরের উন্নয়ন হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস