ভ্রমণ

বন্ধুদের সঙ্গে চরফ্যাশন ভ্রমণে যা দেখলাম

‘বন্ধু মোরা শৈশবে ফেরা’ ১৯৮৯ ব্যাচের দ্বিতীয় পুনর্মিলনীর প্রস্তুতিপর্ব গত ডিসেম্বর থেকে নেওয়া হচ্ছে। ইচ্ছে ছিল ফেব্রুয়ারিতে করার। গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি করেছিলাম। আমাদের পূর্ব প্রস্তুতি ছিল একই তারিখে করার।

Advertisement

তবে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কারণে মার্চের ২৫ তারিখ করতে হলো। বন্ধুত্বের টানে বরাবরের মতো এবছরও ছুটে যাই প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি বাউফলের মাটিতে। এবার আমাদের গন্তব্য ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম বদ্বীপ ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায়। গত বছর ছিল কালাইয়ার শৌলা পার্কে।

যেহেতু ২৫ মার্চ আমাদের পুনর্মিলনী তাই আগের দিনই বৃহস্পতিবার রওয়ানা দিলাম। সুন্দরবন-১৪ লঞ্চে কেবিন করা ছিল। বিকেল ৫টায় গিয়ে সদরঘাট পৌঁছালাম। বিধিবাম যে লঞ্চ পটুয়াখালী যাওয়ার কথা ছিল সেটা না গিয়ে সুন্দরবন-৯ লঞ্চ ঘাটে। সেখানে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের সাথে চলল বচসা।

বাধ্য হয়ে সুন্দরবন-৯ লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ছাড়ল সন্ধ্যা ৭টায়। ভোর ৪টায় গিয়ে বগা ঘাটে পৌঁছালাম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘাটে নেমে চা-বিস্কুট খেতে খেতে ফজরের আজান।

Advertisement

এরই মধ্যে বন্ধু বাবলুর ফোন। সকাল ৬টায় বাসায় পৌঁছে ব্যাগ রেখেই বন্ধু রাশেদের বাসায় হাজির। এর মধ্যে হিরনের ফোন। সে বগা ফেরিঘাটে ফেরির অপেক্ষায়।

হাজির হলো বন্ধু সাংবাদিক জলিল। বন্ধু রাশেদের ফ্রিজ থেকে মাছ, মুরগি, খাসি ও মসলা নিয়ে বাউফল থানার সামনে মসজিদ ঘাট থেকে ট্রলারে উঠলাম।

ট্রলার ছাড়ে সকাল সাড়ে ৬টায় ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা কেন্দ্র কালাইয়ার উদ্দেশ্যে। কালাইয়া বাজার ঘাট থেকে শ্যামল, খলিল ও সালাউদ্দিনকে নিয়ে গন্তব্যে রওয়ানা দেই। তেঁতুলিয়া নদী হয়ে আমাদের গন্তব্যের দিকে ভ্রমণ শুরু হয়। সকালের নাস্তা আমরা ট্রলারে বসেই সেরে নেই। ট্রলারযোগে যখন রওয়ানা দিলাম তখন যেনো মনে হচ্ছে সেই স্কুল জীবনে ফিরে এসেছি।

ঠিক যেনো সেই আনন্দ, সেই অনুভূতি। এসবের মাঝে গত রাতের ক্লান্তি যেনো টেরই পাচ্ছিলাম না। আমাদের সঙ্গে প্রবাসী তিন বন্ধু সশরীরে থাকতে না পারলেও ভিডিওকলে যুক্ত ছিলেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আবিদুর রহমান মনির, আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু চুন্নু ও মাসুদ।

Advertisement

তাদের আবেগঘন কণ্ঠে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল। জরুরি কাজ থাকায় চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসায়ী বন্ধু সোহরাব না এলেও ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছিল। আরেক বন্ধু মনিরুজ্জামান টিটু শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চাকরির বাধ্যবাধকতায় আসতে পারেনি। ওদের খুব মিস করেছি।

বন্ধুরা বোধ হয় এমনই হয় তাদের মাঝে থাকলে ভুলে থাকা যায় শত ক্লান্তি, শত দুঃখ, শত বেদনা শুধুই যেনো প্রাণে লাগে সুখের দোলা। প্রায় ঘণ্টা চারেক পর আমরা পৌঁছে যাই আমাদের গন্তব্য চরফ্যাশন উপজেলায়।

সেখানে আমরা বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ‘জ্যাকব টাওয়ার’ পরিদর্শন করি। জ্যাকব টাওয়ার বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা দ্বীপের চরফ্যাশন শহরে অবস্থিত পর্যটকদের জন্য নির্মিত একটি ওয়াচ টাওয়ার।

এ টাওয়ার থেকে চারপাশের ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এটি বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু ওয়াচ টাওয়ার।

আইফেল টাওয়ারের আদলে নির্মিত ২০ তলা বিশিষ্ট এই ওয়াচ টাওয়ারে প্রতিটি তলায় ৫০ জন ও পুরো টাওয়ারে ৫০০ জন দর্শনাথী অবস্থান করতে পারেন।

সারাদিন আমরা বেশ উপভোগের সঙ্গে কাটাই। মন যেনো বলছিল এই দিনটি যদি হতো হাজার বছরের সমান। বিকেল ৩টায় বকশিবাজার লঞ্চঘাট থেকে ট্রলারে উঠি। ট্রলার ছাড়ার পর রাশেদ, বাবলু, জাকির ও আমি নদীর স্বচ্ছ পানি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না।

লাফ দিয়ে পড়লাম নদীতে। অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কেটে গোসল শেষ করে ট্রলারে উঠলাম। এদিকে পেট তো আর সইছে না....দুপুরের ভুরিভোজ শুরু করে দিলাম।

বিকেল ৪টার দিকে আমরা বাউফলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। যাওয়ার পথে যতটা উৎফুল্লতা নিয়ে গিয়েছিলাম ফেরার পথে ঠিক ততটাই বিষণ্নতা নিয়ে ফিরছিলাম। কারণ যাদের সঙ্গে আত্মার বন্ধন তাদের যে আবার ছেড়ে যেতে হবে আবারো বেড়ে যাবে দূরত্ব প্রয়োজনের তাগিদে।

এভাবেই আড্ডা দিতে দিতে নদীপথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যেটা আজকাল না করলেই নয়। সেই সেলফি তুলতে তুলতে স্মৃতিগুলো মুঠোয় পুরতে রাত ৭টায় নাগাদ ফিরে আসি আমাদের প্রাণের শহর বাউফলে।

বন্ধুদের থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল হৃদয় থেকে কিছু ছিন্ন করছি। শেষে সবার কাছে একটাই আবেদন এদিন যেনো বারে বারে ফিরে আসে আমাদের মাঝে। দূরত্ব যেনো আমাদের এ বন্ধন ভাঙতে না পারে।

এই শেষ বেলায় এসে মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন,‘গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ।’

জেএমএস/জিকেএস