২০১৮ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে পাঁচটি আসনে লড়ে সব ক’টিতেই জেতেন ইমরান খান, পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীও হন। ওই নির্বাচনে তিনটি আসনে লড়ে সব ক’টিতেই হেরে যান মাওলানা ফজলুর রেহমান। ফলে এই মুহূর্তে তিনি পাকিস্তানি পার্লামেন্টের সদস্য নন। কিন্তু এই কয় বছর ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন পাকিস্তানের এই ঝানু রাজনীতিবিদ, যার সবশেষ ফলাফল- সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ফের অনাস্থা ভোটের মুখে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী। আগামী শনিবারের (৯ এপ্রিল) ওই ভোটাভুটিতে হেরে ইমরানের প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
Advertisement
ফজলুর রেহমান পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)-এর প্রধান। ইমরান খানের বিরুদ্ধে প্রচারণা জোরদারে বৃহস্পতিবার ভোরে ইসলামাবাদে তার বাসভবনে বৈঠক করেছিল সরকারবিরোধী এই জোট। পাকিস্তানি পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পিডিএমের অন্যতম অংশীদার।
এরপরও বৈঠক শেষে জোটের পক্ষ খেকে বিবৃতি পাঠ করেছিলেন ফজলুর রেহমানই। তার বক্তব্য ছিল, পার্লামেন্টে ডেপুটি স্পিকারের ‘অসাংবিধানিক’ রুল একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা ও স্বৈরতন্ত্র আরোপের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। তাই এটি অবিলম্বে বাতিল করা উচিত।
পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ডেপুটি স্পিকারের ওই রুলে ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার তার ওই রুল ‘ভুল’ বলে রায় দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। ফলে অতীতের মতো সামরিক বাহিনী আবারও ক্ষমতা দখল না করলে অবধারিতভাবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে পাকিস্তান।
Advertisement
ইমরানবিরোধী প্রচারণা২০১৯ সাল থেকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে নিরলস প্রচারণা চালিয়ে গেছেন পিডিএম প্রধান। ওই বছরের শেষের দিকে তার সংগঠন জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলাম-ফজলুর (জেইউআই-এফ) ইসলামাবাদ অবরোধ করে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পদত্যাগ ও নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানায়। ফজলুর রেহমানের ওই আন্দোলনে পরে সমর্থন দেয় পিএমএল-এন এবং পিডিপি।
২০১৮ সালে ইমরান খানের ক্ষমতায় যাওয়ার পেছনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে এর এক বছরের মধ্যেই খবর আসতে শুরু করে, সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করছে। ইমরান খানের অনুপস্থিতিতে ২০১৯ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া দেশটির ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সেই গুঞ্জন আরও জোরালো হয়। ওই সময় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের ‘অভ্যুত্থান বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত ১১১ ব্রিগেডের ছুটি বাতিল করেছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৫০ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পরিচালিত সামরিক অভ্যুত্থান, ১৯৭৭ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকারের বিরুদ্ধে জেনারেল জিয়াউল হক এবং ১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরীফ সরকারের বিরুদ্ধে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থানে হাত ছিল ১১১ ব্রিগেডের। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে সামরিক বাহিনীর এই বিশেষ ইউনিট।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন২০১৯ সালে ইমরান খানের পক্ষে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিরোধ কঠিন হয়ে পড়লে ফজলুর রেহমান তার সমর্থকদের নিয়ে ইসলামাবাদের ডি-চক বা ডেমোক্র্যাসি চক চত্বরে বিশাল সমাবেশের ডাক দেন। ‘আজাদি মার্চ’ নামে পরিচিত তার ওই আন্দোলনকে নওয়াজ শরীফ সরকারের বিরুদ্ধে ইমরান খানের ২০১৪ সালের দুর্নীতিবিরোধী ধর্নার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
Advertisement
ইমরান খানের আন্দোলনে নওয়াজ সরকারের পতন না হলেও জনগণের মনে বিশ্বাস জন্মেছিল, ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়া সম্ভব। এর চার বছর পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইমরান। আর ফজলুর রেহমানের আজাদি মার্চ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পিডিএম গঠনের ভিত্তি রচনা করেছিল। ওই সময় পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিচিত নাম নওয়াজ শরীফ, প্রয়াত বেনজির ভুট্টো এবং আসিফ আলী জারদারির অনুপস্থিতিতে পার্লামেন্টে দলের নগণ্য অবস্থান সত্ত্বেও ইমরান খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠেন ফজলুর রহমান।
এ থেকেই স্পষ্ট, ইমরান খান কেন তার চেয়ে বয়সে আট মাসের ছোট, কিন্তু রাজনীতিতে বেশি অভিজ্ঞ ফজলুর রেহমানকে তার সরকারের জন্য হুমকি বলে মেনে নিয়েছিলেন। একসময় তেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় ৬৮ বছর বয়সী এ নেতাকে বহুবার ‘ডিজেল’ নামে উপহাস করেছেন ইমরান খান।
ইমরানের শত্রু১৯৮০ সালে ইমরান খান যখন তার প্রথম টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ খেলার নয় বছর পূরণ করেন, সেই সময় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ফজলুর রেহমান। ১৯৯২ সালে ইমরান যখন পাকিস্তানের হয়ে একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতেন, তখন প্রথমবার পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য হন রেহমান। ১৯৯৬ সালে যখন ইমরান খানের নিজস্ব রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে, ফজলুর রেহমান তখন বেনজির ভুট্টো সরকারের অংশ এবং পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
ইমরান খান সম্প্রতি দাবি করেছেন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া তাকে ফজলুর রেহমানকে আর ‘ডিজেল’ না বলতে অনুরোধ জানিয়েছেন। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, রেহমানের প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থন রয়েছে, যা ২০১৯ সালে আজাদি মার্চের সময় অতটা দেখা যায়নি।
ফজলুর রেহমানের বাবা ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের নতুন সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী হলেও নির্বাচনের মাঠে খুব একটা সাফল্য পাননি। কিন্তু তার ছেলে ঠিকই পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। নাড়িয়ে দিয়েছেন ইমরান খানের গদি। আগামী দিনে তিনি আরও বড় কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন কি না তা সময়ই বলে দেবে।
সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে
কেএএ/এএসএম